বাংলা প্রেমের কবিতায় পদাবলীর প্রভাব
শংকর ব্রহ্ম


         একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে,আজকাল বাংলায় যত কবিতা লেখা হচ্ছে, তার ষাট ভাগই প্রেমের,বাকী চল্লিশ ভাগের মধ্যে দৈব ও প্রকৃতি বিষয়ক কুড়ি ভাগ,
সমাজ সচেতনতা প্রতিবাদ রাজনীতি বিষয়ক দশ ভাগ,ও বাকী দশ ভাগ অন্যান্য বিষয়ক।
            আবহমানকাল ধরে ভারতবর্ষের
কবিগণ প্রেমের কবিতায় বৈষ্ণব কবিগণের ইঙ্গিতকে অনুসরণ করে রসোৎকর্ষ সাধন করেছেন তাদের নিজেদের কবিতায়।এ'কালের কবিরাও তার ব্যতিক্রম নন।
           বৈষ্ণব কবিতার সার কথা, সম্ভোগকে প্রধান করে ধরলে,প্রেম অনেকখানি স্থূল হয়ে পড়ে।তাই তারা বিরহকে প্রধান করে প্রেমের ভিতরে সূক্ষতার ও অতলতার সৃষ্ট করেছেন,যাতে প্রেম রূপ থেকে অরূপে পৌঁছাতে পারে।বিরহের অনুভূতি বৈষ্ণব কবিতায় বিশিষ্টতা লাভ করেছে।বৈষ্ণব কবিতায় সমস্ত আয়োজনই প্রেমাস্পদের সঙ্গে ব্যবধানের যন্ত্রণাকে ব্যক্ত করার জন্য। কলঙ্ক,প্রতিকূলতা,নিষিদ্ধতা এ'সবের প্রকাশে সে বেদনা আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
      শাস্ত্রীয় ও সামাজিক নির্দেশের প্রতিকূলে দাঁড়িয়ে বৈষ্ণব কবিগণ তাদের
অনুভূতিকে যাচাই করে নিতে ভয় পাননি।
রাধা কুলবধূ। প্রতিদিনের আটপৌরে সংসারের মাঝে হঠাৎ কৃষ্ণের সঙ্গে তার দেখা,আর এই দেখা থেকেই প্রেমের যন্ত্রণার শুরু।কুলবধূর দিক থেকে এ'ব্যাপরটা মোটেই সামাজিক নয়।
এর আগে এই মানবিক আবেদনকে স্বীকার করতে আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।
কি জীবনে কি শিল্পে এই মানবিক আবেদনের কোন জয়ধ্বনিই ধ্বনিত হয়নি।আমাদের জীবন ছিল কর্তব্য ও আচার নির্ভর।কখনও স্মৃতির অনুশাসনে কখনও সাধনমার্গের নির্দেশে সে ছিল নিয়ন্ত্রিত।আমরা পত্নীসঙ্গ উপভোগ করেছি পুত্রার্থে,আবার পুত্র কামনা করেছি পুন্নাম নরকের কথা চিন্তা করে।
আর বৈষ্ণব কাব্যের প্রয়াস প্রেমের পার্থিব বেদনা থেকে অপার্থিব দ্যুতির সন্ধানে চলা।ফলে স্পর্শ করতে পেরেছে মানুষের মনকে,তত্ত্বনিরপেক্ষ ভাবে।
       যা কিছু স্থূল দৈহিকতা, প্রথানুগ ক্লিন্নতা,অলঙ্কার,বর্ণনা যেন সব ধুয়ে মুছে গেছে বেদনার করুণ স্পর্শে।তাই মেঘের দিকে চেয়ে,চাঁদের দিকে চেয়ে,সমুদ্রের নীল জলের দিকে চেয়ে,বনের দিকে চেয়ে,ময়ূরের কন্ঠধ্বনি শুনে প্রেমিকার চোখে জল আসে।পূর্বরাগের উজ্জ্বল মুহূর্তে তার মনে হয় - " হেরি অহরহ তোমারই বিরহ বিশ্বভুবন মাঝে।"
         যে প্রেমে সামজিক বরমাল্য নেই, সাংসারিক স্বীকৃতি নেই সেই অকৃতার্থতায়
আসে এক দিব্যদ্যুতি, তারই স্ফূরণ ঘটে কাব্যে - " দুহুঁ কোরে দুহুঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।"
বৈষ্ণব নায়িকা জীবনের যন্ত্রণার মন্দিরে
প্রেমকে প্রতিষ্ঠা করেছেন।প্রেমই সেই মন্দিরের বিগ্রহ।" তারই স্নান লাগি হৃদি যমুনায় আঁখির কুম্ভ ভরি।"
    আধুনিক কবি বলেন,প্রেমের চেয়ে জীবন বড়। আর বৈষ্ণবী নায়িকা বলেন,
জীবনের চেয়ে প্রেম বড়।
      অবশ্য প্রেমের এই ব্যক্তিগত ইচ্ছেকে
ইচ্ছের স্বাধীনতা বলা চলে না।তবুও সন্দেহ থাকে না যে প্রেম কি পরিমাণ আলোড়ণ সৃষ্টি করে মানুষের মনে।
        ইওরোপের মধ্যযুগীয় প্রেমের আখ্যানে এই শাশ্বত প্রেমের অনুভব স্পষ্ট
শোনা গেছে।ত্রুবাদুরদের গানে ব্যক্তিহত
আবেগময় বাসনাকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।সুফিবাদের সঙ্গে আত্মিকতা কিংবা ত্রুবাদুরদের মরমী আকুলতা মিলে মিশে যায়।বিখ্যাত কাব্যগীতি আলেখ্য
Tristan and Iseult যার নায়ক নায়িকা,
সেখানে একস্থানে Iseult জিজ্ঞেস করছে
Tristan কে," We have lost the world
and the world has lost us.How does it seem to you Tristan my love?"
   Tristan জবাব দিল " When I have you with me beloved,what do I lack? If all the worlds were with us here and now I should have eyes for nothing but you alone. " যে কথা আমরা এখানে Tristan-এর মুখে শুনলাম, রাধার প্রেমের ঘোষণায় তারই প্রতিধ্বনি,
" ছাড়ে ছাড়ুক পতি             কি ঘর বসতি
          কিবা বা করিবে বাপ মায়
জাতি জীবন ধন                 এ রূপ যৌবন
          নিছনি ফেলিব শ্যাম পায়
সমুখে রাখিয়া                    নয়ানে দেখিমু
          লইয়া থাকিমু চোখে চোখে
হার করিয়া                         গলায় বান্ধিয়া
           লইয়া থাকিমু বুকে।।

এই কবিতার শেষ ভাগে কবি বলরাম দাস
জানাচ্ছেন,যে রাধার ইচ্ছে করছে এমন এক দেশে চলে যেতে, যেখানে 'রাধা' বলে
কেউ তাকে পিছে ডাকবে না। কোন সাংসারিক বা সামাজিক আবেদন তাকে
বিরক্ত করবে না। এই পলায়নী মনোবৃত্তি
ব্যক্তিগত বাসনার তীব্রতার দ্যোতক।
অনড় সমাজের পটভূমিতে সেই তীব্রতা বিদ্যুল্লেখার মতো ঝলসে উঠেছে।অসামাজিক প্রেম বলে বোধহয় মিলনেও
চরম তৃপ্তি নেই।বৈষ্ণব কবিতায় তা প্রতিফলিত হয়েছে,
" এক তনু হইয়া মোরা রজনী গোঙাই।
   সুখের সাগরে ডুবি অবধি না পাই।।
   রজনী প্রভাত হইলে কাতর হিয়ায়।
   দেহ ছাড়ি যেন মোর প্রাণ চলে যায়।।"
ত্রুবাদারদের কন্ঠে সেই একই বেদনার সুর
" Oh would to God night might forever stay,
And my friend never again be far away,
And the watchman never spy the dawn of day !
Oh God ! Oh God ! How quickly dawn comes round.
( ওগো ভগবান,আজ রাত হোক অফুরান চির রাতি
রাত্রি থাকুক থামি,যেন আমাকে ছেড়ে না যেতে পারে আমার সাথী,
প্রহরী যেন না দেখে, দিনের প্রথম আলোর বাতি
হায় ভগবান, কেন দিবস ফিরে আসে এত দ্রুতি?)
*অনুবাদ - লেখকের।
----------------------------------------------------
  [ঋণস্বীকার - সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় ]