যে অলংকার ধ্বনির তথা শব্দের সৌন্দর্য  বৃদ্ধি করে এবং বাক্যকে শ্রুতিমধুর করে তুলে তাই শব্দালংকার৷ মনে রাখতে হবে, শব্দালংকার শব্দের পরিবর্তন সহ্য করতে পারে না ; অর্থাৎ, শব্দের পরিবর্তনে অলংকার থাকে না। শব্দালংকারমূলতঃ ধ্বনির অলংকার।
শব্দালংকারের প্রকারভেদ। যথা-
১. অনুপ্রাস ২. যমক ৩. শ্লেষ ৪.  বক্রোক্তি

                   অনুপ্রাস

অনুপ্রাস : একই বর্ণ বা বর্ণগুচ্ছ অথবা একই ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছ যুক্ত বা বিযুক্তভাবে বারবার ধ্বনিত হলে, তাকে ' অনুপ্রাস ' শব্দালংকার বলে।

উদাহরণ -১
হেসে খল খল গেয়ে কল কল তালে তালে দিবো তালি (নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ, রবিঠাকুর)  

এ পঙক্তিটিতে একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন এখানে ' ল ' সাতবার ধ্বনিত হয়েছে ; এবং ' ত' ধ্বনি তিনবার ধ্বনিত হয়েছে ; তাই বলা যায় এ পঙক্তিতে সুন্দর অনুপ্রাস সৃষ্টি হয়েছে।

উদাহরণ - ২
" পূজিল রাঘব রাজে, পূজিল অনুজে।"  (মেঘনাদবধ কাব্য, চতুর্থ সর্গ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত)  

এখানে ' জ' চারবার ধ্বনিত হয়ে সুন্দর অনুপ্রাস সৃষ্টি হয়েছে ; এবং কাব্যের দেহকে আরো সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে।

অনুপ্রাস প্রধানত ৫ ভাগে বিভক্ত। যথা-
১. অন্ত্যানুপ্রাস ( অন্ত্যমিল)  ২. বৃত্ত্যনুপ্রাস
৩. ছেকানুপ্রাস ৪. লাটানুপ্রাস ৫. শ্রুত্যনুপ্রাস

                  অন্ত্যানুপ্রাস

কবিতার চরণান্তের ( চরণের শেষ বর্ণ বা ধ্বনি) সাথে চরণান্তের যে ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছের সমতা বা সাম্য সৃষ্টি করে তাকে ' অন্ত্যানুপ্রাস ' বলে।

এবার নিম্নে কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক ---

১.এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে,
  তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
           ( কবর, জসীমউদ্দিন)  

এখানে 'তলে ' ও 'জলে ' -- অসাধারণ অন্ত্যমিল রয়েছে। একটু ভেঙে অন্ত্যমিলের ব্যাপারটা বুঝানো যাক- এখানে ' তলে '  ও 'জলে'  চরণান্তের ' ল ' দুইবারই ধ্বনিত হয়েছে ; তবে মনে রাখা দরকার চরণান্তের শেষে যে বর্ণ বা ধ্বনি থাকবে তা পরবর্তী চরণ বা পঙক্তির শেষে একই বর্ণ ও ধ্বনি থাকতে হবে। যেমন - তলে -- তল + এ = তলে ও জলে-- জল+ এ = জলে অর্থ্যাৎ, উভয় চরণান্তে 'ল' বর্ণ ও ' এ' ধ্বনি ( এ-কার)  ধ্বনিত হয়েছে।

নিম্নে কিছু কবিতাংশের উদাহরণ দেওয়া যাক -

       মধ্যযুগীয় গীতিকবিতা

১. সুন্দরী মাধব তুয়ে অনুরাগী,
    তুঁহু ধনি ঐছন ভেলি কথি লাগী।। - বিদ্যাপতি

২. রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুনে মন ভোর,
   প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর।। -
                      ( জ্ঞানদাস)

          আধুনিক কবিতা ( ১৮০১- বর্তমান)  

১.আজ হতে হলো বন্ধ আমার জানালার ঝিলিমিলি,
আজ হতে হলো বন্ধ মোদের আলাপন নিরিবিলি।
(বাতায়ন-পাশে গুবাক তরুর সারি, কাজী নজরুল ইসলাম )

২. রাশি রাশি ভারা ভারা,
    ধান কাটা হলো সারা।  
         ( সোনার তরী, রবিঠাকুর)  

৩. আসলো হাসি, আসলো কাঁদন,
   মুক্তি এলো, আসলো বাঁধন।
(আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে,কাজী নজরুল ইসলাম)

৪.রাত থম থম স্তব্ধ নিঝুম, ঘোর- ঘোর আন্ধার,
নিশ্বাস ফেলি তাও শোনা যায় নাই কোথা সাড়া কার
   ( পল্লিজননী, জসীমউদ্দিন)  

         বৃত্ত্যনুপ্রাস

যখন কোনো একটি ব্যঞ্জন ধ্বনি একাধিকবার ধ্বনিত হয়, অথবা ব্যঞ্জন ধ্বনিগুচ্ছ যথাক্রমে যুক্তভাবে বা বিযুক্তভাবে বারবার ধ্বনিত হয় তখব তাকে ' বৃত্ত্যনুপ্রাস ' বলে।
বৃত্ত্যনুপ্রাস কাব্যরসকে পরিশোষণ করে। বৃত্ত্যনুপ্রাস সম্পর্কে চারটি বিষয় মনে রাখার প্রয়োজন।

যথা -
১.  একটি মাত্র ব্যঞ্জন বর্ণ দু'বার মাত্র ধ্বনিত হবে। যেমন -
ক) যে জন চলিয়াছে তারি পাছে সবে ধায়,
     নিখিলের যত প্রাণ যত গান ঘিরে তায়।
       ( ক্ষণিক মিলন, রবিঠাকুর)

এখানে - প্রথম চরণে ' ছ' মাত্র দু'বার ধ্বনিত হয়েছে ; আর দ্বিতীয় চরণে ' য ' ও ' ন ' ( ন ও ণ এক্ষেত্রে সমধ্বনিযুক্ত)  মাত্র দু'বার ধ্বনিত হয়ে সুন্দর বৃত্ত্যনুপ্রাস সৃষ্টি হয়েছে। চরণান্তে ধ্বনি সাম্য থাকায় অন্ত্যানুপ্রাসও সৃষ্টি হয়েছে।

খ) সব সঙ্গীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া। - রবিঠাকুর
এখানে, ' স ', ' ঙ্গ ' ও ' ত ' বর্ণ দু'বার করে ব্যবহৃত হয়েছে।

২. একটি মাত্র ব্যঞ্জন বর্ণ বহুবার ধ্বনিত হবে। উদাহরণ -
ক) বেলা যে পড়ে এলো জলকে চল। - রবিঠাকুর
এখানে ' ল ' ৪ বার ধ্বনিত হয়েছে। সুতরাং, এখানে বৃত্ত্যনুপ্রাস সৃষ্টি হয়েছে।

খ)  সোঁতের শেহলা ভাসে সোঁতে সোঁতে সোঁতে সোঁতে ভাসে পানা। ( নকশীকাঁথার মাঠ, জসীমউদ্দিন)  

গ) বন্দি চরণার বিন্দ, অতি মন্দ গতি। - মেঘনাদবধ কাব্য, প্রথম সর্গ ; মাইকেল মধুসূদন দত্ত)  
    
৩. ব্যঞ্জনগুচ্ছ স্বরূপানুসারে মাত্র দু'বার ধ্বনিত হবে।

( অলংকার শাস্ত্রে বর্ণের ক্রম- সাদৃশ্য এবং স্বরূপ- সাদৃশ্য বলতে বোঝায় ব্যঞ্জনগুলোর ক্রম অক্ষুণ্ণ রেখে যদি ধ্বনি- সাদৃশ্য সৃষ্টি করে তবে তা ক্রম- সাদৃশ্য ; আর ক্রম ভঙ্গ করে বর্ণ- বিপর্যয় সৃষ্টি করেও যদি ধ্বনি- সাদৃশ্য থাকে, তবে তা ক্রম স্বরূপ- সাদৃশ্য বলা হয়)  

উদাহরণ -
ক)  রঙ- বেরঙের সুতোগুলো থাক
    থাক পড়ে ওই জরির ঝালর।। - রবিঠাকুর
এখানে, ' রঙ', বে-'রঙ'- এর ' থাক ', ' থাক ' ধ্বনিগুলোতে ধ্বনি-সাদৃশ্য রয়েছে তা ক্রম ভঙ্গ না করেই।  সুতরাং এখানে, বৃত্ত্যনুপ্রাস সৃষ্টি হয়েছে।

খ)  ভূলোক দ্যূলোক গোলোক ভেদিয়া,
  খোদার আসন আরশ ছেদিয়া। ( বিদ্রোহী,কাজী নজরুল ইসলাম)

গ) কবরী দিলো করবী মালে ঢাকি।- রবিঠাকুর
ঘ)  চুল তার কবে কার অন্ধকার বিদিশার নিশা।
    (বনলতা সেন, জীবনানন্দ দাশ)
  
৪. ব্যঞ্জনগুচ্ছ যুক্তভাবে বা বিযুক্তভাবে ক্রমানুসারে বহুবার ধ্বনিত হবে।

উদাহরণ -
ক) গত যামিনী, জিত দামিনী, কামিনী,কুল লাজে। - জগনানন্দ
এখানে, ' মিনী' তিনবার ধ্বনিত হয়ে সুন্দর বৃত্ত্যনুপ্রাসের সৃষ্টি হয়েছে।

খ) দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল,
     ভুলিতেছে মাঝি পথ।
     ( কাণ্ডারী হুঁশিয়ার,   কাজী নজরুল ইসলাম )  
এখানে, 'উলিতেছে'  ধ্বনিগুচ্ছ তিনবার ধ্বনিত হয়ে সুন্দর বৃত্ত্যনুপ্রাসের সৃষ্টি হয়েছে।

গ) না মানে শাসন, বসন বাসন অশন আসন যত।
     ( পুরাতন ভৃত্য, রবিঠাকুর)  
এখানে, সন ক্রম ভঙ্গ না করেই চমৎকার বৃত্ত্যনুপ্রাসের সৃষ্টি করেছে৷

ঘ) মঞ্জুবিকচ কুসুমপুঞ্জ মধুপ শব্দ গঞ্জি গুঞ্জ
  কুঞ্জর গতি গঞ্জিগমন মঞ্জুল কুল নারী।
  ঘন গঞ্জন চিকুর পুঞ্জ মালতী মালে রঞ্জ
অঞ্জন যুত কঞ্জনয়নী খঞ্জন গতিহারী।।- জগনানন্দ
( সংক্ষিপ্ত)  

তথ্যসূত্র: প্রাচ্য সাহিত্য সমালোচনা তত্ত্ব ও অলংকার শাস্ত্র পৃষ্ঠা নং -  ৩৬৮- ৩৭৫    

বি.দ্র: ইনশাআল্লাহ পরবর্তী সময়ে বাকি অনুপ্রাস ও শব্দালংকারের বাদবাকি উপাদানগুলো ক্রমানুসারে আলোচনা করব। সংস্কত শাস্ত্র থেকেও কিছু উদাহরণ দেওয়ার চেষ্টা করব। যদি আমার এ লেখায় কোন দুর্বোধ্যতা ও ভুল-ত্রুটি পরিলক্ষিত অনুগ্রহ করে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এবং আপনাদের গঠনমূলক সমালোচনা আমি মাথা পেতে নিবো ; আমি শেখাতে আসিনি, শিখতে এসেছি।