কে কাঁদছে? শিঞ্জীনির ঝংকৃত ব্যঞ্জনা
ভাসাচ্ছে কোন সে মহাবাদক?
এ কী! রক্ত— নূপুর গড়া দেয়ালে।
দরজার ওপাশে কে? প্রণয়াস্পদা!
সে কি আজকাল নূপুর ভালোবাসে না?
মেয়েটা ক্যামন আত্মভোলা হচ্ছে দিনদিন!
ছিটকিনিটা অব্ধি লাগায় নি,
ঘরের সব আলো নিভিয়ে রেখেছে।
ছায়া— উপছায়া— ভীষন ভীরু আমি
ছায়া দেখে ভয়ে হটেছি পিছু।
বিনু আমায় বলেছিল, সন্ধ্যের আগে ফেরো;
আসার পথে দু'টো গোলাপ আনতে ভুলো না।
ঘরে ত্যাল নেই— নুনটা পর্যন্ত নেই
দ্যাখো বিড়ালটার পানে।
নিজেরাই খেতে পাই না,
তাকে দিব কোত্থেকে? মায়া হয়—
সংসারের শুরু থেকেই তো আছে সাথে।
মানুষেরা সব একে একে ছেড়ে গেছে—
সে ছাড়েনি; আমাদের সাথে থেকেছে অনাহারে।
গণপরিহণের ভীড়ে হজম করেছি
শ'খানেক লাথি ঘুষির আঘাত।
বড় সাহেব এসেছেন— শোরগোল থাকবে;
না থাকাটা অস্বাভাবিক দেখায়।
গোলাপ পাইনি— কেনার পয়সা নেই;
কোচিং ফেরত তরুণীর খোঁপা হতে
নিষ্কৃতি পেয়ে ঝরেছে কৃষ্ণচূড়া,
খাতার মাঝে লুকিয়ে নিয়েছি ভীত হাতে।
পকেটে পয়সা নেই— শকটে চড়ছি।
ভাড়া দিতে গিয়ে বাঁধা পাব নির্ঘাত,
জানি, আমার উপর পকেটের বেজায় রাগ।
মনের অজান্তে সে গালি আওড়ায়,
শালা! টাকা নেই তো পকেট ছিড়ে ফেল;
আর কতকাল টাকার অভাবে রাখবি আমায়?
তাজ্জব ব্যাপার! শকট ছেড়ে নেমে এলাম—
কেউ ভাড়াটুকু ও চেয়ে নেয়নি।
যাক বাবা— বাঁচলাম— স্বস্তির নিঃশ্বাস।
একের পর এক দ্রুতগামী যান
যেন উড়িয়ে নিচ্ছে একেকটা প্রজন্ম,
চূর্ণ করছে একেকটা প্রণয় প্রাচীর।
শূন্য থলে হাতে নিয়ে এগোচ্ছি ক্রমশ—
ভিক্ষুক ভেবে কারা যেন দিয়ে গেলো
শ'খানেক টাকা— ভাংতি পয়সা।
ছিঁচকে চোর শিলু— সে মুখ ভ্যাংচায়;
সে ও দিয়ে গেছে চকচকা
পাঁচ টাকার একটি নোট।
বাজারে আগুন লেগেছে— চাল নেই,
নুনের সন্ধান জানে না কেউ।
এক পাশে জ্বলে পুড়ে মরছে
নানা প্রজাতির সবজি— ধরার সাধ্য নেই।
চারপাশে সব নীরব দর্শক,
চিড়িয়া দেখছে সকলে মিলে।
কিছু না পেয়ে এক জোড়া গোলাপ কিনেছি,
রাতটা গোলাপের সুবাস খেয়ে কাটবে আজ।
সকালে এক ঢেকুর গরম জল,
দুপুরটা পাখিদের খাওয়া দেখে কাটানো যায়।
বিনু কী খাবে? ফুলের সুবাস খেয়ে বাঁচবে সে?
পাখিদের সে সহ্য করতে পারে না—
ফুলের পাশে পাখি দেখলে ছুড়ে মারে ঢিল।
ঘরে ফিরে বুঝেছি শরীর নিথর হয়েছে—
ছিটকিনি লাগাতে ভুলে গেছে বিনু।
বাতাসে রক্তের উদ্ভট গন্ধ,
বিড়ালটা ম্যাঁও ম্যাঁও শব্দে ভরিয়েছে ঘর।
আলো জ্বলেনি— কেরোসিন ছিল না?
ঘরের ছাউনি উড়ে যায়।
প্রখর জ্যোৎস্না— পড়েছে বিনুর মুখে।
তার চোখ নীল হয়ে আছে,
নূপুরটা অনতিদূরে ভাসছে রক্তের বন্যায়।
বিনু কি মারা গেছে?
এত অভিমান কীসের?
মৃত্যুর পর মানুষকে জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধতায়
এত রূপবতী মনে হওয়ার রহস্য কী?
খাতার ভাঁজ থেকে
কৃষ্ণচূড়া বেরিয়ে আসে।
হাতে থাকা দু'টো গোলাপ
হাউমাউ করে কাঁদছে।
বিনুর মৃত্যুতে ফুলেরা
কাঁদবে ক্যানো?
তারা কি পরস্পর পূর্ব পরিচিত?
আমি ও শুয়ে যাই বিনুর পাশে,
মাথার তলায় মাটির বালিশ।
বিনুর মাথার কাছে উদ্ভট শিশি,
যা পান করবার অপরাধে
খোয়াতে হয়েছে আস্ত জীবন—
তাই বোধহয় ফুলেরা কেঁদেছে।
আমি ও পান করে নিই এই শিশি,
নীরবতা— নির্জীবতা— নিথর।
নক্ষত্ররা সব মেতেছে মৌনতায়।
ফুলেরা কি আদৌ কেঁদেছিল
আমার মৃত্যুতে?
ফেলেছিল দু'ফোঁটা অশ্রু?