সেদিন দশম শ্রেণীতে প্রথম বিজ্ঞান ক্লাস
এক ঘর ছাত্রছাত্রীর সামনে চক হাতে বোর্ডে আমি,
নতুন চাকরি, অধ্যায় আলো, ক্লাস শেষে শুধলাম
সবাই ঠিক বুঝেছ তো ? কোন প্রশ্ন আছে ?
একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার –
রামধনুতে সাতটি রঙ হয় কিভাবে?
ভারী মিষ্টি মুখ, কোঁকরা চুল অযত্নে লালচে,
তামাটে গায়ের রঙ, একটু শীর্ণ গড়ন,
লাল ফিতের বিনুনি, হাওয়াই চটি পায়ে ……
উজ্জল চোখে জানার অদম্য আগ্রহ,
এ মেয়ে একটু যত্ন পেলে অনেক বড় হবে!
বুঝিয়ে দিলাম, ক্লাসের শেষে ওরা আমায় করল প্রনাম ।
জানতে পারলাম মেধাবী ছাত্রী দিনমজুরের মেয়ে—
প্রত্যন্ত গ্রামের শিক্ষার্থী, ফিরে গেল সবাই একসাথে,
ছুটির পরে,পিচ ঢালা রাস্তা থেকে নেমে,  
আলপথ ধরে, নীল দিগন্তের দিকে—
উদাসী আমি, স্কুল বাড়ির বারান্দায় মানস চোখে আবার সে ছবি
অনুরণন …………একটু যত্ন চাই, আগ্রহ আছে।

আমার বাবা ছিলেন দিনমজুর,
মা কাজ করত মজিদ স্যরের বাড়িতে,
বছর চারেক আমার তখন, মায়ের সাথেই যেতাম আমি ---
গোবর লেপা উঠোনের কোনে মাটিতে,
সেদিন একমনে আঁকছিলাম,
কাঠি দিয়ে বলে বলে লিখছিলাম মা,ভা ত,ক ল মি,
মায়ের কাছেই লেখা শেখা।
মজিদ স্যর কখন পেছনে এসেছিলেন বুঝিনি,
হঠাৎ দেখেই চমকে গেলাম, বললেন,
একটু যত্ন চাই, আগ্রহ আছে ছেলেটার !
কাল স্কুলে পাঠিয়ে দিও কানাইয়ের সাথে,
বুঝলে তো গোপালের মা ।
সেই শুরু হল জীবন পথের চলা।
বাবার সাথে পান্তা খেয়ে প্রতিদিন তিন ক্রোশ পথ হাঁটা,
বিদ্যুৎ নেই, মাটির দাওয়া, একটি বাঁশের মাচা …
ভরসা ছিল শিক্ষাবৃত্তি, ভোরের নির্মল আলো আর …
মজিদ স্যরের প্রেরনা,
এম এস সি, বি এড  হল দিনমজুরের ছেলে
পরীক্ষা দিয়ে হয়ে গেলাম সবার প্রিয় গোপাল স্যর।
আগে কিছুদিন পিওনের কাজও জুটেছিল ।

একদিন বিকেলে কালবৈশাখী  এল আকাশ ধেয়ে,
স্কুল বাড়ির টিনের চালা উড়েই গেল, তোলপাড় করা হাওয়ায়,
পরদিন,স্কুলবাড়িতে সূর্যটা ভীষণভাবেই তাপ ছড়াল।
কদিন থেকেই ঘুম ছিলনা উৎকণ্ঠায় ……
গণতন্ত্রের মহোৎসবের রঙ্গিন খেলায়,
কে যায়, কে আসে, সে আলাপ চায়ের কাপে,
মাছবাজারে, নদীর ঘাটে, মন্দিরে,
জ্যোতিষ অনেক, গলার জোরে জিতবে সবাই,  
দেদার খানা, খাচ্ছে সবাই দাদার টাকায়
উদার দাদার ভোট বড় বালাই।
পাড়ার মোরে জটলা কেন সকাল থেকেই ?
দৃষ্টি যেন আমার দিকেই,
ঘটল নাকি কিছু ? একি তারই সানাই ?

দুপুরবেলা ডাক পড়ল বড়র ঘরে
দৃষ্টি তার ভারতমাতার ছবির দিকে,
বললেন, গোপাল বাবু, চাকরিটা বাঁচল না আর  
আপনি, সমর আর সুজয় স্যরের ।
অযোগ্য আর যোগ্যরা সব একই সারিতে।
কি আর করবেন, পাশে আছি, প্রয়োজনে ……
নির্বাক আমি, হাতটা আমার বুকের কাছেই কলম ছুঁয়ে,
শূন্য বুকে পালিয়ে এলাম বড়র থেকে।

পিচ রাস্তায় রবির কিরণে জলের ছবি !  
দিগন্তে টুকরো মেঘে, হাত উঁচিয়ে কলম মুঠে !!
ভাবছি আমি পুতুল গুলোর চোখ বাঁধা !!
নড়ছে কাঁটা, ঘুরবে সময় আমার আশা।  

**************************************