প্রাককথনঃ- আজ আলোচনার জন্য একটি সনেট-কবিতা বেছে নিয়েছি। সুতরাং মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে সনেট সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা যাক।আমরা সকলেই জানি, সনেটের আমদানি বিদেশ থেকে। ইতালীয় কবি পেত্রার্ক এর উদ্ভাবক। পরে আরও অনেকেই (শেকসপীয়ারসহ) বিভিন্ন ধারায় সনেট রচনা করলেও পেত্রার্কীয় ধারার সনেটকেই 'আদর্শ সনেট' বলে অভিহিত করতে মন চায়। সনেট এক ধরণের চতুর্দশপদী কবিতা হলেও সব চতুর্দশপদী কবিতা কিন্তু সনেট নয়। আদর্শ সনেটে সুনির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। প্রতিটি পঙক্তিতে থাকবে ১৪টি অক্ষর। প্রথম স্তবকের আট পঙক্তিকে অষ্টক ও দ্বিতীয় বা শেষ স্তবকের ছয় পঙক্তিকে ষটক বলা হয়ে থাকে। কিন্তু আট আর ছয় পঙক্তিতে ভাগ করলেই যে সেটিকে সনেট বলা যাবে, তা কিন্তু নয়। অষ্টক ও ষটকেরও আছে সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য।
অষ্টকের ১ম চতুষ্কে থাকবে বক্তব্যের প্রস্তাবনা এবং ২্য় চতুষ্কে থাকবে তার কারণ বা বিশ্লেষণ। আর ষটকের ১ম ত্রিপদিকায় থাকবে বিষয়ের পরিপূরকহিসাবে বিপরীত বা অপর দিকের বর্ণনা। ২য় ত্রিপদিকায় সমগ্র ভাববস্তুর মীমাংসা বা উপসংহার। সনেটের এই বিশেষত্বের জন্য অনেকেই একে নদীর সাথে তুলনা করে থাকেন। নদী যেমন ঢেঊ ওঠায় আবার পরক্ষণে নামিয়ে আনে, এভাবে চলতে চলতে সাগরে মিশে বিলীন হয়ে যায় অর্থাৎ লক্ষ্যে পৌঁছে যায়, সনেটও অনেকটা এরকমই। অনেকেই বলে থাকেন, কেউ যদি সার্থক সনেট রচনা করতে পারেন তাহলে তাঁর কবি-প্রতিভা সম্পর্কে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না।
--------------------
আমাকে বাঁচাও
-অজিত কুমার কর
---------------------
এ কী রুদ্ররূপ দেখি প্রকৃতি তোমার
নিমেষে বিলীন হ’ল কত ঘরবাড়ি
অকালে শতেক প্রাণ নিলে তুমি কাড়ি।
উত্তর অজানা নয়, সব দায়ভার
শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের, কর্মফল তার;
অন্ধকারে ঢেকে যাবে খুব তাড়াতাড়ি
যদি না সজাগ হয় দিতে হবে পাড়ি
শীঘ্র এ ধরণি ছেড়ে, পাবে না নিস্তার।
ভাবে কি কখনো কেউ প্রকৃতির কথা
যখন যা খুশি করে মানে না নিয়ম
দিয়ে চলে নিরন্তর তার প্রাণে ব্যথা
পরিণাম ভয়ংকর বন্ধ হবে দম।
রক্ষণাবেক্ষণটুকু মানুষের দায়
তবেই ফিরবে ধরা পূর্ব মহিমায়।
-------------------------------
কবিতাটির অন্ত্যমিল প্রথম স্তবকে ১/৪/৫/৮ ও ২/৩/৬/৭
এবং দ্বিতীয় স্তবকে ১/৩, ২/৪ ও ৫/৬
শিরোনামঃ- এখানে আমাকে বলতে পৃথিবীকে বোঝানো হয়েছে। সুতরাং বলা যেতেই পারে সার্থক শিরোনাম।
১ম চতুষ্কঃ- প্রকৃতির রুদ্ররূপে ধ্বংস হয় ঘর-বাড়ি, অকালে ঝরে পড়ে তরুণ-তাজা প্রাণ। পাঠক সহজেই কবির বক্তব্য বুঝে যান। তিনি যে প্রকৃতির রুদ্ররূপ ও তার পরিণতি সম্পর্কে পাঠককে সজাগ করে দিতে চান, সেটি বুঝতে কোন অসুবিধা হয় না পাঠকের।
২য় চতুষ্কঃ- প্রকৃতির এই রুদ্ররূপের কারণ হিসাবে কবি এই গ্রহের শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের কর্মফলকেই দায়ী করেছেন।
১ম ত্রিপদিকাঃ- মানুষ কোনরকম নিয়মের তোয়াক্কা না করে যা খুশি তাই করে চলে। অর্থাৎ পাঠকের বুঝতে কোন অসুবিধা হয় না যে, ইচ্ছামতো বৃক্ষছেদন, মোটরগাড়ি-কল-কারখানার ধোঁয়া উদ্গিরণ, জলাশয়-ভরাট, ভূ-গর্ভের জল উত্তোলন, শব্দ-দূষণ ইত্যাদির প্রতিই কবি ইঙ্গিত করেছেন।
২য় ত্রিপদিকাঃ- এভাবে চলতে থাকলে অর্থাৎ প্রকৃতির প্রাণে ব্যথা দিতে থাকলে পরিণাম হবে ভয়ংকর। এ থেকে বাঁচার কি কোন উপায়ই নেই? কবি বলছেন, আছে। মানুষের যদি হুঁশ ফেরে, প্রকৃতির রক্ষণাবেক্ষণ শুরু করে, একমাত্র তাহলেই আবার পূর্ব মহিমায় ফিরে আসতে পারে আমাদের এই সাধের বসুন্ধরা।
উপসংহারঃ- বহুদিন ধরেই পরিবেশ-রক্ষাবিষয়ক অজস্র প্রবন্ধ-কবিতা রচিত হয়ে আসছে, অজস্র বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে ক্ষমতাধর শাসকদের মধ্যে, তবু আজও বিন্দুমাত্র অবস্থান্তর ঘটেনি। বরং আজকের এই ভোগসর্বস্ব পৃথিবীতে মানুষ যেভাবে প্রকৃতিকেও ভোগের সামগ্রী বানিয়ে ফেলছে তাতে এখনই সাবধান না হলে পরিণতি যে ভয়ংকর হবেই সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। কাজেই লাগাতার প্রচার-প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতেই হবে। এই কবিতাটি বেছে নেওয়ার পিছনে এটিও একটি কারণ। তাই সময়োপযোগী এমন একটি কবিতা উপহার দেওয়ার জন্য কবিকে জানাই অন্তরোৎসারিত ধন্যবাদ ও অভিনন্দন।