কালো ঘোড়ার কাহিনী
যাযাবর খন্ড
©সন্দীপ দাস
১।।
অচেনা দ্বীপে ট্রেন এসে থামলো । তখন ভোর ,
অর্ধেক পেরিয়ে চার । একটা ভিড় ঘেরাও করেছে আমাদের । আমাদের মানে একটা শরীর আর দুটো ছেঁড়া ব্যাগ ।
ভিড় ঠেলে সটান মাথা তুলে দাঁড়ালাম । মনে হল;
ভারত সভায় বাঙলা আবার মাথা তুলে দাঁড়ালো । এরিয়াল ভিউ থেকে ট্রেনের টাকলা মাথা দেখতে দেখতে সূর্যের হাসি খুশি মুখ দেখা দিল প্রথমবার । চোখ চেয়ে দেখলাম একই সকাল সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো ,
গুড মর্নিং ভোপাল ।
সব একই , মানুষগুলো একই , শুধু শহর টা অনেক আলাদা । অফিসের কাছেই একটা বয়েজ হোস্টেল । ছেড়া ধুলো জমা ঘর আমার । তবে নতুনের আনন্দ ভুলিয়ে রেখেছিল নতুন এক আগামীর সংসার । সবই নতুন ,
নতুন রাস্তা , নতুন পথ , নতুন ঘাট , নতুন রাজপথ , নতুন ভাষা , নতুন কাজের চেহারা ।
একদিন এখানটাই স্বপ্ন ছিল , পুরোনো প্রেমের টানে আর আজ পুরোনোটাই বড্ড নবীন শুধু জীবনটা বড্ড কালো , রঙহীন ।
কালো ঘোড়ার কাহিনী
যাযাবর খন্ড
©সন্দীপ দাস
২।।
গল্পটা দ্বিতীয়বার বলাটা খুব কষ্টের । দ্বিতীয়বার বলা মানেই কোষে যাওয়া পায়খানা । বেরিয়েও বেরোয় না ।
তবু বলছি শুনুন ।
ফেসবুক জানতো না আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা গড়ে উঠবে । ঝাঁসির গল্প আগেও বলেছি , আর বলতে চাই না ; তবু আবার বলছি । গল্পটা দ্বিতীয়বার বলাটা খুব কষ্টের ।
ভেঙে গেছে যে দিনটা তার গল্প আকাশ জানে না কিন্তু সূর্য তো জানতো । সূর্যের আলো এবারে যখন গায়ে এসে পড়ল , ফোস্কা পড়ে গেল সারা গা জুড়ে । আহ ! কি আরাম সে যন্ত্রণার । তবু কাজ আমায় ডাক ছাড়ে ।
রুটির মত পুড়ে যাচ্ছি । তবু ওপর থেকে নরম রেখেছি , অতীতটা আমায় চিবিয়ে খাবে বলে ।
গল্পটা দ্বিতীয়বার বলাটা খুব কষ্টের । বেরিয়েও বেরোয় না ।
নেশা করিনি এখনও তাই বলতে পারছি মনে হয় ।
কালো ঘোড়ার কাহিনী
যাযাবর খন্ড
©সন্দীপ দাস
৩।।
মহাকালে সকাল হত শিপ্রার আনন্দে আর রাত হত লাড্ডুর গন্ধে । তাজা ঘিয়ে ভাজা লাড্ডু ।
অফিসে কাজ ছিল না তেমন । সন্ধ্যা গড়ানোর অনেক আগেই শপিং মলে ভিড় করতাম , ঠিক যেমনটা আড্ডার ঠেকে ভিড় জমতো । ইন্দ্রজিৎ বা শুভদীপের ঠোঁটে জ্বলে উঠতো নিকোটিন ।
এখানে কেউ নেই । ধোঁয়া নেই । পোড়া নিকোটিন নেই । নেই সেই দেবাদার দোকান । তবু
যেখানে যেখানে
ভিড় জমে আজও সেখানে একটা চেনা মুখ দেখা দেয় - বাস্তবে হোক অথবা কল্পনায় ।
কালো ঘোড়ার কাহিনী
যাযাবর খন্ড
©সন্দীপ দাস
৪।।
চারটে মানেই খুশির সময় , চারটে মানেই ছুটি ।
আসানসোল ঢুকছিল গাড়িটা আর আমি ঘুমিয়ে
নিজের সিটে ।
প্রায় সারা রাত জেগে কাটিয়েছি । ঠিক যেমন শহর জুড়ে জেগে থাকতো ওরা : দেহের সওদা করবে বলে । আমি অবিশ্যি সওদা করেছি নিজের সাথে । নিজের দেশে ফিরবো না বলে ।
শিপ্রার শান্ত ঘাটে ভিড় জমেছে । আরতির মাদল বেজে উঠলো মন্দিরে । আমি দূর থেকে দেখছি সমস্তটাই । ক্যামেরা হীন তাই স্মৃতিগুলো তুলে রাখছি মনে মনে ।
এরই মধ্যে গল্প লিখি , কবিতা লিখি শখ করে । নিরামিশি উজ্জইনে মাংসের গন্ধ এখন , এক বাঙালির হাত ধরে ।
আমিষ ছাড়া চলতে পারি না । মনে পড়ে নিজের মাটির কথা । সেই স্কুল , সাদা ড্রেস লাল হয়ে ওঠা , ওভালের মাঠ আর পনেরই আগস্ট ।
আজ চোদ্দই আগস্ট । উজ্জইন ছেড়ে যাওয়ার পালা ।
ভোপাল কলিং ।
কালো ঘোড়ার কাহিনী
যাযাবর খন্ড
©সন্দীপ দাস
৫।।
দ্বিতীয় প্রেমের গল্পটা বলেই ফেলি তবে ।
ভোপালে একটা মস্ত ফ্ল্যাটে আমি একা । ভাড়া করেছি কিছুটা একলা মেজাজ আর শান্তি অনেককটা ।
এরই মধ্যে মন হারিয়েছি আরেক বার । বঙ্গ ললনা এবার ; মন করলো চুরি আবার । ভালো লাগে কি আর ; ওই দূরে দিন কাটাতে এরপর !
ঐতিহাসিক নভেম্বরে বাংলায় আবার এলাম ফিরে । সময়টা ঠিক পুজোর পরে । কেউ জানে না কি করছি আমি । শুধু আমরা জানি , আনন্দ কিভাবে গ্রাস করছে আমাদের ।
তারপর কি পেলাম আর কি হারালাম বাদ দিন সে সব কথা । আজকে এখানেই থাক । প্রেমটা জমতে দিন । কালঘোড়ায় কালো লাগাম লাগুক ,
কালো একটা দিনের শেষে ।
কালো ঘোড়ার কাহিনী
দোসর খন্ড
©সন্দীপ দাস
৬।।
ছ'টা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেই সব শেষ । পরীক্ষার নিয়ম এটাই ।
ছ'টা বল হয়ে গেলেই ওভার শেষ ।
ছ'টা ঋতু কাটিয়ে দিলেই বছর কাবার ।
ছয় মারতে পারলেই সমস্ত রেকর্ড পার ।
মায়ের হাতের সেই কুমড়োর ছক্কা ,
ছ মাস ধরে খাইনি ।
ছ'দিন পরে রবিবার । সব কিছু থেকে ছুটি ।
হাতের পাঁচটা আঙ্গুল আর আমি - এই ছজনে
কোনদিন আবার চুটিয়ে আড্ডা হবে ।
বাড়িতে ছ'টা চারা গাছ ছিল - গোলাপ , তুলসী , জবা , জুঁই , চাঁপা আর রজনী ।
ছ'টাই মায়ের হাতে করে লাগানো ।
এখন বেশ বুড়ো হয়ে উঠেছে ।
রোজ সকালে মা তুলসী গাছে জল দিতে গেলে ,
রোদের ছটার সাথে ছ'টা চারা হেসে উঠতো ,
বাকি সময় সবাই চুপচাপ ।
আমার প্রথম ছ'বছর চিত্তরঞ্জনে বেশ সুখের ছিল
ছ জন বন্ধু মিলে দাপিয়ে বেড়াতাম ।
এত কিছু কেন বলছি জানেন ?
কারন এই ডেকানে সবই পাঁচ , ছয় বলে কিছুই নেই আর -
তাই ছ'বার প্রেম করতাম সেই কালো মুঠোফোনে ,
ওটাও যদি পাঁচ হয়ে যায় !
এই ভয়ে ।।
কালো ঘোড়ার কাহিনী
দোসর খন্ড
©সন্দীপ দাস
৭।।
আকাশ নীল না হয়ে কালো হতে পারতো আজ । মাটির ফসল পুড়ে যাক গরম দুপুরে । খিদে পেলে চাতক হয়ে বসে থাকতাম । ঘরেতে একটা কালো বিছানা খুবই যত্ন করে পাতা ।
সূর্যের গ্রহণ লেগেছে । কালো লাগছে চারদিকটা । যদিও পথটা খুব চেনা , তবু মন্দির লাগোয়া শিপ্রায় জল আজ থামে না ।
পাখিগুলো পথ ভুল করেছে । আমার পিছনে পিছনে অনেকদূর চলে এলো । সবাই বেশ জানে আমি কতটা কর্মঠ । তবু প্রতিদিন সব কাজের শেষে মৃত্যু কাজের জন্য আমার সময় বাঁচে না ।
নতুন একটা প্লটে দিন শুরু হবে তাড়াতাড়ি । কালো ঘোড়ার কালো চোখে কালো জল জমেছে । এতদিন ডিফ ছিল সে , এবার কালো স্রোতে ডুব দিয়ে ডাম্ব-ও হয়ে গেছে ।
কালো ঘোড়ার কাহিনী
দোসর খন্ড
©সন্দীপ দাস
৮।।
দেওয়ার মত কিছু নেই আমার , শুধু একমুঠো সময় ছাড়া ।
জঙ্গলের ঘন কালো অন্ধকার আমার প্রেমিকা ।
অস্তগামী সূর্যের মত নতুন কোন জায়গায় মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসার আমার তীব্র ইচ্ছা ।
তোমার চোখে চোখ রেখে দিয়েছি ।
কালো রঙ আমাদের জীবনে আনুক নতুন নতুন অধ্যায় । লিখে ফেলুক একটা কালঘোড়ার কাহিনী ।
ফিরতি পথে বিদায় জানানোর পালা । কত গাছ , মাঠ আজ ফুলে ফলে সেজে উঠেছে ।
জানোয়ার ছিলাম এতদিন । আজ তোমার আঁচড়ে শরীরটা মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে ।
আজ থেকে আট হাজার বছর পেরিয়ে এই আট নম্বর হিজিবিজিখানা যখন
কেউ আট বার পড়ে , আট ফোঁটা চোখের জলে , আট নম্বর পাতাখানা ভিজিয়ে দিয়ে আট বসুকে খুঁজবে ;
তখন হয়ত আমি সপ্তম আশ্চর্য হবো , তোমার প্রেমে ,
অষ্টম গর্ভ থেকে বেরিয়ে ।
কালো ঘোড়ার কাহিনী
দোসর খন্ড
©সন্দীপ দাস
৯।।
শরীরটা ভীষন অসুস্থ । পিত্তরোগে শয্যাশায়ী ।
তবু নিয়ম মেনে রাত জাগা ।
কিছু সুপ্ত ইচ্ছা ভর করে আছে । তুমি এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ দায়ী ।
এই বিশাল পৃথিবী আমাদের । তারই মধ্যে তোমার পরিচয়
আমি নয় ।
আমি চাই তুমি নিজে হবে নিজের পরিচয় ।
অন্যদিকে অফিসিয়াল দিন এগিয়ে । এক কাপ ব্ল্যাক চায়ে চুমুক দিতেই
শরীরটা চাঙ্গা মনে হল ।
মনে পড়লো সেই চানকির বাড়ি , বইয়ের স্তুপ আর চায়ের কালচে কাপ ।
অতীত অন্ধকারে থাকুক আজ । আজ কোনো ঝগড়া নয় ।
আজ কোন অনীহা নয় ।
কালঘোড়া ফিরবে আবার ।
দেশের মাটিতে অপেক্ষায় তিনজন আর লেট ট্রেন আমাদের -
ফুরাচ্ছে না এইটুকু রাস্তা কিছুতেই ।
জন্ডিস পেশেন্ট বাঁচে না কোনদিন । অনেকে
চোখ বন্ধ করে নিয়েছে আগেভাগেই ।
অনেকে চোখ খুলে অপেক্ষা করছে জীব কে তৃপ্তি করাবার ।
কালো ঘোড়ার কাহিনী
দোসর খন্ড
©সন্দীপ দাস
১০।।
ভাঙা একটা লাঠি আর বুড়ো বয়সের মিল কোনখানে ?
জানেন না । তাহলে জানতে থাকুন আর জানতে হলে সাহিত্য করতে শিখুন ।
সাহিত্যের ভিতরে একটা হাঁটা আছে , একটা ঘুম আছে , একটা দৌড় আছে , একটু বিশ্রাম আছে ।
আমারও ছিল । তারও ছিল ।
একটা কালো জামা । বর্ষার মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে আবার উড়িয়েও ।
আজ বয়স হয়েছে পৃথিবীর । তাই মেরুদন্ড বেঁকে গেছে ।
লাঠি ভেঙে গেছে । ভালোবাসতাম তখন স্বভাবে ।
যেদিন থেকে ভেঙে গেল সমস্তটাই , সেদিন থেকে ভালোবাসা খুঁজি অভাবে ।
তবু ব্যাথা খুব । সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না কালঘোড়ার গল্পখন্ড ।
একটা উপহার তাকে দিতে চাই ।
ডিটিপিতে এডিট করলাম , কালো কাঁচের ওপারে কালো চশমার পিছনে সে ,
এপারে একটা কেক , রঙহীন ফ্যাকাসে ।
কালো ঘোড়ার কাহিনী
বেদনা খন্ড
©সন্দীপ দাস
১১।।
এগারোর ফের পিছু ছাড়ে না ।
হাতের তলায় , বগলে , পেটে , বুকে জমে থাকা মেদ ঝড়ে পড়ছে
অদৃশ্য হয়েই ।
এতক্ষনে সব ঠিকঠাক হয়ে যেতে পারতো । তবু শুধু ওষুধে কাজ হয় না ।
ভগবান আজ চাইছে না মোটেই । ফিরে আসার ,
নিজের ঘরের জন্য পাগলামিটা বেড়ে চলেছে ।
উনুনের গরম আঁচ । রুটি সেঁকা হচ্ছে ।
পেটের ভিতর ছুঁচো ডন দিচ্ছে ।
আর বাইরে হাজারটা মানা ।
খেতে ইচ্ছা জাগে । খেতে মানা ।
প্রকৃতি দেখতে ইচ্ছা হয় । বন্ধ ঘর ; বেরোতে মানা ।
অফিস , কাচারি ;
বন্ধু , শত্রু
সব মানা ।
এরপর আর একবার শেষ চেষ্টা করবো ।
কালো পশ্চাৎ ঝুলিয়ে বসে আছি ।
সাদা রঙ নিয়ে শান্তির দুর্গন্ধ নেমে আসছে ,
অশান্তির কালো ভাইরাস কিন্তু নামছে না ।
কালো ঘোড়ার কাহিনী
বেদনা খন্ড
©সন্দীপ দাস
১২।।
পাগল এ মনে লাগলো ফাগুন ছোঁয়া ,
রঙের জলে শুধুই ধুয়ে যাওয়া ;
এক বেলার নীরবতা l
স্বপ্ন গুলো পাগল হয়ে ডাকে ;
ফাটা ক্যানভাসে এ মন হিজিবিজি আঁকে l
যাযাবর ছিলাম , ছিল না কোনো আস্তানা ;
ঠাঁই হলো; এলো নাম,সম্মান, আরও বদনাম ,
হারিয়ে গেলাম ; নিজের নামের ছাওয়ায় l
কবরে শুয়ে থাকা মৃতদেহ যেমন
নীরব , নিশ্চিন্ত , নিরুদ্বেগ ; ঠিক তেমন-ই ,
এক এক পা ফেলা দেখেছি সময়ের
কখনো জোয়ার আবার কখনো ভাটায় l
মৌমাছি হয়ে ভনভনিয়েছি ;মধুর খোঁজে l
সফলতা আজ তাজ হয়ে বসে আছে
ফাগুনের রঙের অপেক্ষায় ; মনের দরজায় l
ডানা মেলে উড়তে শিখেছি , মেঘেদের দেশে
মুক্ত সে বায়ুর হাত ধরে ;
যখন বায়ু ও নেই , মেঘ ও নেই -
বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে ঝরে গেছে অঝোরে l
বুঝেছি এবার , জীবনটা শুধুই একলার
নাম যশ অর্থ আর ক্ষমতা দিয়ে গড়া স্বার্থপরতা ,
বাকি সমস্ত ভালোবাসার সম্পর্কগুলো
নিমিত্ত মাত্র l
ক্রমশ : ---