উত্তরাধুনিক বাংলা সাহিত্যে বাঁক বদলের কবি আব্দুল মান্নান সৈয়দ বাংলা কবিতার প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে এসে পরাবাস্তবতার পথিকৃত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী সফল কবিরূপে। বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ দাশ এর পরে বাংলা কবিতায় পরাবস্তবতার অন্যতম প্রবাদপুরুষ আব্দুল মান্নান সৈয়দই মূলত বিস্তর পরিসরে এই ধারাটি জনপ্রিয় করণের চেষ্টা করেছেন নিরলসভাবে, যা শুধু সমকালীন সাহিত্যসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি বরং আজও প্রাসঙ্গিক আলোচ্য বিষয় হিসেবে প্রণিধানযোগ্য। পরাবাস্তব কবিতার মূল ধারণা হলো অবচেতনমনের চিন্তা ভাবনাকে অপ্রচলিত ও আশ্চর্যকর কিন্তু নান্দনিক চিত্রকল্প দ্বারা প্রকাশ করা, যার সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন আব্দুল মান্নান সৈয়দ।
শিল্প সাহিত্যে যাঁরা পরাবাস্তববাদ চর্চা করে থাকেন তাদের মতে, "প্রকৃত সত্য কেবলমাত্র অবচেতনেই বিরাজ করে।" তাই পরাবাস্তববাদী শিল্পী বা সাহিত্যিকদের লক্ষ্য হল বিভিন্ন কৌশল ও আঙ্গিকে মনের গভীর থেকে সেই সত্যকে তুলে আনা। আব্দুল মান্নান সৈয়দ ঠিক এ কাজটিই করেছেন। প্রসঙ্গত, জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেয়া যাকঃ
“জ্যোৎস্না কী? – না, জ্যোৎস্না হয় জল্লাদের ডিমের মতো চুলহীন জলবায়ুহীন মুণ্ডু, জোড়া-জোড়া চোখ, সাতটি আঙুলের একমুষ্টি হাত, রক্তকরবীর অন্ধকার, এবং একগুচ্ছ ভুল শিয়ালের সদ্যোমৃত যুবতীকে ঘিরে জ্বলজ্বলে চিৎকার।”
(জ্যোৎস্না, জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ)
"কী চড়া বাজার! আমাদের পাশের লোকটির সত্যি-সত্যি গলা কেটে নিল
চীনে প্লেটের উপর এক গাঢ় দোকানদার। এরকম প্রমাণ আমি কখনো
দেখিনি। তারপর করল কি? -না, তার কাটা-মুণ্ডু ঝুলিয়ে দিল দোকানের
উইণ্ডোর নিচে বিজ্ঞাপনে টপাটপ।"
(সমস্ত ভাসান দিলাম সমস্ত উড়াল, জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ)
এভাবে মনের গহীন থেকে ভাসিয়ে আনা আশ্চর্যকর এবং অসাধারণ সব চিত্রকল্পে সাজানো জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ, যা পরাবস্তবতার এক নতুন দিগন্ত হিসেবে বাংলা সাহিত্যে চিহ্নিত হয়ে আছে।
বর্তমানকালের বাংলা কবিতায় প্রায় সব কবিই কমবেশি পরাবাস্তবতার প্রয়োগ করেছেন। তবে নিকট বর্তমানে পরাবাস্তবতার সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়ে বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছেন আব্দুল মান্নান সৈয়দ। তিনি বলতেন- "পরাবস্তবতাই হলো প্রকৃত বাস্তবতা।" এই ভাবনা থেকেই কবিতায় তিনি এনেছেন পরাবাস্তববাদী অনন্য বৈভব। যেমনঃ কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড এর 'আলোক সরকার আর অন্ধকার রায়' কবিতাংশ-
" ‘একি, আপনি বাজারে? কবিশাহেব, আপনিও কি বাজার করেন?’
--হ্যাঁ, আমাকেও বাজার করতে হয়,
আমাকেও তেল-নুন-মাংসের হিশেব কষতে হয়--
আমি নই বায়ুভুক রবীন্দ্রনাথ।"
অথবা একই কাব্যগ্রেন্থর 'কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড' কবিতায় বলা হয়েছে-
"এখানে কবিতা বানানো হয়।
সব ধরণের কবিতা।
রাজনীতিক কবিতা, সামাজিক কবিতা।"
পরাবাস্তব চিত্রকল্পে কী কঠিন বাস্তবতার উদাহরণ। এরূপ জীবনমুখী অনেক বাস্তব কবিতার নির্যাস তিনি বাংলা সাহিত্যে উপহার দিয়েছেন পরাবাস্তবতার আড়ালে, যা তাঁকে পরাবাস্তবতার পথিকৃত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে নির্দ্বিধায়।
এছাড়া, পরাবাস্তব কবিতার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো বাস্তবতার সাথে স্বপ্নের একটি মেলবন্ধন। তাই পরাবাস্তববাদ চর্চাকারীগণ একটি বিশেষ পরাবাস্তববাদ তৈরির মূল লক্ষ্য হলো- সাধারণ দৈনন্দিন বাস্তবতা এবং স্বপ্নের সংমিশ্রণের সমন্বয় ঘটানো। মান্নান সৈয়দ এর কবিতায় আমরা এটিও পেয়েছি দারুণ ও সার্থকভাবে। উদাহরণ হিসেবে তার অনেক কবিতাই উদ্ধৃত করা যায়। যেমন একটি কবিতাংশঃ
"বাতাসে পোতা আছে আমার স্বপ্নের এন্টেনা
কারফ্যু শাসিত চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী হ’য়ে আমি আছি
কিন্তু আমার আত্মা হ’য়ে পাখি উড়ছে ঐ
তার ছোট পাতলা ঠোঁটে রাজদণ্ডের মতো ধ’রে আছে।"
(আমার স্বপ্নের এনটেনা, ও সংবেদন ও জলতরঙ্গ)
পরিশেষে বলা যায়, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বর্তমান ভাবধারার উল্লেখযোগ্য শাখাসমূহের অন্যতম একটি হলো পরাবাস্তববাদ। যা উপেক্ষা করা সম্ভব নয়, যদিও দৃষ্টান্তবাদীরা বা চৈতন্যবাদীরা পরাবাস্তববাদের তীব্র সমালোচনা করে থাকেন। যাহোক, আব্দুল মান্নান সৈয়দ আধুনিক কবিতার অন্যতম গবেষক, চর্চাকারী যিনি কবিতাকে নানানভাবে অস্ত্রপাচার করে পরাবাস্তবতার রঙে রাঙিয়েছেন। যা তাঁকে স্বতন্ত্র মহিমায় উদ্ভাসিত করে আজও পরাবাস্তবতার পথিকৃত হিসেবে বাংলা সাহিত্যে অনন্য উচ্চতায় অক্ষুণ্ণ রেখেছে।