কলেজে পড়তে যেতে হবে দূরের শহরে;
সব গোছগাছ শেষে মায়ের কাছে বিদায় নিতে যেতেই মা বললেন,
‘বাবা, শরীরটা ভাল যাচ্ছেনা,
ফিরে এসে আমাকে দেখতে পাস কিনা কে জানে!’
আমি বললাম, ‘মাত্র তো দুটো বছর মা,
একটু কষ্ট করে বেঁচে থেকো’
মা একটু হাসলেন, আর এই হাসি
সম্মতি ধরে নিয়ে সেই প্রথম মায়ের
সাথে হল এক অলিখিত চুক্তি সম্পাদন।
তা মা আমার কথা রেখেছিলেন।
চুক্তিমত দু’বছর বেঁচে রইলেন নির্ঝঞ্ঝাটে।
এবার যেতে হবে স্নাতক পড়তে আরো দূরের শহরে।
সংশয়ের দোলাচলে ম্রিয়মাণ মা আবার মৃত্যুর প্রসঙ্গ তুলতেই
পুনরায় চুক্তিনামা উপস্থাপন এবং হলো চুক্তি নবায়ন।
এভাবে স্নাতকোত্তর পড়তে যাওয়া,
চাকুরীর অন্বেষণে রাজধানী যাত্রা বা চাকুরীতে যোগদান
প্রতিবার হতো চুক্তি নবায়ন।
মা আমার চুক্তির বরখেলাপ করেননি কখনো।
‘বড্ড রোগা হয়ে গেছিস তুই’ বাড়ি এলেই এই অজুহাতে
মাথা, কপাল, পিঠে
বারবার শীর্ণ হাত বুলোতেন কি নিবিড় মায়ায় ;
দীর্ঘ অসাক্ষাতের সবটা আদর
পুষিয়ে দেয়ার সে এক প্রানান্ত চেষ্টা।
খুব লজ্জায় পড়ে বলতাম, ‘কি যে বল মা,কই রোগা?
আমিতো ঠিকই আছি।’
এরপর বিয়ে করলাম, ফুটফুটে মেয়ে এলো আমাদের ঘরে।
মেয়ের তখন আড়াই কি তিন।
মাও কেমন রোগা হয়ে গেছেন,
কপালের বলিরেখাগুলো বড় বেমানানভাবে স্পষ্ট।
মেয়েকে কোলে নিয়ে আমার গায়ে মাথায়
হাত বুলোতে বুলোতে অনুচ্চ স্বরে যখন রোগা হয়ে
যাওয়ার অভিযোগ তুললেন, মেয়েতো হেসেই সারা।
‘হি হি দাদু বাবাকে আদর করছে।
হি হি বাবাতা কি বাবু হয়ে গেছে?'
সহধর্মিণীর ঠোঁটে রহস্যজনক হাসি,
মা কেমন অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন
আর আমিও লজ্জায় মুখ লুকোবার জায়গা খুঁজে পাই না।
এই প্রথম বিদায় বেলা মৃত্যুর প্রসঙ্গ তুলতে ভুলে গেলেন মা।
হলনা চুক্তি নবায়ন।
শহরে ফিরে মনে মনে বললাম: ‘মাগো, মেয়ে আমার
বড় হোক ওর বিয়েটা দেখার পর না হয় মরার কথা ভেবো।’
সৃষ্টিকর্তা হয়তো মুচকি হেসেছিলেন,
মা-ছেলের এই চুক্তি সম্পাদনে ছিল তার ঘোরতর আপত্তি।
মায়ের কাছে চুক্তিনামা পৌঁছে দেয়ার কোনো দায় নিলেন না তিনি।
মা ও রাখলেন না আমার কথা।
হঠাৎই বার্তা পেলাম- মা আমার দূর আকাশের নক্ষত্র হয়ে
চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
মাগো! জানি অনেক রোগা হয়েছিলে তুমি,
বয়সও হয়েছিল ঢের বেশি। আর একটু রোগা হলে,
আরো কয়েকটা বছর বেঁচে থাকলে
কি এমন ক্ষতি হতো পৃথিবীর?
মাগো! আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে
একটু দেখো না কতোটা রোগা হয়েছি আমি।
আমার সন্তানেরা এখন অনেক বড়,
তাদের সামনে আমার মাথায় একটু হাত রাখো না মা,
লজ্জায় আমার মাথাটা নিচু হতে হতে মাটি স্পর্শ করুক,
সেই লজ্জাটা আমি আরও একবার পেতে চাই মাগো!
অনন্ত নক্ষত্ররাশির মাঝে তোমাকে খুঁজে খুঁজে আমি দিশেহারা।
তোমার কি একবারও ইচ্ছা হয়না
আদরের ছেলেকে একটু ছুঁয়ে দেখতে?
নাকি তুমিও নির্দয় হয়ে গেছ ঈশ্বরের মতো!