নিজের সন্তান কানা হলেও বাবা-মায়ের কাছে সে পদ্মলোচন এবং সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অন্যের কাছে বা স্বাভাবিক মাপকাঠিতে কখনই তা প্রকৃত সত্য নয়। আবার নিজের সন্তান হয়তো সত্যিই নিখুঁত কিন্তু কতটা নিখুঁত অথবা এমন কোন খুঁত থাকতেও পারে যা নিজের চোখে ধরা পড়ছেনা তখন অন্যের মতামতের উপর নির্ভর করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।
আমার এক চিকিৎসক বন্ধুর মাথায় হঠাৎ খেয়াল চাপলো সঙ্গীত শিখবে। শিখতেও শুরু করলো। সপ্তায় একদিন তার চেম্বার বন্ধ থাকতো। সেদিন আমরা কয়েকজন মিলে ওর বাড়িতে আড্ডা দিতে যেতাম। আগে নানারিকম মজার মজার বিষয় নিয়ে আড্ডা চলতো। কিন্তু গান শেখা শুরু করার পর গান শোনানোটাই তার কাছে মুখ্য ব্যাপার হয়ে উঠলো।তার গান শুনে আমরা মনে মনে বলতাম, তোর দ্বারা গান হবে না রে, যা করছিস তাই মন দিয়ে কর। কিন্তু প্রকাশ্যে 'কেয়া বাত' কেয়া বাত' বলতেই হতো। যদিও আড্ডায় খাবারের মেনুতে আগের চেয়ে অনেক বেশি লোভনীয় সব পদ যুক্ত হচ্ছিল, তা সত্বেও ধীরে ধীরে আড্ডার ভীড় পাতলা হতে শুরু করেছিল।হয়তো সে চেয়েছিল আমাদের রসনা তৃপ্ত করে তার বাসনা মেটাতে। বলাই বাহুল্য, বাসনাটা ছিল, নিজের গান শ্রোতাদের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হচ্ছে সেটা পরখ করা।
বর্তমানে কবি হিসাবে মোটামুটি নাম করে ফেলা ( সাতটি কাব্যগ্রন্থ প্রণেতা) আমার এক প্রতিবেশী এক সময় প্রায়ই আমার কাছে আসতেন তাঁর সদ্য রচিত কবিতা শোনাতে। কেমন লেগেছে তা অকপটেই জানাতে বলতেন এবং আমিও তাই করতাম। সব সময় না হলেও অনেক সময়ই তিনি আমার কথা মতো পরিমার্জন করতেন। মনে মনে ভাবতাম, সত্যিই প্রকৃত বড়ত্ব নমনীয়তা শেখায়, অহমিকা নয়। অথচ এই আসরে দেখেছি দু একজন ছাড়া কারো পাতায় মন খুলে মন্তব্য করা যায় না। সকলেই যেন পিঠ-চাপড়ানিই আশা করে, সঙ্গত সমালোচনাও স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। জানিনা তাদের কবিতা প্রকাশের উদ্দেশ্যটাই বা কি আর পাঠককেই বা কেন দরকার। নিজের কবিতা টেপ রেকর্ডারে শুনে নিজের পিঠ নিজেই তো চাপড়াতে পারে। কাজেই যা হওয়ার তাই হয়, চিকিৎসকের সাথে বন্ধুত্ব যাতে বজায় থাকে, চোখ বুজিয়ে শুধু 'কেয়াবাত' কেয়া বাত'।
এ লেখা শেষ করার আগে এই বাংলা কবিতা ডট কমের এডমিন সাহেবকে অকুণ্ঠচিত্তে ধন্যবাদ জানাতে চাই , কারো বাড়িতে হানা দিয়ে অথবা লোভনীয় মেনুর অফার দিয়ে অথবা বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়া কাউকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাড়িতে ডেকে এনে নিজের কবিতা শোনানোর সেই অস্বস্তিকর বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য।
একথা বোধ হয় কেউই অস্বীকার করতে পারবো না, শুধু পাশের বাড়ির কারো কাছে বা পরিচিত কারো কাছে নয়, এই সাইটের কল্যাণে মুহূর্তের মধ্যে নিজের কবিতা পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বহু কাব্যরসিক মানুষের কাছে যা কবি যশঃপ্রার্থী যে কোন ব্যক্তির একান্ত কামনা।হয়তো বা কোন কাব্যগ্রন্থের প্রণেতাও এত দ্রুত দূর-দূরান্তের এত মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারেন না। বিশেষত সরাসরি পাঠকের প্রতিক্রিয়াও এমন ভাবে পান না।