‘একটি ট্রেন প্রতিদিন হুইসেল বাজিয়ে  
প্রতিদিন হুইসেল বাজিয়ে চলে যায়  
হুইসেলের শব্দ শোনে প্রতিদিন অনড় দাঁড়িয়ে থাকি  
প্রতিদিন অনড় দাঁড়িয়ে থাকি শস্যখেতে’  
[নিরুদ্দেশ যাত্রীর খোঁজে]
অনিকেত শামীম কবি ও সম্পাদক। প্রথমত এই নামের সাথে আমার পরিচয় ঘটে সম্পাদক হিসেবে। কিন্তু সম্পাদক হিসেবে তার সাথে পরিচয় হলেও তার কবিতার সাথেও পরিচয় প্রায় এক যুগের। ট্রেনের কুঝিক কুঝিক ঝিক তালে এগিয়ে চলছে তার এই কাব্য যাত্রা। নিঃসঙ্গ পথিকের মতো হুইসেল বাজিয়ে পথকে জাগিয়ে রাখছেণ তার নিজস্ব ডাকে, নিজস্ব ভাষায়। সেই ডাক কখনো মুগ্ধতায় আবার কখনো গভীর ভাবের দেশে। কবি যখন বলেন—
‘আমার ডানপাশে চেয়ার
অথবা চেয়ারের বামপাশে আমি  
এটি আমাদের আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে অথবা না-ও পারে  
মূলকথা হচ্ছে আমি এবং আমার চেয়ারের অস্তিত্ব...’
[আলোচনা সভা  ]
তখন আমাদের মনে এক ধরণের অনুরণন তৈরি হয়। সেই অনুরণন থেকে কতিপয় ধ্বণি চিন্তার ব্যালকেিনত ছড়িয়ে পরে। তারা আমাদেও চারপাশে প্রতিনিয়ত চলতে থাকা আড়াল জগতের বয়ানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। প্রতিনিয়ত যেসব সমঝোতার ব্যারিকেটে আটকে পওে যাচ্ছি আমরা ও আমাদেও সমাজ সেই ব্যারিকেট থেকে বের হয়ে নিজস্ব উচ্চারণের কথাও হয়তো একদিন ভুলে যাবো। আমাদেরও কথা বরতে হবে অন্যেও ভাষায়। যে ভাষা আমার না সেই ভাষার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে হবে। বেঁচে থাকতে হবে অন্যের জীবনে।
মানুষের ভাষায় কথা বরা জীবন ও কলম কবি জীবনকে যেমন আলোড়িত করে তেমন নিজের বাজিয়ে দেখা ইচ্ছে হয়তো আরো বাজাতে শেখায়। তখন কবিকে বলতে হয় জীবনের যন্ত্রণা।
‘কোথায় কতদূর যেতে পারে পথ ও পথিক। তারা একে অপরের ভাই ও বোন। ক্রমশ হাত ধরে হাঁটছে।  
দূরাগত শব্দের ধ্বনি ডাকছে তোমাকে আমাকে’
[দূরাগত শব্দের ধ্বনি]  
অদৃশ্যের ইশারা হয়তো প্রতিটি মানুষকেই প্রতিনিয়ত ডেকে যায়। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়ই মানুষে সেই ডাকে সাড়া দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের কাছ থেকে আমরা হয়তো কোথাও যেতে পারি না। বারবার নিজের কাছেই ফিরে আসি। নিজের মধ্যেই ডুবে থাকি। দূরের ধ্বণির কাছে আত্মাকে সপে দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি ঘটনার পরিক্রমা দেখতে। কখনো এমন লিপ্সা নিয়ে অকপটে নিজেকে হারিয়ে ফেলার ইচ্ছাও জাগে।
‘এসো, মুখোমুখি হই। হিসেব-নিকেশ
বড়ো জটিল প্রক্রিয়া। ইরেজার দিয়ে
মুছে ফেললেও দাগ থেকে যায়, বরং
সামনাসামনি হওয়াই ভালো পন্থা। ’
[সংশয় ]

অনিকেত শামীম ও তার কবিতারা কবিতার পথে পথে বিছিয়ে রেখেছেন অদৃশ্য মায়ার ছায়া। পাঠক তার কবিতার সীমায় পৌঁছে গেলে সেই ছায়ার মোহনীয়তায় মুগ্ধ হয়ে আরো গবীর পাঠের দিকে এগিয়ে যাবেন। তার ভিন্ন ভিন্ন বিষায়াবরীর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন শব্দের দ্যোতনা আগ্রহী পাঠককে কবিতার জগতে পাঠকে ভ্রমণে সাহায্য করে। যেখান থেকে পাঠক নিয়ে নিতে পারেন তার কাব্য ভাবনার গভীরতম ফসল। তখন তিনি বলেন-
‘একাকী ভাসানের দিকে গেলে ফেরে না চাকা...’
[ফিরে আসা কবিতা]
আবার যখন সেই আগ্রহ পড়ুয়াদের মধ্যে অনুরণন তোলে তখন কবিও তার কবিতার মধ্যে ছড়িয়ে দেন এক উঠোন। সেই উঠনে পাঠক কবিতা ভাবনার সুরতে উড়তে থাকা তুলো নিয়ে নিজের মতো করেই নিজের মধ্যে খেলতে পারেন । কিন্তু তারপরও তিনি নিজের মধ্যে নিজে খেলে যান আগন খেলা। যে খালে কবিতাকেও জ্বালিয়ে রাখে আর সাথে সাথে পাঠকের তীব্রতাকেও জ্বালিয়ে রাখে অনেক সময়-
পোড়াতে পোড়াতে কতটুকু জ্বালাবে তুমি  
আমি তো পুড়ে পুড়ে বিষনীল ছাই।  
[অনির্বাণ দাহ]
প্রকৃতি প্রেম ও মানুষ বিষয়ক অনু-ভাবনার মধ্যে অনিকেত শামীমের কবিতারা দোল খায়। সেখানে কবি মানস বলে যায় তার একান্ত অভিব্যক্তি। তিনি তার কবিতায় বলেন-
‘কবিও মানুষ বটে, অন্যরকম
ভেঙে গড়ে  
গড়ে ভেঙে
কবি তৈরি করে শ্রেষ্ঠতম শিল্প।  

কবির সাথে গড়ো সখ্য
পাবে প্রাণ
প্রেম  
দুঃখ
জীবনের ব্যাকরণ’
[ ঈশ্বর, মানুষ ও কবি]
আবার যখন ‘সংহতি’ কবিতায় তিনি বলেন অন্ত:চিন্তার বিাদ থেকে বেরিয়ে একসাথে কর্মেও সাড়িতে দাঁড়াতে তখন চোকের আড়ালে আরেক চোখ আমাকে নতুন কিছু দেখতে, ভাবতে শেখায়।
‘এইতো বাড়িয়েছি হাত  
সমস্ত ভয়, দ্বিধা-দ্বন্ধ্ব ঝেড়ে বাড়ালাম হাত
কাঁপাতে কাঁপাতে তুমিও বাড়ালে

পৃথিবীর সমস্ত যুদ্ধের আয়োজন থেমে গেলো।  

আমরা ঘোষণা করলাম  
শান্তি  
দৃঢ়বন্ধনে চুম্বন এঁকে ঘোষিত হলো  
সংহতি’
কবি অনিকেত শামীম তার কবিতার সাথে সাথে দেশের একটি সেরা কাগজ নিয়মিত সম্পাদনা করেছেন দীর্ঘদিন ধরেই। যে কাগজের প্রতিটি সংখ্যায় বাংলাদেশের লিটলম্যাগ জগতে অন্য অনেক কাগজ থেকেই উজ্জ্বল হয়ে নিজস্ব অভিধায় দাঁড়িয়ে আছে। সেই পরিশ্রমের মাধ্যমে ন্ব্ই থেকে প্রতিটি দশকের কবিদেও প্রিয় চারনভ’মিতে পরিণত হয়েছে ‘লোক’ কাগজটি। যেটি অনিকেত শামীম সম্পাদনা করেন।
এই সম্পাদনায় তার দূরদৃষ্টি আগ্রহী পাঠকদের কাছে সব সময়ই ভালো কিছু পৌঁছে দেয়। ২০০৯ সালের দিকে যখন প্রথম দশক শেষও হয়নি তখন তিনি একটি পরিকল্পনা করে ২০১০ প্রকাশ করলেন দ্বিতীয় দশকের সম্ভাবনাময় ৩৯ তরুণদের নিয়ে একটি সাহসী সংকলন। তার সম্পাদনার দূরদৃষ্টি এভাবেই প্রমাণিত হয় যে সেই সংকলনের অর্ন্তভুক্ত অনেকইে এখন খুব ভালোভাবেই লিখছেন। একটা দশক শুরুর আগে এভাবে নতুনদের উৎসাহিত করে পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজিেট আমার জানা মনে বাংলাদেশের কোনো কাগজ এভাবে করার সাহস পায়নি।
পরিশেষে সম্পাদক অনিকেত শামীম ও কবি অনিকেত শামীম দুজনকেই আমি সফল বলতে চাই। তার ব্যক্তি জীবন সংসার, সমাজ সব কিছু গুছিয়ে যিনি লোক’র মতো একম একটি কাগজ নিয়মিত প্রকাশ করছেন। আবার সাথে সাথে নিজের কাব্য চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সেটা অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনিকেত শামীমের কাছে এটাই প্রত্যাশা সাহসী ও প্রতিশ্রুতিশীল কাগজ লোক’ নিয়মিত প্রকাশের পাশাপাশি তার কাব্য চর্চা আরো বেগবান হোক। স্যালুট সসম্পাদক অনিকেত শামীম, স্যালুট কবি অনিকেত শামীম। আপনাকে হাঁটতে দেখতে চাই আরো অনেক দূর...