সাংবাদিক ও কবি আবিদুর রহমান রহমানকে জানলাম ১৯৭৬ সালের দিকে। আমি ইউনির্ভাসিটির একটি যৌথ সংকলন করছি। সেই সংকলনে একটি বিজ্ঞাপন আনতে তার টয়েনবি সার্কুলার রোড, আমিন কোর্টের পিছনের অফিসে যাই। তখন তিনি আমাকে দেখে খুব আতিথেয়তা করলেন। সেই সাথে অনেক সময় নিয়ে গল্প করলেন। বললেন তোমরাই জাতির ভবিষ্যৎ। পড়াশুনায় মনযোগী হও। তারপর সেই সংকলনে একটা বিজ্ঞাপন দিলেন নিপ্পন গ্রুপের।  তারপর অনেক কথা বলতে হয়। অন্য অনেকের মত আমিও তার বহুমুখী প্রতিভার কথা জানি। তিনি কাউকে কখনো খালি হাতে ফিরাননি। অনেককেই চাকুরী দিয়েছেন। অনেক কবি, সাংবাদিক তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। তার প্রতিষ্ঠান নিপ্পন গ্রুপ ও স্কাইওয়ে সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে আজকে হাজার হাজার লোক কর্মরত।

১৯৩৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারী হবিগঞ্জের মইছপুর মামার বাড়ীতে জন্ম হলেও পিতৃনিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেড়ে ওঠেন। পড়াশুনা করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ঢাকায়। কর্মজীবনের প্রথমে তিনি ছাত্র থাকাকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের শিক্ষকতা করেছেন। তিনি মেধাবী ছিলেন বিধায় কলেজ কর্তৃপক্ষ কলেজের আইন পরিবর্তন করে তাকে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেন। কতটা মেধাবী হলে ছাত্র অবস্থায় একই কলেজে শিক্ষক হয় সেটা সহজেই বুঝা যায়। তিনি ঢাকা সিটি নাইট কলেজেও শিক্ষকতা করেছেন। তিনি শিক্ষক হিসাবেও সফল। পড়াশুনা শেষে তিনি প্রথম কর্মজীবন শুরু করেন পাকিস্তানের পিকিং ব্যাংকে। তখন তিনি ঋণ দিয়ে শিল্প বিস্তারে অবদান রাখেন।

তিনি একজন কবি, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার, প্রযোজক, সাংবাদিক, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী ও রবীন্দ্র গবেষক। সাংবাদিক হিসাবে তার ‘দি পিপল’ ও ‘দৈনিক গণবাংলা’, এদেশের আপামর জনসাধারণের অধিকারের কথা তুলে ধরেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে তিনি এদেশের গণ মানুষের কথা স্বাধীনতা কথা তার পত্রিকায় নির্দ্বিধায় প্রকাশ করেছেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাকে তার পত্রিকায় Mujib Declares Independence, A New Nation Born in Bangladesh Withdraw Alien Barbarous Army, এবং পাক বাহিনীর গুলিতে তিন বাংলাদেশী নিহত, বাঙালি অস্ত্র ধরো ইত্যাদি শিরোনামে তুলে ধরেছেন। ‘দি পিপল’ পত্রিকায়  নিউজ ছাপার পর পাকিস্তান সরকার তাকে গ্রেফতার করার জন্য রাও ফরমান আলী বঙ্গবন্ধুকে ফোন করেছেন। আবিদুর রহমানকে মৃত্যুর হুমকি দেয়া হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হুসিয়ারী উচ্চারণ করায় তাকে গ্রেফতার করেনি। এই জের তোলে সেই ২৫ শে মার্চের কালো রাতে। তার সেই দি পিপল পত্রিকার অফিসে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ভবন সহ উড়িয়ে দেয়া হয়। ভাগ্য যে তিনি সেদিন পত্রিকা অফিসে ছিলেন না। সেই হামলায় ৬জন স্টাফ প্রাণ হারায়। পাকিস্তান আর্মি প্রথম ২৬ জুন, ১৯৭১ সালে যে মামলা করে ৫ জনের বিরুদ্ধে তাদের মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন, আব্দুল মান্নান, তোফায়েল আহমেদ এই চারজন রাজনৈতিক নেতা আর সাংবাদিক হিসাবে একমাত্র আবিদুর রহমানের নামে মামলা হয়। প্রত্যেক আসামীকে তাদের অনুপস্থিতিতে ৫০ ভাগ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত সহ ১৪ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়। পরে আবিদুর রহমান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কলকাতার ‘লোক সেবক’ অফিস থেকে পত্রিকা দুটি প্রকাশ করেন। তার পত্রিকায় বিশ্বের অনেক নামকরা সাংবাদিকরা কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর আবিদুর রহমানের সাথে একান্ত ঘনিষ্ঠতা ছিলো। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আবিদুর রহমান গান লিখেছেন বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস ১০ জানুয়ারী ১৯৭২ সালে। ‘বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায় তুমি আজ, ঘরে ঘরে এত খুশি তাই, কী ভাল তোমাকে বাসি আমরা, বল কী করে বুঝাই”  এই গান শুনে বঙ্গবন্ধু চোখের জল ফেলেছেন। কাজেই বঙ্গবন্ধুর কত কাছের মানুষ ছিলেন আবিদুর রহমান তা সহজেই অনুমেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে দি পিপল পত্রিকার অবদান অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ২২ আগষ্ট, ১৯৭৫ সালে তাকে ও তোফায়েল আহমেদকে গ্রেফতার করে ময়মনসিংহ কারাগারে রাখা হয়। তিনি ১০ মাস কারা ভোগের পর মুক্তি পেয়ে তিনি প্রথমে ইউরোপে পরে অষ্ট্রিয়া এবং শেষে লন্ডন চলে যান। এ দুটি পত্রিকা ছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন ১৯৫৬-৫৭ সালে ‘দি লরেল’, লন্ডন থেকে ‘দি ওয়ার্ল্ড টাইমস’ ও জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দেশে ফিরে ‘দি ইলাস্ট্রেটেড নিউজ উইকলি’।

তিনি বহুমাত্রিক এক ব্যক্তিত্ব হিসাবে নিপ্পন গ্রুপ, গোলহিল্ড টোবাকো, গোল্ডহিল কেমিক্যাল ও স্কাইওয়ে গ্রুপের কর্ণধার ছিলেন। তার অফিস ছিলো রোমানীয়া, সৌদি আরব, লন্ডন ও ভারত।  তিনিই প্রথম জাপান থেকে গাড়ী আমদানী করেন। জহুরুল ইসলামের সাথে তিনি ইসলাম গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন। নাভানা ও ইস্টার্ণ হাউজিং এবং ব্যক্তি জহুরুল ইসলাম তারই সৃষ্টি। লন্ডনে তিনি গড়ে তোলেন ‘ক্রিমজোন এন্টারপ্রাইজ’ গার্মেন্টস। জিয়া ফার্টিলাইজার, গ্রেটার ঢাকা ইলেকট্রিফিকেশন, শিকলবাহা ও বাঘাবাড়ি পাওয়ার ষ্টেশন তারই অবদান। একজন শিল্প সংস্কৃতিমনা মানুষ আবার ব্যবসায়ী। কিন্তু তিনি ব্যবসায়ী হিসাবেও সফল হয়েছেন।

টিভি নাটক লিখেছেন। তার নাটক-ক্রস কালেকশন, সমীকরণ, আমি কার কে আমার, ছায়া এবং সাত পর্বের ধারাবাহিক নানা রঙের দিনগুলি বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে প্রচারিত হয়। গান লিখেছেন। সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। তার গানে কণ্ঠ দিয়েছে ভারতীয় নামকরা সব শিল্পীরা। বাংলা গানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং বাংলাদেশের সুবীর নন্দী ও সামিনা নবী আর ইংরেজী গানে ভারতের শিল্পী উষা উত্থুপ কণ্ঠ দিয়েছেন। তিনি নিজেও সুরকার ছিলেন। তিনি ৬০০ বাংলা গান, ৮০০ হিন্দি ও হিন্দীর ছবির জন্য হিন্দী বাংলা মিশেলে গান লিখেছেন। ইংরেজীতে গান লিখেছেন ২৫০টি এই গানের সংকলন-সঙ্স অব সৌল। তিনি ৩৫০টি আধুনিক বাংলা গানের ‘কংগ্রাচুলেশন মোবাইল’ ও ১৫০টি লোক গানের ‘ভালো আমি বাসুম কারে’ নামক শিরোনামে মোট ৫০০টি গানের দুটি বই রচনা করেছেন। কলকাতার ‘হিজ মাষ্টারস ভয়েস’ ও ‘ইএমআই’, ‘ভালোবাসার ভেলিয়াম’ ও ‘রমলা তোমার হৃদয়ের মিনিবাসে’ ইত্যাদি আধুনিক বাংলা গানের লং প্লে রেকর্ড এবং বৃটিশ রাইটার্স গিল্ড-এর সর্বপ্রথম এশিয়ান সদস্য হিসাবে ‘ব্লাষ্ট অফ’ নামে ১২টি ইংরেজী গানের লং প্লে এ্যালবাম প্রকাশ করে। বিটিবিতে উচ্চ গ্রেড-ক এর সুরকার ছিলেন।

একজন চলচ্চিত্রকার হিসাবে তিনি তার ‘নিকো ফিল্ম’ নামে প্রযোজনা সংস্থা থেকে তখনকার নামকরা শিল্পীদের নিয়ে প্রযোজনা করেন ‘আকাশ আর মাটি’ চলচ্চিত্রটি। তার প্রযোজনা সংস্থায় কবরী, আনোয়ার হোসেন, রোজি সামাদ, নাদিম  সহ আরো অনেকে অভিনয় করেছেন। তার আবিস্কার কলকাতার নায়িকা শতাব্দী রায় ও অর্পণা সেন।

তিনি একজন রবীন্দ্র গবেষক। রবীন্দ্রনাথের বেশ কটি কবিতা তিনি ইংরেজীতে অনুবাদ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের কথা প্রায় ১৫টি গানে তুলে ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথের বলাকা সহ অনেক বড় বড় কবিতা তিনি মুখস্থ বলতে পারতেন। রবীন্দ্রনাথের কৃষি ব্যাংকের ধারণাটি তিনি বঙ্গবন্ধুকে কৃষি উন্নয়নে কাজে লাগানোর জন্য একটি স্বতন্ত্র সংস্থা প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দিয়েছেন। আজকের বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠার পিছনে আবিদুর রহমানের অবদান রয়েছে। তার রোমান্টিক প্রেমের উপন্যাস ১০৭৬ পৃষ্ঠার বই ‘নীল কমল’ একটি তথ্য ভিত্তিক বই। এটি প্রকাশিত হয় অমর একুশে বইমেলা ২০১০ সালে। তার অন্যান্য উপন্যাস গুলো হচ্ছে- রূপসী, নীরার প্রথম প্রেম, দুই চোখে দুই জলের ধারা, ভূবনের ঘাটে ঘাটে, এবং ইংরেজী উপন্যাস Destiny Vs Destiny। দেশ কর্তৃক তার লেখা ‘বিপন্ন বলয়’ কাব্যগ্রন্থটি পশ্চিম বাংলার ৩টি সেরা কাব্যগ্রন্থের মধ্যে অন্যতম বিবেচিত হয়।

আবিদুর রহমানের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দেশাত্ববোধ ও প্রেমের রোমান্টিকতা ফুটে ওঠেছে। কবিতায় তিনি বিজ্ঞান সমন্বয় করেছেন। তার কবিতায় নতুন শব্দের চাতুর্য রয়েছে। এসব বিবেচনায় তিনি অগ্রসর চিন্তার ধারক বাহক ছিলেন। কবিতা সহজ সরল ও প্রাঞ্চল ভাষায় লেখা। সাবলিল ভাবে উপস্থাপন করেছেন। আবিদুর রহমানের কাব্যগ্রন্থ বিপন্ন বলয় গ্রন্থটি ১৯৭৩ সালে কলকাতার মন্ডল বুক হাউজ থেকে প্রকাশিত হয়। ‘বিপন্ন বলয়’ শিরোনামের কবিতায় কবি এক আলো আঁধারির ঘোর সৃষ্টি করেছেন। মা, মাটি ও রোমান্টিক প্রেমের কথা মালায় তিনি বর্ণনা করেছেন। ভয় নেই বলে যাকে সান্তনা দিয়েছেন তার আবার ভয়। কবিতায় বলেছেন -

হে ঈশ্বর তবু কেন দানা দানা যন্ত্রণার গোটা
বার বার ফুটে ওঠে তুলতুলে মিহি দেহে তার ?
আমি তো সাপের মতো যে বিষ ঢেলেছি দাঁতে
নিজে তাকে শুষে টেনে নিয়েছি আবার। (বিপন্ন বলয়)

কবি তার কবিতায় বিজ্ঞান সমন্বয় করেছেন। যেমন-একটু উত্তাপের জন্য, গভীর অন্ধকারেই, বুঝতে পারিনি তখন, একটি করে লাল ফোটা, কতবার সাদা কফিনে, স্বপ্নের নারীকে, আমরা বাদুড় হলে, আদিম কচ্ছপ, একখানা কবিতার বই, ক্রেমলিন-১৯৭২ ইত্যাদি কবিতায় বিজ্ঞানের সমন্বয় হয়েছে খুব সরল বাচ্যতায়। তিনি তার গভীর অন্ধকারে কবিতায় বিজ্ঞান সমন্বয় করেছেন -
তোমরা সবাই নাকি
এ অন্ধকারকে বড়ো ভয় কর শুনি
অথচ আশ্চর্য আমি এই গভীর অন্ধকারেই
খুঁজে পাই
হাজার হাজার ওয়াটের
বড়ো বড়ো আলোর গোলক
আর সেই প্রখর রশ্মিতে
দিনের আলোর চেয়ে
আরো বেশি স্পষ্টতর দেখি তার মুখ। (বিপন্ন বলয়)
আবার ‘বুঝতে পারিনি তখন’ এই কবিতায় বলেছেন -

চেতনার উত্তপ্ত উনুনে আমি সেঁকে নিয়ে হাত
যখন রেখেছি তোমার মসৃণ দুই গানে
লজ্জাবতী পাতার মতো
ঢেকে ফেলেছো নিজের মুখ নিজের দুহাতে
.................................
...............................
আমার রক্তের লোহিত সাগর যখন টগবগে ফুটছে
ভিসুভিয়াসের গলিত লাভার ফারেনহিটে
তোমার নরম নাতিশীতোষ্ণ শরীরটা তখন
হিমালয়ে চূড়ায় জমাট বাঁধা বরফের মতো শক্ত, ঠান্ডা, শীতল। (বিপন্ন বলয়)

যেহেতু তিনি রবীন্দ্র গবেষক ছিলেন অনেক কবিতার বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথের কথাটা এসেছে। বিশেষ করে তাজমহল, আছেন রবীন্দ্রনাথ, কৈশোরের নীর সরোবরে ইত্যাদি। সেই মেয়েটি কবিতায় নিজের শৈশব, কৈশোর স্মৃতি বিজড়িত স্থান ছেড়ে দেশ বিভত্তি দূরে ঠেলে দিলো, ভাবনার ভাগ্য তাকে নিয়ে যায় সুদূর দেশে। সেখানেও তার মনের মধ্যে জেগে ওঠে শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতি। তাই কবি বলেছেন-
হঠাৎ মনে/ পড়ছে কেনো ? পুকুর ঘাটের/ কাদা মাটি/ কেওড়া তলার / টিয়াপাখি / পেয়ারা গাছ / কাঠবেড়ালী/ মিনু মাসী/ রাঙা দিদি/ সকলকে আজ/ ইউরোপের / পশ হোটেলে/ নিজের ঘরে/ দেখছে কেন ? (বিপন্ন বলয়)

-এই কবিতায় কবি নারীদের সুখ দুঃখ জীবনের কথা তুলে ধরেছেন। মেয়েদের স্থানান্তরিত হবার সেই আদি নিয়মের কথা। বলেছেন। আবার কবি চেকোশ্লোভাকিয়ার নারী কবিতাতেও নারীদের কথা বলেছেন। কবিকে মৃত্যু চিন্তাও গ্রাস করেছিলো। যা তার কী আশ্চর্য ক্লোরোফর্ম কবিতায় ফুটে ওঠেছে। কবির প্রেমের কথা প্রকাশ পেয়েছে অসংখ্য কবিতায় তবে ম্যাকেসাকে মনে পড়ে, পিকাডিলি সার্কাসের মোড়ে, আরিভা দের্চি রোমা, সুন্দরী সহযাত্রিনী, মারলিন মনরো’র প্রতি উল্লেখ যোগ্য। তিনি আরিভা দের্চি রোমা কবিতায় তার দুরন্ত প্রেমের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন-
............................
তোমারই চোখের দুই ফোটা অশ্রুর উত্তাপে
আমি এখন পুড়ে যাচ্ছি সিলভি
আবার আসব ফিরে
শুধু তোমাকে জানিয়ে যাবার জন্যে
তোমার কথা মনে করে
কেন জানি আমার দুটি চোখের কোণেও
দুই ফোটা উষ্ণ জল জমে উঠেছে এখন। (বিপন্ন বলয়)

আমরা বাদুড় হলে কবিতায় মানুষের জীবন যাপনের গল্প এঁকেছেন। বলেছেন -
.......................
আমরা বাদুড় হলে কী ভালো হত
কানের রাডারে বলের গতি বুঝে বুঝে
সূর্য ওঠার আগে রাতের অন্ধকারেই
খেলা সেরে নিতে পারতাম প্রতিরোজ
কেউ বুঝত না কাকে ঠকালাম
কিংবা কোথায় ফাউল করলাম। (বিপন্ন বলয়)

কবির ‘দাদা ভাই তোমার নাতি’, ‘ল্যাংড়া আমের ছোট্ট চারাটা’ কবিতায় কবির শৈশবের চিত্র ফুটে ওঠেছে। ল্যাংড়া আমের ছোট্ট চারাটা কবিতায় কবি বলেছেন -
..........................
দাদাভাই আজ আমি অনেক বড়ো হয়েছি
তবু কোথাও নির্জনে গিয়ে
মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদবার
বড়ো প্রয়োজন আমার।
অথচ তোমার প্রিয় সেই
ল্যাংড়া আমের গাছটার বাকলে আজ
বার্ধক্যের হেঁজা -কাটা, আর
লাল কালো বড়ো বড়ো পিঁপড়ার ভিড়। (বিপন্ন বলয়)

কবির কবিতায় দেশাত্মবোধ জাগ্রত হয়েছে  বেশীর ভাগ কবিতাতেই। ‘ক্রেমলিন, ১৯৭২’, ও ‘শরীফের মাকে’ জনৈক মুক্তিযোদ্ধার ইতিকথা ইত্যাদি কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের কথা বর্ণনা করেছেন। ‘শরীফের মাকে’ এই কবিতায় কবি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া ছেলের জন্য কত আশা নিয়ে পথ চেয়ে বসে থাকেন রাত বিরাতে। ছেলের স্মৃতি নিয়ে কতশত স্বপ্ন দেখেন। ছেলেকে বাড়ী আসার জন্য চিঠি লিখেন। ছেলের জন্য মুরি মুরকি, খেজুর গুড়ের পায়েস, নারকেলে নাড়– বানিয়ে রাখেন। ছেলে বড় হবে, মানুষ হবে চাকুরী করবে তারপর . ..। সে ছেলেটি যখন যুদ্ধে গেলো মারা তখন তার মাকে সান্তনা দিতে এসে তার বন্ধুদের সেই গল্পকথা। আবার জনৈক মুক্তিযোদ্ধার ইতিকথা কবিতায় তিনি আব্বাসের মধ্যবিত্ত সংসারে গল্প কথা এবং যুদ্ধে যাবার ইতিহাস তুলে ধরেছেন। একমাত্র সম্বল এবং পরিবারের বড় সন্তান যার আরো ভাই বোনদের ভবিষ্যত তারই উপর নির্ভরশীল সে ভীতু এক যুবকের মুক্তিযুদ্ধে যাবার যে সাহসিকতা এবং তার মাকে তার সন্তান হারানোর কথা জানানোর বেদনা এত নিখুঁত ভাবে ফুটে ওঠেছে। এখানে কবি আবিদুর রহমানের কাব্যের সারল্য ও সার্থকতা।

মুক্তিযুদ্ধে বহু নারী সম্ভ্রম হারিয়েছে। তার কোনো হিসাব নেই। বীরাঙ্গনা হয়েছে কতো। সেই নারীদের নিয়ে কবি লিখেছেন তার গান ‘হরিণের মত তার’ গান কবিতায় -
........................
একদিন এ মেয়ের জীবনে হঠাৎ
নেমে এল এক কাল রাত
বর্বর মিলিটারী পশু এসে হিংস্র থাবায়
লুট করে নিয়ে গেল
তার জীবনের সব গৌরব আর সম্পদ হায়!
কত আশা ছিল এ জীবনে তার
কাউকে সে ভালবেসে
বাঁধবে যে ঘর শেষে
কেন স্বপ্ন সাধ তার
ভেঙ্গে হল চুরমার
কেউ বলতে পার কি ? (বিপন্ন বলয়)

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গানে লিখেছেন ফিরে এলে গান কবিতায় -
......................
সারাটা জীবন তুমি
নিজে শুধু
জেলে জেলে থাকলে
আর তব স্বপ্নের
সুখী এক বাংলার
ছবি শুধু আঁকলে
তোমার নিজের সুখ সম্ভার
কিছু আর দেখলে না তাই। (বিপন্ন বলয়)

মুক্তিযুদ্ধে তার আরো গানের মধ্যে বাংলার দুর্জয় জনতা, ওরা দুটি পাখির মত, মুক্তিযুদ্ধের গান বুদ্ধিজীবি হত্যার এ রাত, এবং ‘মিশে গেল কত নাম’ গানে তিনি যুদ্ধ দিনের কথা বলেছেন। ‘মিশে গেল কত নাম’ গানে বলেছেন -
.....................
ঘূর্নির ঝড়ে কত সাগরের ঢেউ
উঠে মিশে যায় তার হিসাব কি কেউ
চিরকার লিখে রাখ বল
কভু ইতিহাসে ? (বিপন্ন বলয়)

কবি আবিদুর রহমান ছাত্রজীবন থেকেই বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের ডিবেটিং সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা স¤পাদক। ন্যাশনাল ডিবেটিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। বিভিন্ন সভা, সেমিনার ও টকশোতে সংকট মুহূর্তে দেশের মানুষকে তিনি আজীবন দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। কর্মজীবনে মানুষের উপকারে তিনি সবর্দাই সচেষ্ট ছিলেন। একজন মানুষের এত গুণ কোনটা রেখে কোনটাতে তিনি সফল ? এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় কবি আবিদুর রহমান সবটাতেই সফল একজন মানুষ।