১.
পৃথিবীর যাবতীয় অন্ধকার ধুয়ে মুছে তুমি শহরের তীব্রতম কোলাহলে একটা লাল আপেল হয়ে তোমার মায়ের জঠরে যখন রক্তজলে ধারণ করলে প্রাণ— আমি তখন তোমাদের মেরুণ রঙের ঘোলাটে জলের ছোট পুকুরটার ধারে বসে ১৬০ মাইল দূরের তোমার কান্নার শব্দ শোনার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় হাওয়ায় পেতেছিলাম কান! আমি তখন বড়শি হাতে পুঁটিমাছ শিকারের ছদ্মবেশে বারংবার জলের তরঙ্গে ভেসে ভেসে খেলা করা হাঁসেদের ব্যক্তিগত একান্ত গোপন মুহূর্ত দেখছিলাম!
শৈশবজুড়ে আমার ছোট ছোট দুঃখের মাঝে সবচাইতে বড় যে দুঃখটা ছিল, ঠিক দুঃখ না, তীব্রতম আফসোস—আমি একটা হাঁস হয়ে জন্মাইতে পারতাম; কিংবা একটা যে-কোনো জাতের কিংবা রঙের কিংবা স্বরের পাখি অথবা সতেজ ফুলের চতুর্পাশে ক্রমাগত উড়নরত প্রজাপতি কিংবা মৌপিয়াসী যে-কোনো পতঙ্গের জীবন পেলে—হত কি খুব বেশি দোষ? আমি জানি না!
আমি জানিনা, কে তোমার ভালোবেসে নাম দিয়েছিল 'দোয়েল'? তোমার শৈশবকালীন স্মৃতির শহরে আমি অনেক হেঁটে বেড়িয়েছি, তেজকুনিপাড়ার রেললাইনে আমি অনেক পাখিকে আত্মহত্যা করতে পর্যন্ত দেখেছি, কিন্তু তার কোনোটিই যে দোয়েলপাখি ছিল না, আমি নিঃসন্দেহ এবং নিশ্চিত । আমি কাওরানবাজারে গেলে আজও পাই মৃত মাছের গন্ধ— অর্থাৎ তোমার বিস্মৃত মৃত শৈশবকালীন স্বপ্ন অথবা দুঃস্বপ্নের ভেতরে জেগে থাকা বিগত অনাগত জীবনের নানাবিধ জড়তা ! তোমার বাবার রঙের দোকানে দেখেছি প্রতিটা শেলফে থরে থরে সাজানো আছে তোমার ঝরে পড়া সব স্বপ্ন! তোমার বাবা প্রতি ঈদে রাত্রি করে বাড়ি ফেরার সময় তোমার জন্য যে নতুন জামাগুলি অতিযত্নে অত্যন্ত আদরে সঙ্গে করে এনেছিল এতকাল ধরে— আমি জানি, কোনোটাই তার আজ আর তোমার গায়ে লাগে না, আজ আর তোমার 'পাখি' জামাটার জন্যেও মায়া লাগে না! আজ তুমি ছোট্ট 'দোয়েল' থেকে হয়ে গেছো হলদে রঙের নাম না জানা বাসন্তি পাখি! আজ তুমি শিমূল ফুলের রক্তিম পাপড়ি ছুঁয়ে মনে মনে চাও, কেউ ভালোবেসে তোমাকে দিক একটা মেরুণ রঙের বেনারসি শাড়ি! কেউ তোমাকে ছুটির দিনগুলিতে নিয়ে যাক নীল সমুদ্রের কিনারে! বারে বারে যেন জলের কল্লোল আছড়ে পড়ে তোমার নূপুরপরা পায়ে। তুমি চাও— সমুদ্রতীরে ঝিরঝিরে হাওয়ার সঙ্গে তোমার প্রতি অঙ্গে নামুক শীত; তুমি শীতের শিহরণে কেঁপে উঠলে একটা পশমি নীল স্যুয়েটার কেউ জড়িয়ে দিক তোমার গায়ে! চৈত্রের খরায় তোমার গলা শুকিয়ে গেলে তুমি আম্রপালির জুস খেতে চাও খুব! তোমার মাঝরাত্তিরে বুকের পাঁজরে তৃষ্ণার চেয়েও তীব্রতর দহন শুরু হলে তুমি শান্ত সমুদ্রজলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তে চাও নিশ্চুপ; কখনো কখনো বেহেশতি জ্যোৎস্নায় সাঁতরে সাঁতরে নিভু নিভু কম্পনরত আঁধারের অধরে চুমু খেয়ে স্বর্গীয় আলোয় চিরতরে দিতে চাও ডুব!
২.
তোমার বাবার শৈশবকালীন সমস্ত উপহার কোথায় হারিয়ে ফেলেছো আজ, দোয়েল? আকাশের ওপারে যে পৃথিবী আছে, তোমার ঈদের জামাগুলো কি জমা আছে তার কাছে? সেখানে কে ধুয়ে দেয় তোমার শরীরী গন্ধে ভেজা যাবতীয় জামা-পাজামা? সেখানে স্বর্গীয় রোদে কে মেলে দেয় জর্জেটের ওড়নাগুলো? সেখানে কোন পাখিটা তোমার অতিপ্রিয় শুকনো বাদামী কামিজটার আড়ালে মুখ গুঁজে ভালোবাসে তার প্রাণের চেয়েও অধিক প্রিয় পাখিটির পিপাসায় কাতর আঁখি দুটি? পাখিটা যখন পাখিটির ঠোঁটে ঠোঁট ঘসে, 'ভালোবাসা' কি তখন জান্নাতের বাগান থেকে উড়ে এসে পৃথিবীর অন্ধকারময় রাত্রির বিছানায় খায় লুটোপুটি? রোমাঞ্চের উত্তাপে কি তখন তোমার সুগন্ধি বুকের আঙিনায় লাজুক প্রজাপতিগুলি শুরু করে দিক-বেদিক ছুটাছুটি!
দোয়েল তুমি দেয়ালের মায়া ছেড়ে বসো কবির পাশে!দোয়েল তুমি ঠোঁট দুটি মুছে নাও শিশিরভেজা ঘাসে! দোয়েল তোমার নরম বুক থেকে তুলে ফেলো সব শরম!
দোয়েল তোমার পালকগুলি কেন এত উষ্ণ আর নরম!দোয়েল তোমার নিঃশ্বাসের বাতাসে কেন এত উত্তাপ!দোয়েল তোমার চোখে ফুটে আছে একজোড়া গোলাপ!
দোয়েল তোমার শরীরজুড়ে অশরীরী জলের তীব্র সুঘ্রাণ! দোয়েল তোমার স্পর্শে নরক হয়ে যায় জান্নাতের বাগান! দোয়েল আঁখি তোলো, দোয়েল তুমি আর নেই ষোলো! আসছে অগ্রহায়ণে দোয়েল তুমি পা দিবে তেইশে; দোয়েল আমার তেত্রিশ বছর হতে আরও ৮৮৬ দিন বাকি ! দোয়েল চলো দুজন দুজনকে জড়িয়ে অন্তত টানা ৭৩৩ দিন ঘুমিয়ে থাকি!
যদিও পৃথিবীর মানুষ ভুলে গেছে আসহাবে কাহাফের গল্প! যদিও ৬০ বছর আগে স্বর্গভ্রমণ করে এসেছে 'লাইকা' নামক একটা কুকুর! যদিও পৃথিবীর ভিতর ইতোমধ্যে একটা স্বর্গ জন্মের ৭৪ সেকেন্ড পরেই মরে গেছে! তবু ওরা কারা আজও ৭২ হুরের অলীক আশায় শরীরে বোমা বেঁধে আত্মঘাতী হয়? তবু ওরা কারা ক্ষেপনাস্ত্রের বিপরীতে তলোয়ার ধরে? ওরা কারা আমাকে গুম কিংবা খুন করার পরিকল্পনায় আধো ঘুমের ভিতর নাম ধরে ডাকে?
৩.
বার্ষিক ঘুর্ণনে উত্তরের পৃথিবীতে যখন তীব্র শীত নামে, একটা 'ভুল' নামক ফুলে আমার দৃষ্টি থামে! থরোথরো শৈত্যপ্রবাহে কম্পনরত শত শত স্মৃতি ফায়াক্যাম্পের তৃষ্ণায় কেবলই ঘামে! আমাদের জীবনগোলকের ঘূর্ণনে যখন পৃথিবীতে জানুয়ারি মাস নামে, তুমি আমি ভুলতে চাই সেই বিষধর স্মৃতির ছোবলগুলো, কবে ভুলগুলো শুধরে নিয়ে হাতের মুঠোয় আটকে রাখা জোনাকির মতন ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিব অতীতের সমস্ত জঞ্জাল আর সব ধুলো! আমাদের পুব আকাশে যখন জানুয়ারি মাস আসে, তুমি আমি একটা উষ্ণ আশ্রয়ের সন্ধানে দাঁড়িয়ে থাকি সকালের কুয়াশাচ্ছন্ন বারান্দায়! কবে কখন আঁখিতে আঁখিতে প্রেম হয়ে গেল আমাদের— হায়! কখন যেন অজান্তেই জন্মালো তোমার বুকের উত্তাপে নিজেকে পোড়ানোর বাসনা!
দোয়েল, প্রিয়তমা পাখি আমার, আজন্ম প্রেমিকা আমার, দাম্পত্যজীবনের প্রথম এবং শেষ আশ্রয় আমার, ভালোবাসার রঙে ঝলমলে পৃথিবী আমার, শিয়রের পাশে ঘুমে ঢুলু ঢুলু রাত্রি আমার, পৃথিবীর প্রথম মানবীর শরীর নিয়ে জন্মানো প্রাণের চেয়েও প্রিয়তম কিংবা জীবনসম একমাত্র সত্য প্রেম তুমি আমার— বলো, তুমি 'প্রেমিক' ভেবে ছদ্মবেশী ঘাতকের হাত ছুঁবে না আর ভালোবাসার সন্ধানে! কথা দাও, তুমি ভুল করেও আর 'ফুল' হয়ে ফুটবে না কোনো প্রতারক প্রেমিকের বাগানে! প্রয়োজনে তুমি অকালে ঝরে যাবে এই ছ্যাঁচড়া ঘামে দুর্গন্ধে ছন্নছাড়া কবির অক্ষরের বৃষ্টিতে, তবু তুমি আটকে যাবে না চকচকে ঝকঝকে প্রতারকের রৌদ্রময়ী দৃষ্টিতে!
এই কঠিন নির্মম পৃথিবীতে ফের যদি তুমি ঝরে পড়ো কোনো শীতে, ফের যদি কেউ কেটে নেয় তোমার আশ্চর্য অলৌকিক দুটি ডানা... যদি আবার তোমার পালকগুলো যায় ঝরে, যদি আমি সত্যি সত্যিই খুব শীঘ্রই যাই মরে— জেনে রেখো, তুমিও বাঁচবে না আর, তুমিও ফের কোনো শীতে যাবে ঝরে!
জেনো রেখো, কবির ঘ্রাণে আটকে থাকা হে সুগন্ধি রজনীগন্ধা, জেনে রেখো প্রাণের চেয়েও অধিক প্রিয় পাখিটি আমার— মালা গাঁথতে কিংবা বাসর সাজাতে—কবি অথবা উন্মাদ ছাড়া— মরা ফুল কিংবা ঝরা পালক কেউ পৃথিবীতে আজ আর কুড়ায় না! কবিকে কেউ একবার শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিলে কেউ তারে দ্বিতীয়বার পায় না ! উন্মাদের প্রেমে যে নারী পড়েছে কখনো, স্বামী-সন্তান সব নিয়েও সে পথ চেয়ে বসে আছে এখনো! যদি একা একা— পৃথিবীর যে-কোনো পথে আবার 'তার' সাথে হয় দেখা…