কবি খলিলুর রহমান। কবিতার পাতায় চারশো কবিতার আয়োজক। “শেষ আয়োজন” শেষ করেছেন চারশোতম দিয়ে-আজই। একটু পিছনে তাকাতে চাই- নিয়ে যেতে চাই আসরের সবাইকে তার আর একটি কবিতার পাতায়।
কবিতাটির নাম “ পৃথিবীর নাগরিকত্বের দরখাস্ত।”
পৃথিবীর বুক থেকে যাত্রা শুরু-পৃথিবীতে বসবাসকারী এক নামহীন গোত্রহীন মানুষের- শুধুমাত্র মানুষ প্রজাতির এক সদস্যের-দ্রুতগতির যানে চড়ে- অনেককাল আগে, হাজার বছর বা তারও আগে। ব্রহ্মান্ডের মহাশূন্যের উদ্দেশে। গ্রহ-তারা-নক্ষত্রের দেশে। হাজার বছর ধরে-হাজার ছায়াপথের ছায়ায় ছায়ায় ঘুরতে ঘুরতে হাজির-মনোমুগ্ধকর সবুজে আর বর্ণালী ফুলের দেশে। বলা বাহুল্য,হাজার বছর ধরে পথ চলা মানুষটির চেতনা বিলুপ্তপ্রায়। তবুও, তার চেতনা আবারো জাগরিত হলো-বিস্মৃত চেতনা ফিরে পেলো নতুন করে- তার চেনা পৃথিবীর রূপ-রস আর গন্ধে। সে আবার ঢুকতে চাইলো তার নিজের পৃথিবীতে। হায়রে! অজ্ঞ! মূর্খ! তুমি কি জানো না? পৃথিবীর মানুষরা আর একই প্রজাতির নেই আজ। বাঘ- হরিণ- খরগোশ- পাখী তাদের প্রজাতি একটাই। কিন্তু, বুদ্ধিমান মানুষ- স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ-ভাগ করেছে নিজেকে- টুকরো করেছে সাধের এই পৃথিবীটাকে ধর্মে- বর্ণে- জাতিতে। শুধু মানুষ- এই পরিচয় তাই আজ আর যথেষ্ট নয়। পৃথিবীর বুকে আবারও আসতে হলে তাই ‘শুধু মানুষ’ এই পরিচয়ে আর আসা যাবে না। তাকে যে প্রমাণ দিতে হবে কোন জনগোষ্ঠীর সে? তার জাতি-ধর্ম- বর্ণ না জানলে তাকে পৃথিবীতে ঢুকতে দেওয়া হবে না। পৃথিবীটা যে আজ ভাগ হয়েছে ছোটো ছোটো আরও অসংখ্য পৃথিবীতে। হাজার বছরের পুরোনো মানুষটা জানে না এক একটা দলের মানুষের জন্যে নির্দিষ্ট করা হয়েছে এক এক একটা নির্দিষ্ট খোপ।সীমান্তরক্ষীরা তাকে ধরিয়েছে একটি আবেদনপত্র। আর তাতে তাকে বলতে হবে তার জাতি ধর্ম আর বর্ণের কথা। শুধু মানুষের পরিচয়ে তাই তার দরখাস্ত পড়ে রইলো ‘স্বজন-জামিনদারের’ অভাবে।
একটা সামান্য দরখাস্ত- একটাই আবেদন প্রশ্ন আনল অনেক। বিশ্ব আজ বিষিয়ে গেছে। মানবিকতা- মনুষ্যত্ব শব্দটি কালো অক্ষরের পাতাতেই পড়ে আছে কেবল। গোষ্ঠীদন্দ্বে দীর্ণ আজ গোটা পৃথিবীটাই। শক্তিশালী অশক্তকে প্রতিদিন- প্রতিনিয়ত “আগুনের ফসল” দিয়ে “উচ্ছেদন যজ্ঞে” আহুতি দিচ্ছে।
“আমি এখন জনশূন্য বিরানভূমিতে পৃথিবীর সীমান্তরেখায়,”- এ কথাটি এখন পৃথিবীর বুকে থাকা সকল মানুষের জন্যও অমোঘ সত্য।
শ্রদ্ধেয় কবি খলিলুর রহমানের প্রতিটি কবিতায় একটা ভাবাদর্শ থাকে – একটা বলার প্রচেষ্টা থাকে- সহজ সরল ভাষায়-মানুষের বিবেকের জাগরণের একটা ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। আপাতভাবে, কথাগুলো সহজভাবে বলা মনে হলেও একটু গভীরভাবে মনোনিবেশ করলে গভীর তাৎপর্য লক্ষ্য করা যায়।
কবিকে জানাই আমাদের সবার তরফ থেকে আন্তরিক ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা।
তাঁর “শেষ আয়োজন” চারশোতম কবিতা।সেই কবিতার কটি কথা তাঁর লেখনীতেই-
“কবিতার অর্ধেক অলিখিত যদি
অর্ধেক সে কবিতার দুর্বোধ্যতা থাক নিরবধি”
আর কবিতাটির আয়োজন শেষ করেছেন অপূর্ব, অনায়াস চলনে-
“এ যদি নিতান্তই চলার শেষ
ভয় নয়, থাক তাতে জীবনের সবকিছুর রেশ
শেষ যদি অন্ধকার, তবে যেন আসে তা বর্ণালী আলোয়
আয়োজন মন্দ, তবু যেন শেষ হয় ভালোয়।”
আমরা আশা করবো অচিরেই তিনি আমাদের জন্য পাঁচশোতমের আয়োজন করবেন। ভালো থাকুন তিনি এই আশা রেখে আজকের আলোচনার ইতি টানলাম।
ধন্যবাদ জানাই সবাইকে।