কত স্বপ্ন বুকে একে আমরা প্রবাসে পাড়ি জমাই। এই যে আমরা প্রবাসে আসি, কতশত স্বপ্ন বুকে লালন করেই কিন্তু আসি । তার মধ্যে অন্যতম হলো বাবা মায়ের মুখে হাসি ফুটানো। কিন্তু সেই বাবা মা যখন আমাদের না বলে, আমাদের দুরে রেখে তারা আল্লাহর সান্বিদ্ধে চলে যান তখন একজন প্রবাসীর বুকে এক সাগর হাহাকার শুরু হয়। তার উপর বাবা মায়ের সাথে যদি সন্তানের দীর্ঘদিনের দেখাসাক্ষাৎ না হয় তাহলে অবস্তাটা কি দাড়াতে পারে চিন্তা করে দেখুন। আবার যে সন্তানকে বাবা মা প্রবাসে পাঠালেন একটু সুখের আশায় সেই সন্তান যদি লাশ হয়ে ঘরে ফিরে তাহলে বাবা মায়ের মানসিক অবস্তাটা কি হতে পারে ভাবলেই খুব কষ্ট হয় । একটি কথা তো আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে যে দুনিয়ার সবচেয়ে ভারী বুজা হলো বাবার কাধে সন্তানের লাশ। আর সেই সন্তানটা যদি হয় প্রবাসী এবং পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্রম সন্তান তাহলে অবস্তাটা....................।
অনেক সময় যাদের সুযোগ আছে তারা বাবা মায়ের মৃত্যুতে দেশে চলে যান। নিজে উপস্হিত থেকে বাবা মাকে গোসল- পরিস্কার করেন, কবরস্ত করেন,দোয়া কালাম পড়েন । এতে করে তার মনের হাহাকার একটু দুর হতে পারে।কিন্তু যে সন্তানটি তারা বাবা মায়ের মৃত্যুর সংবাদ শুনে দেশে যেতে পারেনা এবং তার বাবা মায়ের সাথে যদি আজ থেকে দশ বছর আগে দেখা হয় তার মানসিক অবস্তাটা চিন্তা করুন।
আজ সেরকম এক ভাইয়ের বাবার মৃত্যুর খবর জানতে পারি। ভাইটির সাথে ব্যাক্তিগত পরিচয় আছে। আজ তারা বাবা মারা গিয়েছেন। সে তার বাবার কাছে থেকে ১০/১১ বছর আগে বিদায় নিয়ে প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছিলো। এই সময়ের মধ্যে সে ইউরোপের কোন দেশে বৈধ হতে পারেনি । যার কারনে দেশেও যেতে পারেনি। হয়তো তার বাবা অধীর আগ্রহ নিয়ে ছেলের অপেক্ষায় ছিলেন । একদিন ছেলে বাড়ি আসবে, সুন্দর দেখে ছেলের জন্য একটা বউ ঘরে তুলবেন,ছেলের মাথায় পাগড়ি পরিয়ে দেবেন । এলাকার ঘরে ঘরে ছেলের বিয়ের দাওয়াত দিয়ে মেহমান খাওয়াবেন। এরকম হাজারো স্বপ্ন হয়তো বাবার মনে ছিলো। ছেলের মনেও হয়তো কতনা সুখ স্বপ্ন ছিলো। কিন্তু সব শেষ। না বাবার স্বপ্ন পুরন হলো, আর না ছেলের স্বপ্ন।
এভাবেই প্রবাসীদের কাছ থেকে না বলে অনেকেই চলে যান। কত আত্বীয় স্বজন মারা যান ,যাদের মৃত্যু সংবাদটা পর্যন্ত জানতে হয় অনেক দেরীতে। বাবা মায়ের মৃত্যু বা আত্বীয় স্বজনের মৃত্যু সংবাদ শুনার পর একজন প্রবাসীর কান্না ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা। হে খুব বেশী কিছু করলে একটি দোয়ার মাহফিল করা হয়। কিছুদিন নিজ থেকে কুরআন তেলাওয়াত করা হয়। এর চেয়ে বেশী কিছু করার যে নেই। সেদিন ও এক ছোট ভাইয়ের বাবার দোয়ার অনুষ্টানে গিয়েছিলাম। হায়রে কি কান্না। আমরা সকলেই কাদলাম,কেদে কেদে যেন বুকের হাহাকার দুর করলাম।
এভাবে অসংখ্য ভাই বন্ধু আছেন যাদের অনেকদিন থেকে তাদের বাবা মায়ের সাথে দেখা হয়নি।কথা হলে বড় করে একটা নিশ্বাস ছাড়েন। তখনই বুঝা যায় তাদের মন কতটা ব্যাকুল হয়ে আছে দেশের জন্য ।
শুধু কি বাবার সন্তান আছেন প্রবাসে ? না, একরম শুধু নয়। অনেক বাবাও আছেন যারা তাদের প্রিয় সন্তানদের দেশে রেখে এই প্রবাসে আছেন দীর্ঘদিন। ইউরোপের কোন দেশে বৈধ হতে পারছেন না বিধায় ৮/১০ বছর হয়ে যাচ্ছে সন্তানদের সাথে দেখা নেই। শুধু মাত্র সন্তানের জন্য তিনি তার সব সুখ আহলাদ বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছেন। যদি কোন না কোন ভাবে বৈধ হয়ে যেতে পারেন তাহলে তার সন্তানরাও ইউরোপে চলে আসবে শুধু এই আশায় পড়ে আছেন। তাছাড়া বৈধ না হলেও সন্তানের সুখ আরামের জন্য মাসে মাসে কিছু টাকা পয়সা পাঠাতে পারছেন এটাই বা কম কিসে।
অনেক বাবাও আছেন যারা এত কষ্ট করে নিজের সুখ আহলাদ বিসর্জন দিয়ে সন্তানের সুখের জন্য প্রবাসে থাকেন সেই তারাও অনেকে না ফেরার দেশে চলে যান বাবা মা স্ত্রী সন্তান ও আত্বীয় স্বজনদের না বলেই।
জানি জীবন মৃত্যুতে কারো হাত নেই। কখন কোথায় কিভাবে কার মৃত্যু হবে তা একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন । তবুও মেনে নিতে যে বড়ই কষ্ট হয় । যারা দেখে শুনে তাদের বাবা মা বা সন্তানের লাশ কবরস্ত করেন তারা না হয় মনকে কিছুটা হলেও শান্তনা দিতে পারেন। কিন্তু যে সমস্ত হতভাগা প্রবাসী এই কাজটুকু করতে পারেন না তাদের অন্তরে সারাটি জীবন এই হাহাকার বিরাজ করে এতে কোন সন্দেহ নেই।
আল্লাহ পাক সকল প্রবাসীদের হেফাযত করুন।