বিস্মৃত এক কবির স্মৃতিচারণ (পঞ্চম পর্ব)
শংকর ব্রহ্ম


                     এখানে তাঁর সিলেট যুগের বই “রুদ্রবসন্ত” কাব্যগ্রন্থের এই কবিতা দুটি এখানে তুলে দিলাম পাঠকদের জন্য।

একটি সন্ধ্যা
-------------------
    
" বেতারে কার সেতার বাজে, বাংলা খবর শেষ,
শুনে শুনে পথ দিয়ে যাই, মনে সুরের রেশ,
মফস্বলের শহরতলি খানিকটা বন –ঘেঁষা,
ঝোপে ঝাড়ে সন্ধ্যা নামে বুনো গন্ধে মেশা,
বাঁকের মোড়েই হঠাৎ আসে রাঙা মাটির টিলা
ওর পিছনে উঁকি মারে পাহাড়টা একশিলা,
শেয়াল-ডাকা রাত্রি আসে যেই আসি ওর কাছে,
বাদুরগুলো ঝাপটা মারে কাক-ডুমুরের গাছে,
মাথার উপর ডাকল পেঁচা, চমকে উঠি—আরে!
আধখানা চাঁদ আটকে আছে টেলিগ্রাফের তারে! "

শীত-রাত
-----------------

" গ্রাম-বুড়ী কাঁথামুড়ি খড়ের ধোঁয়ায়
নাক ডেকে ঘাড় গুঁজে বেজায় ঘুমায়,
পথঘাট ঘুমে কাঠ, কোথা নেই সাড়া,

এক পায়ে ঘুম যায় গাছপালা খাড়া,
ঝোপে ঝোপে শেয়ালেরা সব চুপচাপ,
শিশিরের ফোঁটাগুলি ঝরে টুপটাপ,
ইঁদুরের বাদুড়ের নেই খুট্খাট,
একধারে শুয়ে আছে ধান-কাটা মাঠ।

বটগাছে কেঁদে ওঠে শকুনের ছা
জেগে উঠে পাখসাট মারে তার মা,
একা একা কুয়াশায় এই শীত-রাতে
কানা চাঁদ ভাঙা এক লণ্ঠন হাতে
আদম পুরের দিকে চালিয়েছে পা। "

আর এই 'চিত্রলেখা' কবিতাটি তাঁর পরবর্তী কালে শান্তিনিকেতনে থাকার সময়ে লেখা।

চিত্রলেখা
-------------------

" জানে ঐ ছোটো ঠোঁট দুটি
পৃথিবী প্রকান্ড এক সূর্য-সেঁকা রুটি
সারাদিন চলে তাই খুঁটে খুঁটে খাওয়া,
ফাঁকে-ফাঁকে ঘাড় তুলে চাওয়া
গায়ে মাখা হাওয়া
এর কাছে ওর কাছে যাওয়া
কিছুক্ষণ তারস্বরে গাওয়া।

এই শুধু চলে দিনভর
তারপর
সন্ধ্যা হলে চুপি-চুপি ফিরে যাওয়া ঘর
ডালের উপর
খড়ের বাসায় ঢুকে শুয়ে নিঝ্ঝুম
ঘাড় গুঁজে ঘুম।

গাছের সারির পিছে চুপি-চুপি কখন এখানে
এসেছে শবরী উষা,দাঁড়ায়েছে বনের আড়ালে,
পরেছে বিশাল খোঁপা, সদ্যফোটা রক্তজবা কানে
বুকের কাচুলিখানি বিঁধে আছে মহুয়ার ডালে।

ছিন্নমস্তা পৃথিবীকে দেখি
এখানে মাঠের একধারে
রক্তাক্ত চিৎকারে
পৃথিবীর আত্মহত্যা এ কি?

চারিদিকে ধসা মাঠ,কাঁকরের স্তুপ
কালের বিদ্রূপ
তারি এক পাশে
শেষ-সূর্য একবার জ্বলে ওঠে পশ্চিম আকাশে

তীর-বেঁধা রক্তসন্ধ্যা স্রস্ত এলোচুলে
খ'সে পড়ে দিগন্তের মূলে।

দিনশেষে এইখানে
পৃথিবীর মৃত্যুর শ্মশানে
খোয়াই আমাকে রোজ টানে।
মনে হয় সারাদিন দাঁড় বেয়ে চলেছি উজানে
সেই ভোর থেকে
দুই তীরে দেখে-দেখে
কত ঘাসে-ঢাকা জমি,কত ঝাউঝাড়
উঁচু-নিচু পাড়
কত পথঘাট
ধান-ভরা মাঠ
সারি-সারি ঘরবাড়ি
কত যে বিচিত্র নরনারী।

তারপর
দিনশেষে কমে আসে জোয়ারের জোর
পড়ে যায় হাওয়া
থেমে যায় বাওয়া
আবার ভাটার টানে
ফিরে আসি রোজ এইখানে।

এই সকালের বুকে একটি সোনার তার বাঁধা
রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে সাধা।
দিনের আলোর সাথে বীণার মতন
বেজে ওঠে শান্তিনিকেতন
চারিদিকে তার
জেহে ওঠে গাছপালা,পাখির ঝংকার
পথে পথে কাঁপে সেই সুর
বিচিত্র মধুর।

চমকায় সোনালি রোদ্দুর
ডাল-ডালে কচিপাতা হাসে
প্রজাপতি খেলা করে ঘাসে
মুখে-চুলে আলো মেখে ছুটে আসে ছেলেমেয়েদল
পুলক-চঞ্চল।"

------------------------------------------------------
[ তথ্য সংগ্রহ - অন্তর্জাল ও ঋণস্বীকার - অপূর্ব শর্মা।]