ভূমিকা;- কবিরা কি আর পাঁচজনের থেকে আলাদা? তারা কি মাটি থেকে একটু উপরে বাস করে? প্রশ্নটা সাধারণ পাঠকের মনে উঁকি দিলেও দিতে পারে। সত্যিই তো, কবিদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের একটা সমীহ জাগানো ধারণা থাকতেই পারে। যখন সেই ধারণার বাত্যয় ঘটে তখন এক ধরনের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা অনুভূত হয়। অথচ কবিতা লেখার সময়টুকু ছাড়া কবিরাও যে আর পাঁচজনের মতো রুক্ষ মাটি দিয়েই হাঁটে সেই কথাটা মনে রাখলে স্বপ্নভঙ্গের অকারণ কষ্টটা ভোগ করতে হয় না। আর তখনই আমরা বুঝে নিতে পারি যে একজন কবিও আর পাঁচ জনের মতই দোষে-গুণে ভরা মানুষ। এখন প্রশ্ন হলো, মানুষ কত প্রকার? নানা দৃষ্টিকোণ থেকে নানাভাবে হয়তো ভাগ করা যেতে পারে, কিন্তু আমি এখানে দুই প্রকার মানুষের কথা বলতে চাই। আমরা জানি যে, মানুষমাত্রই ভুল করে। এটা প্রমাণিত ও প্রচলিত একটি কথা। ভুল তো অবশ্যই একটি দোষ। দোষের মধ্যে আর কি কি পড়ে? যদি ছোট মেজ ও বড় ক্রমান্বয়ে বলতে হয় তাহলে বলা যায় ভুল,অপরাধ ও পাপ। না জেনে না বুঝে যেটা করা হয় সেটাকে আমরা বলি ভুল। আর জেনে বুঝে অন্যায় করলে সেটা হলো অপরাধ। আর অপরাধ ধরা পড়ার পর ,আর করবে না প্রতিশ্রুতি দিয়েও আবার একই অপরাধ করার নাম পাপ। ভুলের ক্ষমা আছে, লঘু অথবা প্রথমবারের জন্য অপরাধও ক্ষমা করা যেতে পারে যদি সে অনুতপ্ত হয় এবং পুনরাবৃত্তি ঘটবে না এমন প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু পাপের কোন ক্ষমা নেই। পাপের ধরণ অনুযায়ী শাস্তি তাকে পেতেই হবে।

     তাহলে এই দৃষ্টিকোণ থেকে দু ধরনের মানুষ চোখে পড়ে।
১) ভুল বা অপরাধ উপলব্ধির পর আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত ও লজ্জিত মানুষ, দ্বিতীয়বার সে পথে পা রাখেন না।(এদের হাত ধরা যেতে পারে)
২) অপরাধ স্বীকার করা তো দূর পরন্তু অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে বা হাস্যকর অজুহাত খাড়া করে নিজেকে সাধু প্রতিপন্ন করার ব্যর্থ প্রচেষ্টাকারী মানুষ। এরা কখনো শোধরায় না। অপরাধপ্রবণতা এদের মজ্জাগত।(এদের থেকে শতহস্ত দূরে থাকাই শ্রেয়)


       আলোচ্য কবির অন্য কোন কবিতাই পাঠ করা হয়ে ওঠেনি আমার। এই কবিতাটাই প্রথম চোখে পড়লো। পাঠ করার পর বুঝলাম, বেশ শক্তিশালী কলম।
      
           ফণা কৈ

চাবুকের ছেড়া দড়িটা যত্ন করে গুছিয়ে রেখো
সলতে পাকাতে কাজে লাগবে
দগদগে ঘায়ে প্রলেপ লাগানোটা,
একটু বেশি আদিখ্যেতা নয়তো?
দরকার নেই কামিজের নীচে লুকিয়ে ফেলেছি!
শুধু লবণের কৌটাটা একটু দূরেই রেখো!
বাতাসেরও ও গতি আছে
যদি পথ ভুলে যায়।
এখনও ফ্যালফ্যাল করে ভাবি
আমি কি সত্যিই অস্তিনের সাপ?
তবে ফণা কৈ?
বিষের জ্বালা বা অনুভব করিনি কেন?
মার খেলে নাকি বেশি বেশি খিদে পায়
আমারও বড্ড খিদে পেয়েছে
হাঁড়িতে একমুঠো চাল সেদ্ধ করে নিই
নুন দিয়ে খেলে বল পাবো গতরে
কি জানি আগামীতে কি লেখা আছে নসিবে!!

          ব্যাখ্যা :- আলোচ্য কবিতাটির কথক পূর্বকৃত অপরাধের শাস্তি হিসাবে চাবুকরূপী অপ্রিয় কথার কষাঘাত পূর্বেই সহ্য করেছেন। কষাঘাতকারীকে চাবুকের সেই ছেঁড়া দড়িটা যত্ন করে রেখে দিতে বলছেন ক্ষত বিক্ষত কথক। সলতে পাকানোর কাজে লাগতে পারে। এমন বেদনামিশ্রিত শ্লেষ একজন দক্ষ কবির পক্ষেই এভাবে প্রকাশ করা সম্ভব। যা পাওয়ার তা তো পাওয়া হয়েই গেছে, শান্ত্বনার প্রলেপের আর প্রয়োজন নেই। কামিজের নিচে দগদগে ঘা লুকিয়ে ফেলার এই উপমাটা সত্যিই অসাধারণ। সমব্যথীর আর প্রয়োজন নেই তার। নিজের যন্ত্রণা নিজেই সয়ে নেবেন তিনি। এখানে অপরাধের শাস্তি সহজভাবে মেনে নেওয়া ও অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হওয়ার ইঙ্গিত প্রকাশ পেয়েছে। শুধু একটাই অনুনয়, লবণের কৌটোটা একটু দূরেই রেখো। নইলে বাতাসের যা গতিপ্রকৃতি হয়তো কামিজের ফাঁক গলে দগদগে ঘায়ের উপর উড়ে আসতে পারে। সেই যন্ত্রণার হাত থেকে অন্তত মুক্তি দিও।

             শাস্তি পাওয়ার পর একান্তে কথক নিজের অপরাধ নিজেই মাপতে বসে। সত্যিই কি সে আস্তিনের সাপ ছিল? তাই যদি হবে তাহলে ফণা কোথায়?  দক্ষতার সাথে উপমার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন কবি এখানেও। অর্থাৎ কথক যে তেমন ভয়ঙ্কর নন বরং নিরীহ একজন মানুষ সেটাই বোঝাতে চেয়েছেন।

         'মার খেলে নাকি বেশি বেশি খিদে পায়
আমারও বড্ড খিদে পেয়েছে'! কথকের মর্মবেদনা দারুন ভাবে প্রকাশ পেয়েছে এখানে। তবু হাঁটতে হবে অনেকটা পথ। সেজন্য গতরে বল দরকার। নুনভাত খেয়ে সেই বল অর্জন করতে হবে। খুব সচেতনভাবে নুনভাতের কথা লিখেছেন কবি। অর্থাৎ বোঝাতে চেয়েছেন, কথকের মধ্যে অপরাধপ্রবণতার কোন আভিজাত্য নেই, বরং নিতান্তই আটপৌরে জীবন যাপনের সাদাসিধা একজন মানুষ তিনি।
"কি জানি আগামীতে কি লেখা আছে নসিবে" -এটি কবিতার শেষ পংক্তি। অর্থাৎ আগামীতে আরো লাঞ্ছনা অপেক্ষায় আছে কিনা সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন। এই অনিশ্চয়তাই তো প্রতিটি মানুষের স্বাভাবিক সঙ্গী।

     *কবিতায় ছেঁড়া বানানটিতে চন্দ্রবিন্দু দেওয়া আবশ্যক। আস্তিন বানানটাও ভুল (টাইপো)আছে। আর বাতাসেও কথাটির পর আরো একটি অতিরিক্ত 'ও' অক্ষর আছে। ওটা বাদ দেওয়া দরকার।