💄"জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে?
চিরস্হির কবে নীর হায়রে জীবননদে!"
-(মধুসূদন দত্ত )
পার্থিব শরীরের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবি, আমরা তা সকলেই জানি। কিন্তু সে মৃত্যুই একমাত্র মৃত্যু নয় মনুষ্যজীবনে। সচল শরীরেও মৃত্যু এসে দেখা দিতে পারে নানারূপে। কবি নাজমুন নাহার সেরকমই এক মূত্যুর সাথে মুখোমুখি দেখা করিয়ে দেন পাঠককে তাঁর আলোচ্য কবিতাটিতে।
🔯কৃতজ্ঞ হে ঈশ্বর / নাজমুন নাহার
💄 তীব্র ব্যথায় রাত গভীর হলে বুঝেছি মৃত্যু হয়েছে আজ আটদিন ।
তোমার মৃত্যুর কিঞ্চিত আগে ।
রিকসার পা দানিতে পা রেখেছ যেদিন
সেদিনই বলেছি মৃত্যু গ্রহীতার মতন ।
সুফি গানের রিদমের সাথে ওঠানামা করে আবেগের সুতো ।
রোদের ভেতর রোদ আকাশের ভেতর দড়ি পাকানো তুলো -
উপুর হয়েছে আমাদের কবরে ।
আমরা শুধু বলেছি সুরা মনে করে
আর কোনো অকৃতজ্ঞতা নেই ঈশ্বর হে -
অনন্ত জীবনে আর একবার ক্ষমা করে পাঠাও
অপার্থিব প্রেম পাঁজরে -
💄শিরোনামঃ- ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ। মানুষের পক্ষে তাই ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়াই স্বাভাবিক । কবিও সেই কৃতজ্ঞতাই জানিয়েছেন তাঁর রচিত ভাবগম্ভির এই কবিতায়। সুতরাং কবিতাটির নামকরণ যথার্থ ।
💄কবিতার প্রকৃতিঃ- ভাবছন্দে রচিত কবিতাটির তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এর ব্যঞ্জনাময় শব্দশৃঙ্খল যা কবির গভীর বোধের পরিচয় বহন করে। পাঠকহৃদয় আচ্ছন্ন হয় অপরূপ এক মায়াজালে; ধ্বনিত হয় এক সকরুণ সুরমুর্ছনা। উদাসিন করে তোলে দৈনন্দিন জীবন-কোলাহলের প্রতি।
💄কবিতাটির মূল ব্যাখ্যায় প্রবেশের আগে কবিতাটিতে ব্যবহৃত দুটি শব্দের আক্ষরিক অর্থ জেনে নেওয়া যাকঃ-
সুফি গান = সুফিবাদকে কেন্দ্র করে রচিত গানই হল সুফি গান। তাহলে সুফিবাদ সম্পর্কেও জেনে নেওয়া দরকার-
সুফিবাদ = একটি ইসলামি আধ্যাত্মিক দর্শন। আত্মা সম্পর্কিত আলোচনা এর মুখ্য বিষয়। সুফিবাদের একমাত্র মূল বিষয়টি হল, নিজ প্রাণের সাথে, নিজের জীবাত্মার সাথে পরমাত্মা আল্লাহ যে শয়তানটিকে আমাদের পরীক্ষা করার জন্য ছেড়ে রেখেছেন তার সাথে লড়াই করে তার থেকে মুক্ত হয়ে এ জড় জগত থেকে মুক্তি পাওয়া। আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনই হল এই দর্শনের মর্মকথা। মহান স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে আধ্যাত্মিক ধ্যান ও জ্ঞানের মাধ্যামে জানার প্রচেষ্টাকে সুফি দর্শন বা সুফিবাদ বলা হয়। হযরত ইমাম গাজ্জালি (র.) এর মতে, আল্লাহ ব্যতীত অপর মন্দ সবকিছু থেকে আত্মাকে পবিত্র করে সর্বদা আল্লাহর আরাধনায় নিমজ্জিত থাকা এবং সম্পূর্ণ রূপে আল্লাহুতে নিমগ্ন হওয়াকেই সুফিবাদ বলে। মরমীতত্ত্বের সাধনায় কারও জীবনকে নিয়োজিত করার কাজকে বলা হয় তাসাওউফ। ইসলামি পরিভাষায় সুফিবাদকে তাসাওউফ বলা হয়, যার অর্থ আধ্যাত্মিক তত্ত্বজ্ঞান। তাসাওউফ বা সুফিবাদ বলতে *অবিনশ্বর আত্মার পরিশুদ্ধির সাধনাকে বুঝায়। আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে ফানাফিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে অবস্থান করা) এবং ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে স্থায়িভাবে বিলীন হয়ে যাওয়া) লাভ করা যায়। যেহেতু আল্লাহ নিরাকার, তাই তাঁর মধ্যে ফানা হওয়ার জন্য নিরাকার শক্তির প্রতি প্রেমই একমাত্র মাধ্যম। তাসাওউফ দর্শন অনুযায়ী এই সাধনাকে ‘ তরিকত ’ বা আল্লাহ-প্রাপ্তির পথ বলা হয়। তরিকত সাধনায় মুর্শিদ বা পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন হয়। সেই পথ হলো ফানা ফিশ্শাইখ, ফানা ফিররাসুল ও ফানাফিল্লাহ। ফানাফিল্লাহ হওয়ার পর বাকাবিল্লাহ লাভ হয়। বাকাবিল্লাহ অর্জিত হলে সুফি দর্শন অনুযায়ী সুফি আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ শক্তিতে শক্তিমান হন। তখন সুফির অন্তরে সার্বক্ষণিক শান্তি ও আনন্দ বিরাজ করে। সুফিগণের মতে, হযরত মুহাম্মাদ (সা.) স্বয়ং সুফিদর্শনের প্রবর্তক। এর সপক্ষে সুফিগণ মুহাম্মাদ (সা.) এর একটি হাদিস উল্লেখ করেন যা হল, মানবদেহে একটি বিশেষ অঙ্গ আছে, যা সুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ পরিশুদ্ধ থাকে, আর অসুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ অপরিশুদ্ধ হয়ে যায়। জেনে রাখো এটি হলো কল্ব বা হৃদয়। আল্লাহর জিকর বা স্মরণে কল্ব কলুষমুক্ত হয়। সার্বক্ষণিক আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে কল্বকে কলুষমুক্ত করে আল্লাহর প্রেমার্জন সুফিবাদের উদ্দেশ্য। যাঁরা তাঁর প্রেমার্জন করেছেন, তাঁদের তরিকা বা পথ অনুসরণ করে ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ অর্জন করাই হলো সুফিদর্শন।
সুরা = সুরা হল আল কোরআনের এক একটা অধ্যায়ের নাম, তবে এটি সাধারণ পুস্তকের অধ্যায়ের মত নয় বরং বিশেষভাবে কেবল কোরআনের বৈশিষ্ট্যের জন্যই এর উৎপত্তি । কোরআনে মোট 114টি সুরা আছে। বিশ্বাসীরা মনে করেন, প্রতিটি সুরাই আল্লাহর বাণী এবং তাঁরই রচিত। সুরাগুলিতে কবিতাসুলভ গতিময়তা ও ব্যাঞ্জনানর্মী (অবিস্তারিতভাবে বর্ণিত) ঘটনার সমাহার লক্ষ্য করা যায়। ফলে যে কোন সাধারণ মেধার মানুষও 30 পারার সুবিশাল গ্রন্হটি মুখস্থ রাখতে পারেন।
💄 কবিতাটির মর্মার্থ ও ভাবসম্প্রসারণঃ- কবিতাটির মর্মকথাকে কেবল ব্যক্তিকেন্দ্রিকতায় আবদ্ধ না রেখে যদি সার্বিকভাবে মনুষ্যসমাজের দাম্পত্য তথা গার্হস্থ জীবনকে মাথায় রেখে উপলব্ধি করার চেষ্টা করি তাহলে বলা যায়, সেইসকল দয়িত-দয়িতার কথা যাঁরা পেশাগত অথবা বিচ্ছেদগত কারণে পরস্পর থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হন তাঁদেরই মনোবেদনা ও জীবনোপলব্ধির কথা ধ্বনিত হয়েছে কবিতাটিতে । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নাথ ঠাকুর বলেছেন'
"বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়
সহস্র বন্ধনমাঝে লভিব মুক্তির স্বাদ"
সহস্র বন্ধনের মধ্যে সর্বাধিক কাঙ্খিত ও গুরুত্বপূর্ণ বন্ধন বোধ হয় দুই নরনারীর প্রেমবন্ধন। যখন সেই বন্ধন প্রবল অনিচ্ছাতেও ছিন্ন (মানসিকভাবে না হলেও শারীরিকভাবে) করতে হয় তখন রাত যত গভীর হয় একাকীত্বের ছায়া তত দীর্ঘতর হতে থাকে। এভাবে বিদায়ের পর এক একটা দিন পার হতে হতে অষ্টম রাতে বিরহবেদনার তীব্রতা ভয়াবহরূপে অনুভূত হয় দয়িতার অন্তরে। মনে হতে থাকে এই প্রেমহীন জীবন মৃত্যুরই নামান্তর। আবেগের সুতো সুফি গানের রিদমের সাথে ওঠানামা করে। আমরা আগেই জেনেছি, সুফিবাদে শরীরের ভূমিকা নগন্য, আত্মার ভূমিকাই প্রধান। কিন্তু সাংসারিক মানুষের পক্ষে শরীরকে অস্বীকার করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। আবেগের দোলাচলে বিধ্বস্ত হ্য় মানবমন। কেবল শারীরিক মিলনের জন্য নয় নিজের অন্তরে গুমরে মরা হাজার অব্যক্ত কথারও যোগ্য শ্রোতা খোঁজে সে। যে তার ভাবনার সহমর্মী হবে, বুঝবে তার একান্ত ব্যথাবেদনা কামনা-বাসনার কথা। দূরভাষে তা কোনভাবেই পূর্ণ হওয়ার নয়। যাকে ছোঁয়া যায় না সে তো বেদেহী আত্মার মতই তার কাছে। আবার কাছে থেকেও মানসিক দূরত্ব তৈরী হতে পারে অনেক সময়। সেটি আরও দুঃসহ ও ভয়ংকর।কাব্যিক ব্যঞ্জনায় রিকসার পা-দানিতে পা রেখে একদা প্রেমিকের প্রেম-সত্ত্বা বিদায় নিয়েছে, এমনটিও ভাবা যেতে পারে। আর এমন পরিস্থিতিতেও মানসিকভাবে মৃত মনে হতে পারে নিজেকে।
মৃত্যুবৎ এই জীবদ্দশায় যখন "রোদের ভেতর রোদ আর আকাশের ভেতর দড়ি পাকানো তুলো" কথাটি উচ্চারিত হয় তখন বোঝা যায় আবেগের তীব্রতা কিভাবে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃশ্বেস করে দেয় মানবহৃদয়কে। রোদতো আশার প্রতীক। হতাশার মেঘ কেটে গেলেই তো রোদের আবির্ভাবে উদ্ভাসিত হয় আমাদের হৃদয়-আকাশ। তবে রোদের ভেতর রোদ কেন বলছি? কেননা, আমার আশাপূরণের মধ্যে তোমারও আশাপূরণ যে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে ছিল হে প্রিয়তম! আর সুতো ও দড়ি পাকানো তুলো তো সমার্থক । আবেগের সেই আষ্টেপৃষ্ঠে পাকানো সুতো আন্দোলিত হয়েছে কতবার এই হৃদয়-আকাশে। আজ সবই তোমার বিদায়ে স্মৃতিচিহ্ন হয়ে "উপুড় হয়েছে আমাদের কবরে" । এই কথা যখন কবি বলেন তখন প্রশ্ন জাগে 'আমাদের' বলতে কবি কাদের কথা বোঝাতে চাইছেন? নিজের আর দয়িতের কথা? প্রশ্নটা কবিতাটির ভিন্ন এক বক্তব্যের ইঙ্গিত বহন করছে মনে হল। তাহলে এতক্ষণের ব্যাখ্যা কি এক ভিন্ন পথে বয়ে গেল? সত্যিই, এ ধরণের কবিতা ব্যাখ্যার জন্য বেছে নেওয়া বেশ ঝুঁকিপূর্ণ । তবে, কবি যা-ই ভেবে লিখে থাকুন আমরা তা নিয়ে মাথা ঘামাতে যাব কেন? আমরা পাঠকেরা আমাদের মত বুঝব। পাঠকহিসাবেই এখন আমার মনে হচ্ছে কবিতাটিকে অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। আমাদের জীবনে মৃত্যু যেমন অবশ্যম্ভাবি তেমনই জীবৎকালেই যৌবনকালেরও মৃত্যু ঘটে। প্রৌঢ়ত্ব তথা বার্ধক্যের স্বাদ গ্রহণ করতেই হয়। তাই দুদিনের এই জীবন যেমন বলা যায় তেমনই বলা যায় দুদিনের যৌবন। যৌবন যেদিন বিদায় নেয় তারপর থেকেও একধরণের বিশেষ একাকীত্ব অনুভূত হতে পারে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমার এই ব্যাখ্যায় 'রিকসার পা দানিতে পা রেখে' বিদায় নিল কে এই প্রশ্নের উত্তরে দুরকম অনুমান উঠে এল। আবার এটাও হতে পারে , এ দুটির কোনটিই নয়, আসলে বিদায় নিয়েছে চিরতরে দয়িত। অর্থাৎ মৃত্যু হয়েছে তাঁর। কবিতো স্পষ্ট ভাবেই জানিয়েছেন, 'তোমার মৃত্যুর কিঞ্চিত আগে'।' অথবা এমনও হতে পারে, বিচ্ছেদ ঘটে গেছে দয়িত-দয়িতার মধ্যে, যা বহুকাল ধরে হামেশাই ঘটে চলেছে জগৎজুড়ে। তাই যদি হয় তাহলে কবিতার মধ্যে খুব বেশি কষ্টকল্পিত রহস্য খুঁজতে যাওয়া ঠিক নয়। কবিতার সার কথাটা উপলব্ধি করাই যুক্তিযুক্ত। সুদীর্ঘকাল একত্রে থাকার পর জীবনসঙ্গী বিদায় নিলে যে গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হয় তারই অনবদ্য কাব্যরূপ দিয়েছেন বিদগ্ধ কবি।
"আমরা শুধু বলেছি সুরা মনে করে
আর কোনো অকৃতজ্ঞতা নেই ঈশ্বর হে - "
লক্ষণীয় যে, সুরা মনে করে বলাকে ঈশ্বরের প্রতি একমাত্র অকৃতজ্ঞতা বলা হচ্ছে । অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এই কথা । কেননা, সুরা কেবল মুখস্থ করে আওড়ে যাওয়ার জন্য অবতীর্ণ হয়নি, আমল বা প্রাত্যহিক কর্মে সুরার অন্তর্নিহিত নির্দেশনামা পালিত হওয়া চাই । কিন্তু হে ঈশ্বর, তুমি এই সুন্দর জীবন ও যৌবন দান করেছো, তার সদ্ব্যবহারের উপায়ও বাতলে দিয়েছ সেজন্য আমি অশেষ কৃতজ্ঞ তোমার কাছে, কিন্তু এই পার্থিব পাঁজরে কামনা বাসনার যে অন্ত নেই , তাই সর্বদা হ্য়তো তোমার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে পারিনি, সুরা কেবল মনে করে বলেছি কিন্তু আমল করতে পারিনি, এটিই আমার একমাত্র অকৃতজ্ঞতা হে ঈশ্বর, সেজন্য আমাকে ক্ষমা কোরো। আর একবার যদি পাঠাও তবে পাঠিও অপার্থিব পাঁজরে; তাহলে অকৃতজ্ঞতার কোন নিদর্শন আমি রাখব না। যদিও ইসলামী দর্শনে পুনর্জন্মকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তবে মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ পার্থিব শরীরের মৃত্যু ঘটলেও আত্মার মৃত্যু হয় না, আত্মা *অবিনশ্বর ।
পরিশেষে এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায়, এমন কবিতার মৃত্যু হয়না। কাব্যজগতে সুদীর্ঘকাল ধরে সগর্বে বিরাজ করে।
----'----
* আত্মা অবিনশ্বর । কথাটি এতদিন কেবল বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে ছিল । কিন্তু সাম্প্রতিকতম এক গবেষণায় দাবি করা হয়েছে যে, মানুষের মৃত্যুর পরও তার যাবতীয় ক্রিয়া কর্মের রেকর্ড এই মহাবিশ্বের কোন এক অদৃশ্য মেমোরীহোল্ডারে গচ্ছিত থাকে।