অভিমানের খেয়া
শ্রদ্ধেয় কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
এতদিন কিছু একা থেকে শুধু খেলেছি একাই, / পরাজিত প্রেম তনুর তিমিরে হেনেছে আঘাত / পারিজাতহীন কঠিন পাথরে।
প্রাপ্য পাইনি করাল দুপুরে, / নির্মম ক্লেদে মাথা রেখে রাত কেটেছে প্রহর বেলা-/ এই খেলা আর কতোকাল আর কতটা জীবন! / কিছুটাতো চাই- হোক ভুল, হোক মিথ্যে ও প্রবোধ, / অভিলাষী মন চন্দ্রে না-পাক জ্যোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাই, / কিছুটাতো চাই, কিছুটাতো চাই।
আরো কিছুদিন, আরো কিছুদিন- আর কতোদিন? / ভাষাহীন তরু বিশ্বাসী ছায়া কতটা বিলাবে?
কতো আর এই রক্ত তিলকে তপ্ত প্রণাম! / জীবনের কাছে জন্ম কি তবে প্রতারণাময়?
এতো ক্ষয়, এতো ভুল জমে ওঠে বুকের বুননে, / এই আঁখি জানে, পাখিরাও জানে কতোটা ক্ষরণ
কতোটা দ্বিধায় সন্ত্রাসে ফুল ফোটে না শাখায়। / তুমি জানো নাই- আমি তো জানি,
কতোটা গ্লানিতে এতো কথা নিয়ে, এতো গান, / এতো হাসি নিয়ে বুকে নিশ্চুপ হয়ে থাকি।
বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এই তো জীবন, / এইতো মাধুরী, এইতো অধর ছুঁয়েছে সুখের সুতনু / সুনীল রাত।
তুমি জানো নাই- আমি তো জানি। / মাটি খুঁড়ে কারা শস্য তুলেছে, / মাংসের ঘরে আগুন পুষেছে, / যারা কোনোদিন আকাশ চায়নি নীলিমা চেয়েছে শুধু, / করতলে তারা ধ’রে আছে আজ বিশ্বাসী হাতিয়ার।
পরাজয় এসে কণ্ঠ ছুঁয়েছে লেলিহান শিখা, / চিতার চাবুক মর্মে হেনেছে মোহন ঘাতক। / তবুতো পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে মুখর হৃদয়, / পুষ্পের প্রতি প্রসারিত এই তীব্র শোভন বাহু।
বৈশাখী মেঘ ঢেকেছে আকাশ, / পালকের পাখি নীড়ে ফিরে যায়- / ভাষাহীন এই নির্বাক চোখ আর কতোদিন? / নীল অভিমানে পুড়ে একা আর কতটা জীবন? / কতোটা জীবন!!
কিংবদন্তি, শ্রদ্ধেয়, ভালোলাগার ও ভালোবাসার অভিমানী কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ সম্বন্ধে আলোচনা করলেন আসরের কবি হাসান হামিদ, কবির জন্মদিনে। কবির জীবন ও সাহিত্য নিয়ে মনোজ্ঞ এক আলোচনা করেছেন আলোচক। মন্তব্যদান করে আলোচনায় অংশ নিয়ে কবিকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন অনেকেই। তবু, যেন আরও একটু বলতে ইচ্ছা করলো কবি সম্বন্ধে কবির এই কবিতা সম্বন্ধে। তাই, এই প্রতিবেদন-
‘অভিমান’ একটা ছোট্ট শব্দ। তবে, তার অভিমুখ, তার বিনাশী ক্ষমতা যে কতটা তা সংবেদনশীল মানুষ মাত্রই জানেন। মানুষের যত গুণ বা দোষ আছে, তা থেকে মানুষ যদি সাময়িক বিচ্যুত হন এবং পরে নিজের অবস্থান বুঝতে পেরে ফেরত যেতে চান পূর্বের অবস্থানে, তাহলে হয়তো তিনি যেতে পারেন। তবে,অভিমান নিয়ে কখনও সরে গেলে আর সেখানে যাওয়া হয় না, যতই যাওয়ার ইচ্ছা থাকুক না কেন!
‘খেয়া’ পারাপারের মত বারবার যাওয়াই হয় নদীর এপার থেকে ওপারে তবু,নদীর পাড়ে আর ওঠা হয় না।নদীর মাঝেই জীবনটাকে বয়ে বেড়াতে হয়-বেদনা নিয়ে সারাটা জীবন।
প্রিয় মানুষটার বিচ্ছেদ সহ্য হয় না। তবুও, মুখ ফুটে বলা হয়ে ওঠে না।প্রথম প্রথম কিছুদিন একা থাকা হয়তো যায় তবে, ক’দিন পর ‘পরাজিত প্রেম’ আঘাত হানে হৃদয়ের সেখানে, যেখানে স্বর্গের পারিজাত ফোটার কথা ছিল একদিন। যা পাবো বলে ভেবেছিলাম যা আমারই ছিল একান্তভাবে, তা আর পাওয়া হয় না। মন আপোষ করতে চায়, যা চেয়েছিলাম- তার পুরোটা না হোক খানিকটা অন্তত যদি পাই! চাঁদ না পাই, অন্তত জ্যোৎস্না পেলে মনটা একটু শান্তি পেত! ক্ষণকালের জন্য হলেও মিথ্যা প্রবোধেও মনটা একটু হালকা হতে চায়। হায়! ক্ষরণ কাজ করে যায় তার বিনাশী ধর্ম নিয়ে অনবরত।অনবরত জাল বুনে ভুলের পাহাড় হয়ে যায়। গাছের সবচেয়ে কোমল অংশ তার ফুল। গাছের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় কাজ হলে অনুকুল পরিস্থিতিতে সে ফোটে। আর যদি দেহে অহরহ আগুন জ্বলে তবে ফুল কি ফুটতে পারে? পারে না। কতো কথা কতো গান নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকি। বেদনাকেই জীবন বলে মেনে নিতে হয়। আগুন তার লেলিহান শিখা নিয়ে হাজির হয়। পরাজিত জীবনটা তবুও প্রত্যাশার আশায় থাকে। পূরণ হয়না আশা। বৈশাখের ঝোড়ো হাওয়ায় একটা পাখি যেমন বিধ্বস্ত হয়ে যায়, দেখলে মনে হয় মাংসহীন পাখিটা শুধু পালক দিয়ে তৈরি,আর সেটা কোনক্রমে বয়ে নিয়ে বাসায় ফিরে যায় সে। তেমন, অভিমানের নীল আগুনে ক্রমাগত পুড়ে জীবনটা শেষ পরিণতির দিকে চলতে থাকে।
অভিমানের এমন সর্বব্যাপী, সর্বগ্রাসী চিত্র আর কোন কবি দেখাতে পেরেছেন কিনা আমার জানা নেই।এমন করে একটু একটু করে নিশ্চিতের দিকে যাত্রা, একটু একটু করে ক্ষয়ে যাওয়া,ক্ষরণের মাঝে মিছে প্রত্যাশার আশা একটা অন্য রকম ভালো লাগা তৈরি করে মনে।
একটা অসম্ভব ভালো লাগা থেকে শ্রদ্ধেয় কবির কবিতাটি দেখার ইচ্ছা হল।কবিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আজ এই পর্যন্ত।
ধন্যবাদ।