কবিতা কি এবং কেমন; এই প্রশ্নের উত্তর আমি কবিতার কাছেই খুঁজি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কোনটা কবিতা আর কোনটা কবিতা না সেটার বিচার করা। সেটা বিচার করতে না পারলে কার কাছে খুঁজবো! না সেই বিচারটা আমি কখনো দাড়িপাল্লা ধরে মেপে মেপে বিচার করি না। অথবা হতে পারে কখনোই বিচার করি না। মন যে শব্দের বাগানে টানে সেখানে ঢুকে যাই। নিজের মতো অথবা বাগানের শব্দের তালে তালে বিচরণ করতে থাকি। বিচার বিশ্লেষণ না করে বরং হাওয়ার গতিবেগ উপভোগ করাটাই তখন মূখ্য হয়ে ওঠে। সে জন্য ডিসিশান প্রাধান্য পায় না। মনের টানটাই প্রাধান্য পায়। সেখানে শিল্পের মাপজোখও কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। এই বিচরণ ক্ষেত্র তখন নিজস্ব গতিতে চলতে থাকে। কখনো আমি দর্শক আবার কখনো নিঃশ্চুপ সমঝদার। মাহী ফ্লোরার ‘মরিওঁম’ তেমনই একটি বিচরণ ক্ষেত্রে। যেখানে ঢুকে তার নিজস্ব হাওয়া, শব্দের টুঙটাঙ, পাখি পরিচিতি কিংবা সময় উদ্যাপন আমাকে তার মাঝে আটকে দেয়।
২৫ সংখ্যক কবিতায় তিনি বলেন,
‘আগুনকে মরিয়ম, ফুল নামে ডাকতো।
কিছু ফুল স্বাদে তুলনাহীন, কিছু ফুল গন্ধে।’
আবার ২৯ সংখ্যক কবিতায় বলেন,
‘...কেনো যে আমি ধোঁয়া ভালোবাসি!
কেনো যে আমার তৃষ্ণায় বুক ফেটে যেতে থাকে।
কেনো যে আমার আসন সরে সরে সরে যায়...’
এর উত্তর যেন ‘মরিওঁম’ই জানেন। অথবা ‘মরিওঁম’ চরিত্র নির্মাতাই বলে দেন এইসব প্রশ্নের জবাব। কথায়-কবিতায়। কিঞ্চিৎ ডুবখেলায়। কিন্তু নিশ্চিত হয়ে যেমন কিছুই বলা যায় না; শিল্পিও একটা আবছায়ায় থাকেন। কিংবা ‘মরিওঁম’ প্রদক্ষিণে আগ্রহীদের আবছায়ায় রাখতেই পছন্দ করেন। গতিপ্রবণ এক গান বাজিয়ে আড়ালে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন দর্শক হয়ে ! হয়তো তাই। অথবা কবিতার লাইনই বলে ওঠে কথার পিঠে এই কথা...
‘ এতো বেশি চেয়ে বড়ো হয়ে গেছে মরিওম।
আর একদিন চাই চাই বলতেই মৃত্যু এসে
সব গিলে খাবে, সব।’
[৩৩ সংখ্যক কবিতা।]
তারপরও কি আমরা কোনো ডিসিশানে পৌঁছতে পারি? না পারি না। মূলত ডিসিশানে পৌঁছানো কখনো কখনো উদ্দেশ্যের মধ্যেও থাকে না। আবার কখনো থাকলেও নানা চেষ্টায় পৌঁছানো সম্ভব হয় না। তবে শিল্পের ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যে পৌঁছার চেয়ে খেলাটাই অনেক সময় মূখ্য হয়। হয়তো শিল্পি তেমনই খেলতে চেয়েছেন। আর এই খেলায় দর্শক কিংবা অংশগ্রহনকারী হয়ে আমরা পরিচিত হয়েছি তার বাগানের অসংখ্য ফুল-পাখিদের সাথে। যাদের কিচিরমিচির এক ধরনের ব্যঞ্জনা তৈরি করে। ঘোরগ্রস্থ করে। তেমন ঘোরগ্রস্থতা যেন আরো বাড়তে থাকে যখন আমরা কবির এইসব ছায়াচিন্তার সাথে পরিচিত হই।
‘ ...চোখের মইধ্যে ডাহুক
পাখির মতোন ঠুকরাইতে থাকে। কোথায় যে এতো এতো
লাল পিঁপড়া থাকে। কোথায় যে এতো এতা
লাল পিঁপড়া থাকে। আমিারে ঘিরা ধরে। কামড়ায়।
আমি অন্ধ হইয়া যাই ওরা চাইয়া থাকে।
আমি আলোর ভিতর কেমনে এতো অন্ধকার হইলাম!’
[ ৩৫ সংখ্যক কবিতা ]
তারপর? কোথায় যাত্রা শুরু হয় মরিওঁমের? সেইসব কথা আমরা যেন দেখতে পাই ! কিছুই আবিষ্কৃত হয় না ধবধবে শাদায়। কেবল অন্ধকারে আটকে থাকে একজন মরিওঁম। হাজারজন মরিওঁম।
শিল্পি নিজেই তার সৃষ্টির কাছে প্রশ্ন করেন।
‘মরিওম, যে মানুষ কোথাও থাকেনা তার কি আর
কান্না পাবেনা কোনোদিন?’
[ ৪১ সংখ্যক কবিতা ]
কবি মাহী ফ্লোরার এই প্রশ্ন আমাকে মনে করিয়ে দেয় আসলেই প্রশ্নের কোনো শেষ নেই। প্রশ্নের পর প্রশ্ন আর জীবনের পর জীবন গেঁথে থাকে সময়ের সাথে। আলো-অন্ধকারের সাথে। আর সেখানে মরিওঁম? সময়ের শৈশব-কৈশোর ! অথবা নিমগ্ন ছায়া !
তবে ‘মরিওঁম’ সিরিজ কবিতার বইয়ের ৪৪,৪৫ শিরোনামের কবিতার মতো কিছু কবিতা অন্যান্য কবিতাদের সাথে কিছুটা বেমানান লেগেছে। বইয়ের অন্য কবিতাগুলো পাঠে যে প্রত্যাশা; আবেদন তৈরি হয়েছিলো কবি আরেকটু সচেতন হলে হয়তো সেটির ধারাবাহিকতা থাকতো। তারপরও এই ডুবসাঁতার। ‘মরিওম মানেই একটি শীত প্রধান দেশ।’ গেঁথে থাকলো মন ও মননে।
শুভ কামনা কবি মাহী ফ্লোরা। শুভ কামনা ‘মরিওঁম’।