কবিতা বোঝার জন্যেও কি প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে? প্রতিষ্ঠিত তথা প্রখ্যাত কবিদের অথবা উদীয়মান আধুনিক কবিদের রচিত যে কবিতাগুলি আমাদের কাছে অনেক সময় দুর্বোধ্য বলে মনে হয় সেগুলি কি আদৌ দুর্বোধ্য? নাকি আমাদের বুঝতে পারার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা? কবিতা পাঠ করে তাকে অনুভব দিয়ে নিজের সত্তার সঙ্গে মিশিয়ে নেওয়াটাও কি প্রতিনিয়ত অনুশীলন-সাপেক্ষ? সেই অনুভব শব্দ দিয়ে প্রকাশ করার জন্য বিশেষ কোনও প্রস্তুতির দরকার হয় কি?
এই বিষয়ে প্রখ্যাত কবি ও কাব্য-সমালোচক জয় গোস্বামীর কথাটি বেশ প্রণিধানযোগ্য :
"একটি কবিতা, অথবা একজন কবির পরপর কয়েকটি কবিতা পড়লাম --- মনে তার প্রতিক্রিয়া চলল। মুগ্ধ হলাম। কিন্তু সেই মুগ্ধতা, আরও ভালো করে বললে, ঠিক কী কী কারণে কবিতাটি নাড়া দিচ্ছে -- সেটা প্রকাশ করার ভাষা অনেক সময়ই তখন তখন আসে না। প্রকাশ করার ভাষাটা খুঁজে চলি।"
এই সমস্যাটা সম্ভবত আমাদের অনেকেরই হয়, যারা একটি কবিতা নিয়ে বা একজন কবিকে নিয়ে কিছু বলতে চান। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর অন্যতম হলো, অনুভবকে উপযুক্ত ভাষায় ব্যক্ত করা। 'অরণ্যের দিনরাত্রি' ছবি শ্যুট করার সময় সত্যজিৎ রায় ওই উপন্যাসের রচয়িতা তরুণ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ডেকে জানতে চেয়েছিলেন: মহুয়া খেতে কেমন লাগে? খাওয়ার পর কেমন প্রতিক্রিয়া হয়?
উত্তরে সুনীল একটা জুতসই জবাব দিয়েছিলেন : " ওটা তো আপনাকে বোঝানো যাবে না। খেয়ে বুঝতে হবে। যেমন যে কখনও দুধ খায়নি, তাকে আপনি বোঝাতে পারবেন না, দুধ খেতে কেমন লাগে।"
অপ্রেমিককে প্রেমের অনুভূতির কথা কিছুতেই বোঝানো যাবে না। সঙ্গমের অভিজ্ঞতা যাদের নেই, কিংবা আত্মহত্যার অভিজ্ঞতা, অথবা প্রথম মা হবার মধুর যন্ত্রণাময় অনুভূতি যার নেই তাকে আপনি কোনও ভাষাতেই ব্যাপারটা বোঝাতে পারবেন না। কবিতা বা সাহিত্য-শিল্পের ভালো-মন্দ লাগার অনুভূতির কথাও আজ পর্যন্ত কেউ ১০০ ভাগ ঠিকঠাক ব্যক্ত করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।
উপনিষদে বলা হয়েছে, 'বিধাতাপুরুষ সৃজনমুহূর্তে ঈর্ষাবশত মানুষের ইন্দ্রিয়গুলিকে শরীরের বাইরের দিকে স্থাপন করেছেন, যাতে অন্তরের গভীর সত্যকে সে অনুভব করতে না পারে এবং ইতর পশুপাখিদের মতো আহার বিহার মৈথুন নিয়ে ব্যস্ত থাকে।' পৃথিবীর বহু মানুষ বিধাতার এই কারসাজির শিকার। কিন্তু কবি শিল্পী সাহিত্যিক ও সাধকেরা বাইরের চোখ বন্ধ করে মর্মচক্ষু দিয়ে এক অলৌকিক সত্যকে অনুভব করলেন। অথচ সেই উপলব্ধিকে ভাষার তুলিতে প্রকাশ করতে গিয়ে দেখলেন, প্রাত্যহিক জীবনের টুটাফাটা দীন ভাষায় এই পরম ঐশ্বর্যময় অনুভূতিকে ব্যক্ত করা অসম্ভব। তখন থেকেই অনুসন্ধান শুরু হল এমন ভাষার যা হাটবাজারের ভাষার চাইতে স্বতন্ত্র, সংবাদপত্রের ভাষার চাইতে বহু দূর দ্বীপবাসিনী এক ভাষা। সেই ভাষাতেই রচিত হয় কাব্যসাহিত্য। তাকে দেখে চেনা মনে হয়, কিন্তু সে চির রহস্যময়। সেই ভাষা লৌকিক আধারে পরিবেশিত হলেও চরম অলৌকিক। সেই ভাষায় রচিত জীবনের গহন আলেখ্যকে পাঠ করে সেই পাঠের আস্বাদকে ব্যক্ত করতেও রীতিমতো শ্রম ও অনুশীলন দরকার। সেই অনুশীলন যার নেই, সেই দিব্যচক্ষু যার ললাটে আঁকা হয়নি, সে শুধু নিরুপায় আকুলতা নিয়ে বলতে পারে : আহা। বাহ। চমৎকার। অসাধারণ। অপরূপ। অলোকসামান্য।সুন্দর....
আধুনিক বিশ্বসাহিত্যে এ পর্যন্ত সমালোচনার নানাবিধ রীতি বেশ জনপ্রিয়:
Impressionistic, Historical, Comparative, biographical, psychological ইত্যাদি।
আমরা ৯০ শতাংশ পাঠক একটি লেখা পড়ে যা বলি তা মূলত ওই Impressionistic criticism. যার মূল কথা হল: "you decide from feeling, and not from reason. " একটি ভালো কবিতা বা উৎকৃষ্ট রচনার মধ্যে পাঠকের আত্মার একান্ত নিজস্ব অভিসারই হল এই ধারণামূলক ও ব্যক্তিপন্থী সমালোচনা।
জয় গোস্বামী লিখেছেন :
"যাঁরা কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিতা কী করে পড়তে হয় শিখেছেন, অথবা নিজেরা পড়ান, তাঁদের একটা ট্রেনিং আছে। তালিম আছে। তালিম ছাড়া, ট্রেনিং ছাড়া যেমন গান গাওয়া যায় না --- কবিতা পড়ারও তালিম দরকার।" (উল্লেখ্য, কবি জয় গোস্বামী নিজেও এই ট্রেনিং থেকে বঞ্চিত)।
জয় গোস্বামীর বক্তব্য অনেকাংশে যথার্থ হলেও আমরা কিন্তু বাস্তবে অন্য চিত্রও দেখতে পাই : বহু সাহিত্যের অধ্যাপক কবিতার একরৈখিক ব্যাখ্যা করে ছাত্রদের চিন্তার বিকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান। কবিতার অন্তর্গত রহস্যের বহুস্বরতা সম্পর্কে ছাত্রদের সামনে তাঁরা কোনও দরজা খুলে দিতে পারেন না। কিছু কিছু অসামান্য ব্যতিক্রম বাদ দিলে বাজার ছেয়ে গেছে অতি সস্তা নোটস বই আর রেফারেন্সে। অধিকাংশ সাহিত্যের অধ্যাপকের মধ্যে দায়সারা ক্লাস লেকচার দেবার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ভালো কবিতা পড়াতে গেলে শিক্ষককেও উন্মুক্ত মনের মানুষ হতে হয়। পঠিত কবিতাটি সম্পর্কে তাঁর কথাই যে শেষ কথা নয়, এই ধারণাও ছাত্রদের মধ্যে সঞ্চারিত করে দেওয়া খুব প্রয়োজন।
উল্টোদিকে আশার কথাও কম নেই। অবন্তী সান্যাল, সুমিতা চক্রবর্তী, অশ্রুকুমার শিকদার, শঙ্খ ঘোষ, তপোধীর ভট্টাচার্য, দীপ্তি ত্রিপাঠী, বাসন্তীকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতো কৃতী অধ্যাপকদের সংখ্যাটি খুব কম নয়। একবার নন্দনে অধ্যাপক হিমবন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণ শুনে মুগ্ধ হয়েছিলাম। 'দেশে' তাঁর কবিতা বিষয়ক আলোচনাগুলিও খুব গহন ও উচ্চ পর্যায়ের।
তবু কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতে : 'অধ্যাপকীয় সমালোচনায় এদেশের সাহিত্যের কোনও উন্নতি হয়নি।' কথাটা এক হিসেবে সত্যি। অধ্যাপক যদি বড় কবি হন, বুদ্ধদেব বসু বা শঙ্খ ঘোষের মতো, তাহলে তো ছাত্রদের পরম সৌভাগ্য। কিন্তু তাঁদের সংখ্যা চিরকালই কম। কবিরাই কবিতার সব চাইতে ভালো আলোচক হতে পারেন। সে তিনি অধ্যাপক হোন বা না হোন। যেমন জয়, সুনীল, শক্তি, শরৎকুমার, প্রণবেন্দু, নীরেন্দ্রনাথ। এই তালিকায় আরও অন্তত ১০০ জনের নাম করা যেতে পারে। অধ্যাপকীয় সমালোচনা এবং কবির সমালোচনার মধ্যে কতখানি আশমান জমিন ফারাক হতে পারে তার একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত রয়েছে অমরেন্দ্র চক্রবর্তী সম্পাদিত ' কবিতা পরিচয়' গ্রন্থে। সেখানে শঙ্খ ঘোষের 'সুন্দর' কবিতাটিকে ঘিরে অলোকরঞ্জন এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চূড়ান্ত বিতর্ক অত্যন্ত শিক্ষনীয় কবিতা পাঠকদের কাছে। কীভাবে কবিতা পড়তে হয়, তার অনেক রীতিকৌশল রপ্ত হতে পারে এই বইটি পাঠ করে। জয় গোস্বামীও স্বীকার করেছেন, তাঁর 'গোঁসাইবাগান' রচনার মূলেও ছিল এই বইটির উদ্দীপনা। জয় গোস্বামীর প্রায় সমস্ত আলোচনাই মূলত Impressionistic criticism. এত স্বাদু ও গভীর তাঁর আলোচনার ভাষা, যার মধ্যে একটি মরমী আত্মার রসবোধ কুল কুল করে বইতে থাকে।
তিনি লিখেছেন তাঁর নিজের কবিতাপাঠের ও আলোচনার মর্মের কথাগুলি :
" আমি নিজে নিজে, কেবল অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে কবিতা বোঝার চেষ্টা করে গিয়েছি বলে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক সময়ই কবিতাটি মুগ্ধ করলেও --- কেন মুগ্ধ করেছে, তার কারণগুলি প্রকাশের সঠিক ভাষা খুঁজে পাই না। বা ভাষা খুঁজে আনতে দেরি হয়।... আমি ত্রুটি ধরতে চাই না। কেবল ভালো লাগাটুকুই বলতে চাই।"