৩.
নদীতে লঞ্চ ছাড়ার ঘন্টি বেজে উঠল এইমাত্র। এই ঘাট ছেড়ে লঞ্চ বয়ে যাবে অন্যঘাটে! জলের স্রোতে ভাসতে ভাসতে সে ছুটছে একটা ব্যর্থ বিষাক্ত নগরের সীমান্তে! নদীদূষণের বিরুদ্ধে আজকাল আমি প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তায় দাঁড়াই না। বরং তার মুমূর্ষু নিঃশ্বাসের শ্বাসকষ্ট নিয়ে বুড়িগঙ্গার দোয়াতকালি দিয়ে আমি সাজাই ট্রাজিক অক্ষরমালা!

রূপবতী চাঁদকে জলবতী নদীর বুকে জ্বলতে দেখে আমি ঝাঁপ দিয়েছি, এটা সত্য! নদীর বুকে যে চাঁদের মরীচিকা জ্বলে, পূর্ণিমারাতে আকাশ হতে যে জ্যোৎস্না গলে গলে ঝরে পড়ে নদীজলে, আমি তার কিছুই একান্ত নিজের করে পেতে চাই নি! আমি চন্দ্রিমার আঘাতে চূর্ণ হয়ে একজন পরিপূর্ণ কবিই হতে চেয়েছি চিরকাল, আমি স্নিগ্ধ রুপোলি জ্যোৎস্নার বিপরীতে দাঁড় করাতে চেয়েছি বিদ্রোহের লাল আগুনকে। আমি নদীপ্রেমের ছদ্মবেশে কেবল তুমি 'নারী'–কেই ভালোবাসতে চেয়েছি! সোনালি ডানার চিলের পরিবর্তে আমি ধূসর ডানার চিলই দেখেছি চিরদিন!  আমি চিল হতে চাই নি, আকাশজুড়ে ঘুরে ঘুরে অবশেষে নদীর হৃৎপিণ্ডে ঠোকর মেরে পেতে চাই নি নোনতা মাংসের স্বাদ!

হে নদী, আমি পেতে চাই নি তোমাকে ক্ষুধায়, আমি পেতে চাই নি তোমাকে তপ্ত শূন্য মরুর পিপাসায়! আমি হতে চাই নি তোমার 'বাসর' নামক কবরের শয্যাসঙ্গী। কনকনে  শীতের জড়োসড়ো কম্পনরত নিশিতে আমি কোনোদিনও চাই নি তোমার আগুনভরা বুকের দুগ্ধবতী উষ্ণতা! আমি শুধু চেয়েছি বৃষ্টিতে বৃষ্টিতে তুমি হও পূর্ণবতী! আমি জানতে চাই নি, তুমি কতটা সতী? আমি শুধু চেয়েছি রক্ত-মাংসের শরীর তোমার শরীরে নিয়ে না হলেও হৃদয়ে জমে থাকা মেঘবতী জলের ছোঁয়ায় কিংবা কান্নায় হও তুমি গর্ভবতী! লাল ওড়নায় ঢাকা তোমার পাথুরে বুকে ঘন হয়ে ওঠা পিপাসা টের পেয়েছি বলেই আমি গোলাপের পরিবর্তে তোমার হাতে তুলে দিয়েছি এক পেয়ালা গরম চা! তুমি মার্কেটভ্যালু দেখে ভালোবাসো শুনে আমি একটু আশ্চর্য হলেও তোমাকে একটা জুসের বোতলও দিয়েছি! আমি তোমাকে নিয়ে এক-দুটো খুচরা কবিতাও তো লিখেছি, হে নদীর নামে নামাঙ্কিত 'নারী'। আমার হৃদয়ের নদীতে ঢেউ খেলতে খেলতে তোমার লম্বা লম্বা যে চুলগুলি অতি সুন্দর নিতম্বে এসে থামলো, তাতে দু'একটা হলদে ফুল আমারও গুঁজে দিতে ইচ্ছে হয়েছিল কখনো কখনো! নদীর নামে তোমার নাম হলেও আমি তো তোমাকে 'নারী' হিসাবেই ভালোবাসতে চেয়েছিলাম চিরকাল! 'সালমান মাহফুজ' এর বদলে আমি যদি 'সালমান খান' হতাম, আমি হয়তো তোমাকে পেতাম! নদীর পরিবর্তে নূপুরের সাথে তোমার তুলনা দিলে তুমি হয়ত আমার প্রতিটা প্রেমের কবিতা-ই পড়তে। প্রখর রৌদ্রের দুপুরের পরিবর্তে একটা শান্ত স্নিগ্ধ ক্লান্ত বিকেলে তোমার সাথে আমার দেখা হলে হয়তো আজও তুমি আমাকেই ভালোবাসতে!

আমিও বেশি কিছু চাই না আজ আর! আমি চাই, তুমি অতিশীঘ্রই টঙ্গী থেকে তিতাসের তীরে ফিরে যাও। শুধু নামে নয়, সত্যিকার অর্থেই তুমি একটা জলবতী নদী হও। কবির অবিরাম অক্ষরের বৃষ্টিতে তুমি কানায় কানায় পূর্ণ হও। কবির মগজে জ্বালিয়ে দাও জলের আগুন, যাতে মুছে যাবে সমস্ত আদিম পাপ, আর তুমি হবে পুণ্যবতী!