মানুষ সামাজিক জীব বলেই হয়তো এই বৃহত্তর সমাজে কিছু একটা অবদান রাখার তাগিদ অনুভব করে মনে মনে। কেউ সরাসরি সমাজসেবায় ব্রতী হয়, আবার কেউ বা তার সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে সমাজের কল্যাণের জন্য অবদান রাখতে প্রয়াসী হয়। সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্য ইত্যাদি নানা সৃষ্টিকর্মের কথা আমরা জানি।
ইতিহাস থেকে আমরা এটাও জেনেছি যে, যুগে যুগে মানুষ তথা সমাজের উপর সাহিত্য গভীর প্রভাব ফেলে থাকে।এক সময় শরৎ চন্দ্রের " পথের দাবি" উপন্যাস, কাজী নজরুল ইসলামের বিভিন্ন কবিতা তৎকালীন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মনে বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। এরকম দৃষ্টান্ত দেশে-বিদেশে প্রচুর আছে। অর্থাৎ সমাজ তথা দেশের সংকটকালে কবি-সাহিত্যিকেরাও এগিয়ে আসেন তাঁদের কাব্য-উপন্যাস-প্রবন্ধের পসরা নিয়ে। বর্তমানেও সুশীল সমাজের একটা প্রভাব রয়ে গেছে মানুষের ওপর। যদিও দুঃখের সঙ্গে জানাতেই হচ্ছে যে, বর্তমানে সুশীল সমাজের মধ্যেও বিভাজন দেখা দিচ্ছে, পক্ষপাতমূলক আচরণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে আর তার প্রতিফলন ঘটছে তাঁদের সৃষ্টি-কর্মের মধ্যে।
আমাদের পশ্চিম বাংলায় এক সময় গ্রাম বাংলার অসহায় মানুষের ওপর শাসকের অকথ্য অত্যাচার শুরু হয়েছিল কৃষিজমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে।। সে সময় সুশীল সমাজের একটা বিরাট অংশ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন এবং একটা মঞ্চ গড়ে তুলে বিভিন্ন এলাকায় মানুষকে সচেতন করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। কবি জয় গোস্বামীও ছিলেন তাতে, শঙ্খ ঘোষও সোচ্চার হয়েছিলেন। আমার মতো অনেক কবিযশঃপ্রার্থীও শামিল হয়েছিলেন অনেকে।সে সময় বিভিন্ন এলাকায় কবিসমাজের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেছি আর প্রত্যক্ষ করেছি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া।
যাই হোক, পশ্চিম বঙ্গের পট পরিবর্তনে সুশীল সমাজের অবদান সবাই স্বীকার করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমান শাসকের পদস্খলনের সময় তাঁদের অনেককেই প্রতিবাদ করতে দেখি না। যদিও শঙ্খ ঘোষের মতো কয়েকজন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি আগেকার দিনের রাজকবিদের মতো 'জো হুজুর' মনোভাব কবিদের শোভা পায় না। দলমত নির্বিশেষে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে যাওয়া উচিত। আপনার কি মনে হয়?
যাই হোক, লেখাটির শিরোনাম যেহেতু "কেন কবিতা লিখি" এবার সেই প্রসঙ্গে আসা যাক। আগেই বলেছি সমাজে একটা অবদান রাখার মনোগত আকুতির কথা। কিন্তু সেটাই সব নয়। মানুষমাত্রই চায় এই সুবিশাল মানুষের ভীড়ে একটা নিজস্ব আইডেন্টিটি গড়ে তুলতে। আর সেই 'চাওয়ার' অন্যতম একটা মাধ্যম হলো এই কবিতা অর্থাৎ কবিতার মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছানো আর নিজস্ব একটা পরিচিতি গড়ে তোলার প্রচেষ্টা।
কিন্তু আরো অনেক মাধ্যম থাকতে কবিতা কেন? চাইলেই তো সবাই কবি হতে পারে না। এক্ষেত্রে বলতে পারি, কিশোর মনে প্রথম প্রেমের ছোঁয়া পেয়ে স্কুল-জীবনেই আমার কবিতা-চর্চা শুরু।সে সময় স্কুল ম্যাগাজিনে অনেকের কবিতা স্থান না পেলেও অথবা কারো একটির বেশি কবিতা গৃহীত না হলেও আমার অন্তত তিনটি কবিতা ছাপা হতো।একবার তো তিনটি বাংলা কবিতা, একটি ইংরেজি কবিতা এবং একটি বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল। কলেজ-জীবনে কলেজ- পত্রিকাও সম্পাদনা করেছি। বাংলা সাহিত্যের এক অধ্যাপক একদিন বলেছিলেন, 'তুমি সাহিত্য না নিয়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনো করছো কেন?' তখন 'এই তো আমার কবিতা বেশ পাতে দেওয়ার মতো হচ্ছে তো' ভেবে তরুণ হৃদয়ে পুলক অনুভব করতাম আর মনে মনে 'কবি' হওয়ার বাসনাও হয়তো জেগে উঠেছিল। তারপর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালিখি।
কলেজ জীবনে একবারই একটা কবিতা পশ্চিম বঙ্গীয় প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের আঁতুড় ঘর "দেশ" পত্রিকায় পাঠিয়েছিলাম( হয়তো তরুণমনের অযৌক্তিক উচ্চাশা ঐ কাজটি করিয়েছিল তখন) । "আপনার কবিতা ভাল লেগেছে, তবে গভীরতা একটু কম, চর্চা চালিয়ে যান, একদিন অবশ্যই আপনার কবিতা ছাপতে পারবো, এবার পারলাম না বলে দুঃখিত" লিখে খুব সযত্নে "দেশ"-এর নিজস্ব ছাপানো খামে কবিতাটি ফেরত পাঠানো হয়েছিল। সেই খাম আজও হয়তো কোন ফাইলে রাখা আছে। তারপর আর কখনো "দেশ"মুখো হইনি। রবার্ট ব্রুসের মতো মাকড়সা-মন পাইনি একেবারেই। যে কোন ব্যাপারে একবার প্রত্যাখ্যাত হলে আমি আর সেদিকের ছায়া মাড়াই না। তবে ইচ্ছা আছে বই প্রকাশ করার।দেখা যাক...
আপনি কেন কবিতা লেখেন, জানালে খুশি হবো।
কলকাতা - ৭০০১২৫
০৫ / ০৭ / ২০১৪