আবাল্য শুনেছি মেয়ে বাংলাদেশ জ্ঞানীর আঁতুড়
অধীর বৃষ্টির মাঝে জন্ম নেন শত মহীরুহ,
জ্ঞানের প্রকোষ্ঠে দেখো, ঝোলে আজ বিষণ্ন বাদুড়
অতীতে বিশ্বাস রাখা হে সুশীলা, কেমন দুরূহ?
কি করে মানবো বলো শ্রীজ্ঞানের জন্মভূমি এই
শীলভদ্রও নিয়েছিলো নিঃশ্বাসের প্রথম বাতাস,
অতীতে বাদ দিলে আজ তার কোনো কিছু নেই
বিদ্যালয়ে কেশে ওঠে গুটিকয় সিনানথ্রোপাসৃ
আমাদের কলাকেন্দ্রে, আমাদের সর্বকারুকাজে
অস্তিবাদী জিরাফেরা বাড়িয়েছে ব্যক্তিগত গলা।
(সনেট-১১, সোনালি কাবিন)
আধুনিক বাংলা কবিতায় তিরিশের কাব্য আন্দোলনের প্রবণতার মধ্যেই ভাটি অঞ্চলের মানুষের যাপনচিত্র, একদম গ্রামীন সরল জীবন যাপন, নদীজনপথের ভাষা, চরাঞ্চলের কর্মমূখর রুক্ষ্ম জীবন বৈচিত্র ও নর-নারীর চিরায়ত প্রেম-বিরহ তাঁর কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে। প্রচলিত আধুনিক কাঠমোর মধ্যেই অত্যন্ত সুনিপুনভাবে লোকজ শব্দের কারুময় প্রকাশ কাব্য সচেতনদের মধ্যে এক নতুন পুলক সৃষ্টি করেন। আর সে জন্যই আধুনিক কবিতার সমালোচকগণ একদিকে জসীমদ্দীন অন্যদিকে জীবনানন্দ দাশের থেকেও আলাদা করে উল্লেখ করেছেন কবি আল মাহমুদকে। কবিতায় নিবেদিত তরুণের যখন দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিলো তখনই ১৯৬৮ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে কবিতায় তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। তারপর ‘সোনালি কাবিন’ দেশ-বিদেশে বাংলা কবিতা পাঠে আগ্রহী পাঠকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় সোনালি কাবিনের একাধিক কবিতা অনুবাদ হয়েছে। কবি এভাবে সবুজ ভাষার সাথে নিজের কণ্ঠ মিলিয়ে বলেছেন-
নদীর সিকস্তী কোনো গ্রামাঞ্চলে মধ্যরাতে কেউ
যেমন শুনতে পেলে অকস্মাৎ জলের জোয়ার,
হাতড়ে তালাশ করে সঙ্গিনীকে, আছে কিনা সেও
যে নারী উন্মুক্ত করে তার ধন-ধান্যের দুয়ার ।
অন্ধ আতঙ্কের রাতে ধরো ভদ্রে, আমার এ-হাত
তোমার শরীরে যদি থেকে থাকে শস্যের সুবাস,
খোরাকির শত্রু আনে যত হিংস্র লোভের আঘাত
আমরা ফিরাবো সেই খাদ্যলোভী রাহুর তরাস ।
(সনেট-১২, সোনালি কাবিন)
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্বের সময় কবি আল মাহমুদ কলকাতা থাকাকালীন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘সোনালি কাবিন’ শিরোনামে ১৪টি সনেট নিয়ে সাড়ে চার ইঞ্চি বাই সাড়ে তিন ইঞ্চি সাইজের মিনিবুক সিরিজে ‘সোনালি কাবিন’ প্রকাশিত হয়। ঝকঝকে ছাপায় মুদ্রিত এই পুস্তিকাটি মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই নি:শেষ হয়ে যায়। সেই ‘সোনালি কাবিন’ ১৯৭৩ সালে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। প্রকাশক ছিলেন আারিফ খান। প্রগতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদ করেছিলেন ড. নওয়াজেশ আহমেদ ও কালাম মাহমুদ। ৭২ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য ছিলো সাড়ে পাঁচ টাকা। সমগ্র বাংলা কবিতার ইতিহাসে ‘সোনালি কাবিন’ একটি উজ্জ্বল মাইল ফলক হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। লোকজ শব্দের বিষয় বিন্যাসকে অত্যন্ত দক্ষ শিল্পির ন্যায় অনন্য এক যাদুময়তা তৈরি করেছেন কবি আাল মাহমুদ। এরপর যাদুর কলমের মতো একের পর এক বিস্ময়কর কাব্য সৃষ্টিতে বাংলা কবিতায় যোগ হয়ে থাকে প্রকৃত সোনালি পালক।
কবি ও প্রাবন্ধিক খোন্দকার আশরাফ হোসেন `সোনালি কাবিন‘ সম্পর্কে তাঁর এক গদ্যে বলেছেন-
‘সোনালি কাবিন’ একটি বহুমাত্রিক কবিতা। আল মাহমুদের কাব্যখ্যাতির মূল স্তম্ভ এই কবিতাটিতে বিবিধ বৈপরীত্যের সহাবস্থান ঘটলেও বিপ্লবের ঘূর্ণায়িত পিস্টনের প্রাবল্য একে এটি ঈর্ষণীয় সংহতি দিয়েছে। প্রেম ও বিপ্লবের সপক্ষে তাঁর অনুরাগ একই উষ্ণতায় ব্যক্ত, যদিও এই দুটি প্রবনতার প্রতি তাঁর মনোভাব অতিসরল ও একরৈখিক।’
বিষণ্ন পাখির ডানায় বেঁধে দিলে প্রেমিকার ঘ্রাণ কোন একদিন পৌঁছে যাবে তার ঠিক ঠিকানায়। অথবা কোন দিন কোথাও পৌঁছিবে না কোন প্রিয়সীর কাছে। তবুও কবি লিখেন নিজ বিবেচনায়―নিজকল্পে চিরায়ত লোকগাথার স্বরে। নিজস্ব জগতের অনুপম সংলাপ; লোকজ ভাবনার সংগীতে।
‘অঘোর ঘুমের মধ্যে ছুঁয়ে গেছে মনসার কাল
লোহার বাসরে সতী কোন ফাঁকে ঢুকেছে নাগিনী,
আর কোনদিন বলো দেখবো কি নতুন সকাল?
উষ্ণতার অধীশ্বর যে গোলক ওঠে প্রতিদিনই ।
বিষের আতপে নীল প্রাণাধার করে থরো থরো
আমারে উঠিয়ে নাও হে বেহুলা, শরীরে তোমার,
প্রবল বাহুতে বেঁধে এ-গতর ধরো, সতী ধরো,’
(সনেট-০৮, সোনালি কাবিন)
কবি মজনু শাহ ‘সোনালি কাবিন’ সম্পর্কে অধুনালুপ্ত দৈনিক আজকের কাগজ এর সাহিত্য সাময়িকী সূবর্ণরেখায় এক গদ্যে বলেছেন-
‘সত্য যে, কবি আল মাহমুদের ‘সোনালী কাবিন’ যখন প্রকাশিত হলো, সেটা একটা দিক-নির্ণয়ী ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আজকের বাংলা কবিতার প্রেক্ষিতেও ঐ কাব্যের জন্য তিনি সর্বাধিক নন্দিত হন। পাঠক তাঁকে অল্পকিছু কবিতা দিয়েই চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন সেদিন। তারপর অনেক কবিতাই লিখেছেন তিনি, অনেক রকম, কিন্তু সোনালী কাবিনের সাফল্যকে পেরিয়ে যাবার মতো কবিতা আমরা আর তাঁর কাছ থেকে পাইনি।’
২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রথম ‘সোনালি কাবিন’র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের কবি ও ইংরেজী সাহিত্যের অধ্যাপক সায়ীদ আবু বকর কতৃক অনূদিত বইটি প্রকাশ করেছে I-Proclaim press । কিছু দিনের মধ্যেই সোনালি কাবিনের ইংরেজি অনুবাদ The Golden kabin’ এর ২য় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এ থেকে বুঝতে পারা যায় দেশের বাহিরের কবিতা উৎসাহি পাঠকদের কাছেও সোনালি কাবিন এর গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। সোনালি কাবিনের স্থানিকতা, ঐতিহাসিকতা, নান্দনিকতা এবং এর অন্তর্গত তাৎপর্য ও দ্যোতনা পাঠককে গত চারদশক ধরে অবিরাম আকৃষ্ট করে চলেছে। হয়তো আরো শতাব্দীর পর শতাব্দী বাংলা কবিতার আগ্রহী পাঠককে এই সোনালি কাবিন ঘোরগ্রস্থ করে রাখবে।