কেউই নেই মোর আজ বাঁচবো কেমন করে,
যে ছিল সেও গেছে হৃদয় ছিন্ন করে।
এরও আগে সত্তরে নিয়েছে বাপ-মা দু’জনারে,
অনেকের সাথে চলে গেছে গহীন মরন সাগরে!
মৃত্যুরে তারা ভালোবেসেছে তাইতো গেছে চলে,
তাদের ছাড়া বাঁচবো কেমনে গেলনা তা বলে।
দশ বছরের অবুঝ বালক বুঝিনি তখন কিছু,
জানিনি মৃত্যু যে মোর লেগেছে পিছু পিছু!
দুনিয়ায় রইলো না কেহ ‘মা’ বলার তরে,
‘বাজান’ বলে ডাকবে না কেহ নিবে না বুকে পুরে।
যাবনা আর হাটে চরের পথ ধরি,
তাদের হারিয়ে কাঁদি আজো সারা দিন ভরি।
অসীম সাগরের হাতছানি তে পেতাম কেবলই ভয়,
জানি সেথায় বাপ-মা’র সলিল সমাধি রয়।
তারপর কেটে গেছে আরো দশটি বছর,
সাগরের সাথে মিতালী গড়েছি হলো বন্ধুবর।
সুখে দুখে তার সাথে থাকি দিবানিশি,
অভিমানে কখনো কাঁদি আবার কখনো হাসি।
আশা ভরসার জীবন সৈকত জুড়ে অবশেষে,
ঘরে এলো এক সাথী নতুন বধূ বেশে।
গোলাপী ঠোঁট দুটো তার আলতামাখা পা,
সুখ দুঃখ ভাগ করেছি ভাগ্যে ছিল যা।
বধূ যে আমারে বাসত বড়ই ভালো,
রেখেছিলো সে অভাগার ঘর করে আলো।
সুখে দুখে ছিলাম মোরা দুটি হলুদ পাখি,
ছলের নীড়ে আমারে ছাড়া মুজতো না আঁখি।
কোনদিন চাইতো না চলে যাই দূরে,
অথচ আগেই চলে গেছে জনমের তরে।
সে বার কঠিন জ্বরে গেল সে চলে,
জীবনের মতো প্রেয়সী মোর একটি কথা বলে।
‘আমি আর আসবো না এ পৃথিবীর পরে,
মামনিরে তুমি ওগো রেখো যত্ন করে।'
কত যে আবেগে কেঁদেছে জড়িয়ে ধরে তারে,
মনি তখন কেঁদেছে কেবল কিছুই বুঝে নারে।
বললো-‘ওগো রেখো তারে আমার মত করে,
কষ্ট দিওনা কোনদিন এ দুনিয়ার পরে।
সেও যদি হারায় তোমারও আগে,
দু:খের সীমা থাকবে না সকলকে হারিয়ে।'
সে মোর পাঁচ বছরের ছোট্ট সোনামনি,
ঠিকই ঘটে গেল আজ মায়ের কথাখানি।
মানিক আমার রেখেছি বেঁধে আপন বুকে পুরে,
তাকে হারানোর ভয়ে আমি যেতাম না দূরে।
দিনমান খাটুনি খেটে সাঁঝে ফিরি ঘরে,
স্বর্গের সুখ পাই তখন মনিরে জড়ায়ে ধরে!
স্বপ্নের রূপালী সৈকতে তখন আমি যেতাম হারিয়ে,
মনি চলে যেতো দূরে আমি থাকতাম দাঁড়িয়ে।
নির্ঝরণীর কলকল সুর বাজতো মোদের মনে,
দুখীর ঘরে আসতো সুখ হৃদয় দুটির বনে।
অভাবের কঠিন শিকল আজো পারিনি ছিঁড়তে,
শত কষ্টে থাকলেও মনিকে দেইনি বুঝতে।
ঈদ আসার খবর শুনে ‘মা’ ভীষন খুশি,
পাবে এবার নতুন পোষাক, খেলার পুতুল পুষি।
নাওয়া খাওয়ার কথা তখন হঠাৎ ভুলে যাবে,
লাল ফিতে আর আলতা যখন নাকি পাবে।
বেচবো পুষ্ট বলদটারে গিয়ে রানীর হাটে,
দরকার মতো কিনে সব ফিরবো মোর বাটে।
খুশি হবে ‘মা’ আমার পেয়ে ওসব কিছু,
জানিনি  মরন লেগেছে তারও পিছু!
সখ করে কিনেছি বই ‘মা’ যখন পড়ে।
খুশির সীমা থাকবে না ভেবে হৃদয় জুড়ে।
‘সোনা নয় রূপা নয়, দিলাম মতির মালা,
তাইতো ছুটন ঘুমিয়ে আছে ঘর করে উজালা’’
নিশিথ রাতে তেমনি করে রয়েছে শুয়ে মনি,
এযে শেষ ঘুম তার জানিনি তখনি।
আমরা রয়েছি ঘুমের ঘোরে হাজারো মানুষের মতো,
হঠাৎ করেই করুণ আর্তনাদ শুনছি অবিরত।
খোদার আরশ যেন কাঁপে মানুষের সে কান্নায়,
হাজারো মানুষ চিৎকার করে এদিক সেদিক ধায়!
জলোচ্ছাসের গগনবিদারী নাদ আসছে শুধু তেড়ে,
মনিরে তখন জড়ায়ে বুকে যাচ্ছি কেবলি দৌঁড়ে।
ভয়ে হতবাক মনি আমার মুখে নেই কথা,
আমার বুকে গুজিয়ে মুখ বলছে যেন হেথা!
গাঢ় আঁধারে পথের মাঝে কেবলি যাই পড়ি,
হাত ছুটে হারায় মনি আবার জড়ায়ে ধরি।
‘পঁচাশির চব্বিশে মে’ মরন ছোবলের রাতে
উঠবেনা মনি আর একত্রে সাহরী খেতে।
যে দিকে তাকাই শুধু জল আর জল,
জলে হাবুডুবু খেয়ে হারিয়ে যায় বল!
হঠাৎ করে ধেয়ে আসা জলের ঝাপটায়,
মনি আমার হাত থেকে ছুটে গেল অজানায়!
খালি করে বুকের খাঁচা পালালো প্রাণপাখি,
আঁধারে খুঁজে পেলাম না মেলে দু’টি আঁখি!
ভেসেছি সারা রাত ধরে জানি না কোথায়,
মানতে পারিনি মনি আমার নেই যে দুনিয়ায়।
সকালে হাজারো লাশ নেড়ে মনিরে শুধু চাই,
খুজ়েছি সারাটি দিন তবু নাহি পাই।
ডাকিলাম বারে বারে মাগো ফিরে আয়,
আমার ডাক ‘মা’ আমার শুনতে নাহি পায়।
মনিরে পাবো না খুঁজে এ দুনিয়ার পরে,
আমারে ছেড়ে চলে গেছে অনেক অনেক দূরে।
সব হারিয়ে আজ আমি কোথায় যাবো বলো?
তোমরা কেও মরন সাগরে আমায় নিয়ে চলো!
সেথায় গিয়ে দেখবো আমি সব স্বজনেরে,
কেন রেখে এলে মোরে বলবো জড়ায়ে ধরে।
কঠিন পাথরের মতো আমার এ পাষাণ বুকে,
অশ্রুর বন্যা শেষ হয়েছে কান্না থামে শোকে।
বিধাতা মোরে দিয়েছে সব নিয়েছে আবার পরে,
একে একে সব হারিয়ে বাঁচবো কেমন করে?

পাদটীকা :
(২৪ মে ১৯৮৫ এর প্রলয়ংকারী জলোচ্ছাসে উড়িরচর, সন্দ্বীপসহ সমগ্র উপকূলীয় এলাকায় নিহত ও আহতদের স্মরণে কবিতাটি উৎসর্গকৃত। কবিতাটি আমার সে সময়ে লেখা। সময়ের প্রাসঙ্গিতায় প্রকাশের জন্য মনের মাঝে একটা তাড়না বোধ করেছি। সেদিনের সে প্রলংকারী ঘূর্ণিঝড়ে এগারো হাজারেরও অধিক আদম সন্তান দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিল। উড়ির চর, সন্দ্বীপ ও আশেপাশের চরাঞ্চল হয়েছিল মনুষ্যবিহীন বিরাণভূমি। উপকূলবাসী আজও একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ে পর্যদুস্ত। প্রকৃতির কাছ থেকে বার বার পাওয়া আঘাত তাদের ভাগ্যের সাথে যেন সাথে মিশে আছে। বংশপরস্পরায় বয়ে চলেছে তারা স্বজন হারানোর স্মৃতি। সাগর আর ঝড়ের সাথে নিয়ত যুদ্ধ করেই চলে তাদের জীবন। হতভাগ্যদের একজনের মনের করুণ আর্তি কবিতার মাঝে প্রকাশ করতে চেষ্টা করেছি এ কবিতায়। জানিনা, সর্বশেষ ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ কি ভাগ্য রচনা করবে উপকূলবাসী মানুষগুলোর জীবনে, রচনা করবে কি স্বজনহারা বেদনার নতুন কোন উপাখ্যান! বিধাতা সকলের প্রতি সহায় হউন-এটাই হোক আজকের দিনের প্রার্থনা)