৬.
নদীটার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আমার চক্ষে জেগেছিল আলোর পিপাসা!  তোমার দুঃখে ডুবে যেতে যেতে যখন জলের আকাশে অবশেষে নিঃশেষিত হাবুডুবু এক নির্জন নিঃসঙ্গ দ্বীপ আমি, নদীটা আমাকে পাঠিয়েছিল কিছু ঢেউ– আলোর নেশায় উন্মত্ত আমার প্রাণে লাগে নি সে ঢেউয়ের ছোঁয়া, তোমাকে ছোঁয়ার  আত্মগ্লানিতে অনেক পুড়েছি আমি, ব্যর্থ ক্রোধে আমি ক্রমাগত আকাশের দিকে ছুঁড়েছি সোনালি ফুলের ধোঁয়া, তীব্র প্রতিশোধেও আমি হই নি বেশ্যাপাড়ার খদ্দের! টাকা দিয়ে প্রেম কিনে চাহিদা পূরণের ইচ্ছা আমার কোনোদিনও ছিল না! তুমি তো 'ভালোবাসি' বলেছিলে আমাকে, তুমি তো আমার দৃষ্টিতে উন্মুক্ত করেছিলে তোমার দেহভূমি— তবু কেন সেই ভূমিতে আমাকে চাষাবাদের অধিকার দাও নাই তুমি! আমিও তো শত সহস্র শব্দে নৈঃশব্দ্যে তোমাকে 'ভালোবাসি' বলেছিলাম— তবে কেন তুমি তোমার পাহাড়ি ঝর্নায় আমাকে ভেজাও নি কোনোকালে! তুমি হয়ত জেনে খুশিই হবে– তুমি চলে যাবার পর আজ অবধি অসংখ্য জ্বলন্ত মৃত সিগারেট ব্যতিত কেউ ছোঁয় নি আমার অধর!

একই আকাশের তলে আমরা তো পেয়েছিলাম পরস্পরকে চিরকাল না হোক কিছুকাল আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখার মতন প্রণয়– তবু কেন তোমার এত ভয়, এত এত সংশয়– কেন বুকে জড়িয়েও ভাসিয়ে দিলে আমাকে প্রত্যাখ্যানের ঘোলাটে স্রোতে? কেন আমার কাতর স্পর্শেও তোমার গোপন নীল পদ্মে ফুটে নি কোনো পাপড়ি ?

বৃষ্টিকালীন দুপুরে তোমার যে প্রেমিক খুব আদরে তোমাকে জড়িয়ে ধরেছিল একই ছাতার তলে!  তাকেও কি তুমি প্রত্যাখ্যানের ছেঁড়া কাগুজে ফুল উপহার দিয়েছিলে আমার মতন? ভালোবেসে অবশেষে তাকেও কি তুমি মিশিয়ে দিলে নোনাজলে? কী এমন সুখ পাও তুমি প্রেমিকের রক্তিম হৃদয় বেদনার নীলে রাঙিয়ে! আমার সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে তোমার যে শুভাকাঙ্ক্ষী তোমাকে মোবাইল সেট উপহার দিয়েছিল, সে কি শুভাকাঙ্ক্ষীর ছদ্মবেশে কোনো সুগারড্যাডি ছিল? সে কি নিয়েছিল তোমাকে, সে কি নিয়েছিলে সিজোফ্রেনিক প্রেমিকের প্রেমিকাকে, সে কি নিয়েছিল একজন চব্বিশ বছর বয়সী টগবগে তরুণ উদীয়মান কবির প্রেমাস্পদকে– তখনো পর্যন্ত সবচাইতে মূল্যবান সম্পদকে— ব্যক্তিগত বিছানায়?  আমি আবারও বলি— সুগারড্যাডিরা ব্যক্তিগত বিছানায় যাদের ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, কবিরা চিরকালই তাদের মনের বেদিতে রেখে পূজা করে! তবে তুমি জেনে রাখো— তুমি যারই ব্যক্তিগত বিছানার সঙ্গী হবে জীবনভর— তাকেই ঘৃণা করবে এই বিক্ষোভের আগুনে জ্বলন্ত ক্ষুধার্ত বঞ্চিত হৃদয়! তোমাকেও তার চেয়ে কম নয়!

না, নেই কোনো ভয়— আমি কখনোই তোমাকে জিজ্ঞেস করব না এসবের কিছুই।

শুধু জিজ্ঞেস করি, তুমি কি এখনো কানে ফুল গুঁজে হাসো ভোরবেলার রোদের মতন? তুমি কি এখনো চুলে মাখো জুঁই ফুলের সৌরভে সুবাসিত তেল? তুমি কি এখনো সর্বাঙ্গে মাখো সুগন্ধি সাবান? কতকাল আমি পাই না সেই সাবানের ঘ্রাণ!  তুমি কি এখনো বুকের স্তবদ্ধতায় জড়িয়ে আছো আমার নিকোটিন পোড়া ঠোঁটে ফুটে ওঠা প্রেমময় আদুরে চুম্বকীয় চুমুগুলো? এখন কি সন্ধ্যা নামতেই তুমি হও হাওয়ার স্পন্দনে মোমের আলোর মতন তন্দ্রায় ঢুলু ঢুলু?

তোমার প্রেমের নেশায় নয়— প্রত্যাখ্যান আর বঞ্চনার ভয়াল থাবায় আমি তলিয়ে গেছি আঁধারে! পুনর্বার উঠে দাঁড়বার প্রত্যয়ে আমি হয়েছি কেবলই মাতাল! মৎস্যশিকারীর মতন তোমাকে পাবার তাড়ায় আমি জলের দেশে ছদ্মবেশে পাতি নি কোনো জাল! আমি শুধু চেয়েছি তোমার স্মৃতির উঠোনে কিছু স্পন্দনরত জোনাকি উড়ে বেড়াক— তোমার স্বপ্নের নীলিমায় উড়ন্ত ঘুড়ির মতো। আমি শুধু চেয়েছি তুমি মায়াবী স্পর্শে মুছে দাও আমার সবগুলো বিগত গোপন ক্ষত! আমি শুধু চেয়েছি তুমি একান্তই আমার হও— আমি কি জানতাম, তুমি শুধু আমার ব্যক্তিগত 'তুমি' নও! আমি যেমন আজ আর তোমার ব্যক্তিগত 'আমি' নই...