বিস্মৃত এক কবির স্মৃতিচারণ - (দ্বিতীয় পর্ব)


শিক্ষকতার পাশাপাশি অশোক বিজয় রাহা কাব্যচর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন। কবিতার সাথে শৈশবে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। কবিতার সাথে মিতালী করেই পথচলা অব্যাহত ছিল তাঁর। সময়ের সাথে সাথে সমৃদ্ধ হতে থাকে তাঁর কাব্যচর্চায় ভাণ্ডার। তাঁর ফলস্বরূপ যৌবনে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গেই কবি প্রতিভার স্বীকৃতি পান তিনি। ‘তাঁর ১৯ বছর বয়সের একগুচ্ছ কবিতা পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রশংসা বাণী লিখে দিয়েছিলেন তাঁকে। শুরুটা শৈশবে হলেও তাঁর কবিতা গ্রন্থভুক্ত হয় ১৯৪১ সালে। সেই সলেই তাঁর ‘ডিহাং নদীর বাকে’ ও ‘রুদ্র বসন্ত’ নামে দু'টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সিলেট থেকে কবিতার বইগুলো প্রকাশিত হলেও কাব্যরসিক বাঙালীদের মনের মধ্যে তাঁর কবিতা স্থান করে নেয়। কলকাতার সাহিত্যাঙ্গন মহলে বিপুল জনপ্রিয় হয় তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলো। এর একবছর পর ১৯৪২ সালে বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘কবিতা ভবন’ থেকে ‘ভানুমতির মাঠ’ প্রকাশ করে তাঁকে প্রথম শ্রেণীর কবি হিসেবে অভিনন্দিত করে স্বীকৃতি দান করেন।
        কবিগুরুর প্রশংসা বাণী, আর বুদ্ধদেব বসুর স্বীকৃতি কাব্যাঙ্গনে প্রবেশের পথ তাঁর সুগম করেছিল। তারপর কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে অশোক বিজয় রাহাকে তাই আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তাঁর শ্যামল, সতেজ কথামালা বিদগ্ধজনের হৃদয়ে তাঁর জন্য-আসন তৈরী করে তোলে। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা, আর মানুষের জীবনাচার তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু হওয়ায় কাব্যাঙ্গনে তার অবস্থান সুদৃঢ় হতে থাকে। সিলেট ও কাছাড়ের শ্যামলবেষ্টিত চা বাগানে কৈশর উত্তীর্ণ হয়েছে তার। পিতার কর্মক্ষেত্রের সুবাদে তিনি চা-বাগানের নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য্য ছেলে বেলাতেই অবগাহন করেন। সেই প্রভাব পরিস্ফুটিত হয়েছে তাঁর কবিতায় ক্যানভাসে। সিলেট ও কাছাড়ের জীবনযাত্রার চিত্র তিনি তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন সন্তর্পণে  -

" একদিকে পাহাড়-চূড়ায়
প্রকাণ্ড সেগুন-বন ঢেকে আছে অর্ধেক আকাশ
জমাট রাত্রির মতো,
বুকে তা’র
ঝিঁঝিঁ- ডাকা গায় অন্ধকার,
শতাব্দীর ঘুম।

অন্যদিকে পাহাড়ের কোলে
ঘুমায় পড়ন্ত- রোদে শালবন,
ছায়া পড়ে ঢালুর কিনারে,
পাশ দিয়ে একখানি আঁকাবাঁকা পথ
নেমেছে সাপের মতো।

মাঝখানে ধূ-ধূ ফাঁকা মাঠ,
একফালি আকাশের ফাঁক,
একটি পাখির শিষ রেখা টেনে যায়
সূর্যাস্তের দিকে। "

(দিনান্ত, ‘জল-ডম্বরু পাহাড়’)

সাবলীল ও নিখুঁতভাবে তিনি বনাঞ্চলবেষ্টিত সিলেটের বর্ণনা দিয়েছেন এই কবিতায়। পাহাড়ঘেরা সিলেট অঞ্চলের প্রতিচিত্র যেন ‘দিনান্ত’ কবিতায় ভাস্বর। নিসর্গের প্রতিচ্ছবি তিনি নিখুঁতভাবে চিত্রন করেছেন শব্দ দক্ষতায়।

কবি অশোক বিজয় ছিলেন বৈষ্ণব ভাবনার অনুগত। তাঁর পিতা-মাতা দুজনেই ছিলেন শ্রী চৈতন্যের ভাবশিষ্য ও বৈষ্ণব ভাবাপন্ন। তবে পারিবারিক, আবহের কারণে নয়, বৈষ্ণব ভাবধারার প্রতি নিজেই অনুরক্ত ছিলেন তিনি। তাঁর ব্যক্তি জীবনের সেই ভাবধারার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

" আমি শুধু জানি এ জ্যোৎস্না রাতে
কত কচি ডালে ফুলের প্রসব-ব্যথা,
কুমারীর বুকে কত যন্ত্রণা নিয়ে
জন্ম নিতেছে প্রথম প্রেমের কুঁড়ি। "
(চিঠি, ডিহাং নদীর বাঁকে)