💄👓🔰💄👓🔰💄👓🔰💄👓🔰💄👓🔰💄👓💄
💄কবিতার বহিরঙ্গ কবিতার মতই হওয়া উচিত বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। নারীকে যেমন নারীসুলভ পোশাকেই বেশি মানায়, তেমনই কবিতার সৌন্দর্যও অনেকটাই বৃদ্ধি পায় ছন্দময়তায়। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নানাবিধ প্রেক্ষাপটের প্রভাবে ছন্দ ভাঙার একটা হিড়িক তথা হুজুগ উঠেছিল বটে, কিন্তু সেটাকে আজও টেনে নিয়ে যাওয়ার কোন অর্থ আছে বলে আমি মনে করি না। তাছাড়া একালের কবিতা-রচয়িতাদের, বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত ও নবপ্রজন্মের মানসিকতার দিকটিকেও মাথায় রাখা উচিত বলে আমি মনে করি। আমরা কেউ কেউ বলে থাকি, নিজের জন্য কবিতা লিখি। সত্যিই কি তাই? তাহলেতো নিজের ডায়েরির পাতাতেই লিখে রাখা যেত। আসলে আত্মপ্রকাশের তীব্র বাসনাই কবিতার জন্ম দেয়। নিজের অনুভূতি পাঠকের সাথে শেয়ার করার জন্যই আমরা কবিতা লিখি। তাই পাঠকের কথা অবশ্যই মাথায় রাখা দরকার। যদিও সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি, একথা যেমন সত্যি, তেমনই সকলেই পাঠক (বোদ্ধা ) নয় কেউ কেউ পাঠক, একথাটাও সমানভাবে সত্যি।
💄ইদানিং কবিতায় 'দুর্বোধ্যতা' কতদূর সঙ্গত তাই নিয়ে প্রায়ই বিতর্কের ঝড় উঠতে দেখি। দুপক্ষই যে যার অবস্হানে অনড়। 'দুর্বোধ্যতা' বিষয়টি আপেক্ষিক, কথাটা মেনে নিয়েও বলছি, পাঠককে পরীক্ষার্থী ভাবাটাকে আমি সমর্থন করি না। যেসব খ্যাতনামা কবির কবিতায় আপাত দুর্বোধ্য শব্দসমাবেশ দেখি সেগুলো একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, কত নিপুণভাবে অর্থময় উপমার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন তাঁরা। কেননা, তাঁরা প্রকৃত শব্দশিল্পী। শব্দ তাঁদের সাধনাক্ষেত্র । রীতিমত গবেষণা চালান কোন একটি অভিনব শব্দ
প্রয়োগের আগে। সস্তায় বাজিমাত করার চেষ্টা করেন না। শুধুমাত্র পাঠককে চমকে দেওয়ার মানসিকতা নিয়েও তাঁরা সেটি করেন না। কাজেই, আপাত দুর্বোধ্য অভিনব শব্দের প্রয়োগ ঘটানো যেতে পারে, যদি তা প্রাসঙ্গিক ও অর্থময় হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় কবিদের ভিড়ে মিশে থাকে কিছু অকবির দল। আমাদের প্রিয় কবি ও এডমিন বোদরুল আলম মহাশয়ের ভাষায়, 'কেউ কেউ কবিতা লেখেন, আবার কেউ কেউ কবিতার মত করে কিছু লেখেন।' এই শেষোক্তরা কবিতা-পাঠকের কবিতাপ্রেমে অন্তরায় হয়ে উঠছে। অথচ আমরা সকলেই চাই ভোগবাদের এই সন্ধিক্ষণে নবপ্রজন্মকে আরও বেশি বেশি কবিতার মত সুস্হ জগতে টেনে আনতে। তাই সস্তায় বাজিমাত করতে চাওয়া অকবিদের মুখোশ খোলাটা জরুরি। আর সেকারণেই এই ধরণের অদ্ভুতুড়ে শব্দপ্রয়োগকারী স্বঘোষিত কবিদের(?) উদ্দেশ্যেই একটি আলোচনায় ব্যাখ্যা চাওয়ার কথা বলেছিলাম। প্রকৃত শব্দশিল্পী কবিদের উদ্দেশ্যে নয়। আশার কথা, আমাদের এই আসরেও বেশকিছু শব্দশিল্পী আছেন। তবু, জানি না কেন, অনেকেই বক্তব্যটাকে 'সকল কবির উদ্দেশ্যে' বলে ধরে নিয়েছিলেন।
🔰💄👓🔰💄👓🔰💄👓🔰💄👓🔰💄👓🔰💄
যতি, যতিলোপ ও ছন্দ-নির্ণয়ের উপায়
🔰💄👓🔰💄👓🔰💄👓🔰💄👓🔰💄👓🔰💄
🔰যতি💄আমরা জানি ছন্দবদ্ধ (হতে পারে প্রচলিত অথবা স্বসৃষ্ট) রচনার নামই কবিতা। আর সেই জন্যই কবিতাকে যাতে কবিতার মতই পাঠ করতে পারে পাঠক , সেব্যাপারে রচয়িতাকে সদা সজাগ থাকতে হয়। প্রয়োজন হয় পাঠককে মাঝে মাঝে একটুখানি থামার সুযোগ দেওয়া । দাঁড়ি, কমা ইত্যাদি যতিচিহ্ন ছাড়াও পাঠসুষমা সৃষ্টির জন্য অন্যত্রও থামার প্রয়োজন হয়। এই থামার জায়গাগুলোকেই বলা হয় যতি । যদিও পাঁচ রকমের যতির কথা বলা হয়ে থাকে, তথাপি আমি কেবল তিন রকম যতির কথাই বলব। কারণ অন্য দুটি যতির তেমন গুরুত্ব নেই ।
1) 🔰লঘুযতি বা পর্বযতি💄কোন একটি কবিতাপাঠ শুরু করার পর প্রথম আমরা যেখানে যৎসামান্য থামি , সেটাই হল পর্ব । দেখা যায় যে, নির্দিষ্ট সংখ্যক ধ্বনি উচ্চারণের পরই এভাবে আমাদের যৎসামান্যক্ষণ থামতে হয়। তারপর এই ধারা বজায় থাকে গোটা কবিতাটিতে। এধরণের থামাকেই বলা হয় লঘুযতি বা পর্বযতি । যেমন--
'রাগ চড়ে/ মাথায় আমার/ আমি তার/ মাথায় চড়ি;
বাপব্যাটা/ দু-ভাই মিলে/ সারা পাড়া/ মাথায় করি।'
--- জয় গোস্বামী (আধুনিক কবি)
/ চিহ্নিত জায়গাগুলিতে আমরা যৎসামান্য থামি। এগুলিই হল লঘুযতি বা পর্বযতি ।
2) 🔰অর্ধযতি বা পদযতি💄পর্বযতি অপেক্ষা আর একটু বেশিক্ষণ যেখানে থামতে হয় সেটিকে বলা হয় অর্ধযতি বা পদযতি। যেমন--
'শৈবাল দিঘীরে বলে💈উচ্চ করি শির--
লিখে রেখো এক ফোঁটা💈দিলেম শিশির।'
-- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
💈চিহ্নিত জায়গাগুলিতেও আমাদের থামতে হয়। এগুলিই হল পদযতি।
3)🔰পূর্ণ যতি বা পঙক্তিযতি💄প্রচলিত অর্থে আমরা যাকে পঙক্তি বলি, সেটা ঠিক নয়। ছন্দের পঙক্তি কবিতার একটি সারি নিয়ে যেমন তৈরি হতে পারে, আবার একাধিক সারি নিয়েও তৈরি হতে পারে। যাইহোক, কবিতাপাঠের সময় আমাদের জিহ্বা যেখানে যেখানে পূর্ণ বিশ্রাম পায় সেইসব জায়গাগুলোকেই বলা হয় পূর্ণযতি বা পঙক্তিযতি। যেমন--
মনের মধ্যে ভাবনাগুলো ধুলোর মতো ছোটে👔
যে কথাটা বলব সেটা কাঁপতে থাকে ঠোঁটে👔
-- শঙ্খ ঘোষ (আধুনিক কবি )
এখানে প্রতিটি সারির শেষেই পড়েছে পূর্ণযতি। কেননা, এখনেই আমাদের জিহ্বা পূর্ণ বিশ্রাম পায়। অর্থাৎ এই দৃষ্টান্তটিতে আছে দুটি পঙক্তি । তবে পূর্ণযতি যে সব কবিতাতেই ছত্রের শেষে পড়বে এমন কোন কথা নেই । যেমন--
মাঘের সূর্য উত্তরায়ণে
পার হয়ে এল চলি।👔
তারপানে হায় শেষ চাওয়া চায়
করুণ কুন্দ কলি।👔 -(রবীন্দ্রনাথ)
👔চিহ্নিত জায়গাগুলিতেই আমাদের জিহ্বা পূর্ণ বিশ্রাম পায়। এগুলিই হল পূর্ণযতি বা পঙক্তিযতি।
তাহলে দেখা গেল যে, কবিতাটির চার সারিতে পঙক্তি পাওয়া গেল দুটি (মাঘের---চলি এবং তারপানে----কলি)।
💄সুতরাং কবিতার প্রতিটি সারিকে পঙক্তি অথবা চরণ না বলে 'ছত্র' ('সারি'র প্রতিশব্দ) বলাই বাঞ্ছনীয়। 'চরণ' বলা কেন সঙ্গত নয় সে ব্যাপারে দুজন ছন্দবিদের দুরকমের মত তুলে ধরা যেতে পারে--
💄 ছন্দবিদ অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় ও তাঁর অনুসারী ছান্দসিকরা কবিতার এক-একটি সারিকে পঙক্তিনামেই অভিহিত করেছেন এবং পূর্ণযতি দ্বারা চিহ্নিত অংশগুলিকে অভিহিত করেছেন চরণ নামে, কিন্তু আচার্য প্রবোধচন্দ্র সেনের যুক্তিটাই আমার কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে। তাঁর মতে, চরণ আর পদ সমার্থক শব্দ। দুটি সমার্থক শব্দকে দুটি ভিন্ন পারিভাষিক অর্থে প্রয়োগ আদর্শসম্মত নয়। তাতে বিভ্রান্তির আশঙ্কা থাকে ।
( ছন্দ-পরিক্রমা, 2য় সংস্করণ,1977/ প্রবোধচন্দ্র সেন)
তাছাড়া পদ সম্পর্কে জানলে আর চরণ সম্পর্কে আলাদা করে আলোচনার প্রয়োজন পড়ে না।
🔰💄👓🔰💄👓🔰💄👓🔰💄👓🔰💄👓🔰💄
🔰যতিলোপ💄ছন্দময় রচনার ক্ষেত্রে যতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তা সত্ত্বেও ছান্দসিকরা অনেক সময়েই যথাযথ যতির প্রয়োগ ঘটাতে সক্ষম হন না। কবিতার বক্তব্য যাতে ক্ষুন্ন না হয় এবং উপযুক্ত প্রতিশব্দ না মেলায়, এরকমটি ঘটে থাকে অনেক সময়। যতির এই অভাবকে বলা হয় যতিলোপ । অনেক সময় একে যতিলঙ্ঘনও বলা হয়ে থাকে । এসব ক্ষেত্রে পর্ব নির্ণয় করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে । কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে--
🔰লঘুযতি বা পর্বযতি লোপ💄 এই লঘুযতি বা পর্বযতি লোপের গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি । কেননা, এই যতি দ্বারাই নির্দেশিত হয় পর্ব । লঘুযতি লোপের ব্যাপারটি ঠিকমতো বুঝতে না পারলে ছন্দ-নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ও পর্ব বিভাজনের ক্ষেত্রে ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে । যেমন--
ক) "তৃণহীন সুকঠিন বিদির্ণ ধরা
রৌদ্র-বরন ফুলে কাঁটাগাছ ভরা।"
::-(নিষ্ফল উপহার, রবীন্দ্রনাথ)
প্রথম ছত্রে কোন অসুবিধা নেই । ছত্রটি সহজেই আমরা এভাবে পর্ব বিভাজন করতে পারি -
(যেহেতু 'তৃণহীন' ধ্বনিগুচ্ছটি উচ্চারণের পরেই আমরা থামতে পারছি, সুতরাং এটিই হল পর্ব )
"তৃণহীন /সুকঠিন/ বিদির্ণ/ ধরা 4+4+4+2
কিন্তু 2য় ছত্রের এক জায়গায় লঘুযতির লোপ ঘটেছে। কোথায়? দেখুন--
রৌদ্র-ব👔রন ফুলে /কাঁটাগাছ/ ভরা। 4+4+4+2
--বুঝতেই পারছেন, 'রৌদ্র ব'-এর পরে লঘুযতি বা পর্বযতি প্রত্যাশিত ছিল । কিন্তু যতিটি স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারেনি। অর্থাৎ এখানে যতিলোপ ঘটেছে। 💄তাহলে বুঝতেই পারছেন, কবিগুরুর মতো মহান কবিও ক্ষেত্রবিশেষে যতিলোপ ঘটাতে বাধ্য হন।
খ) নারীকে আ👔পন ভাগ্য/ জয় করি/বার
কেন নাহি/ দিবে অধি/কার
হে বিধাতা । -(রবীন্দ্রনাথ )
গ) লাঙল কাঁ👔দিয়া বলে/ ছাড়ি দিয়ে/ গলা,
তুই কোথা/ হতে এলি/ ওরে ভাই/ ফলা।
👔চিহ্নিত জায়গাগুলিতেই লঘুযতি বা পর্বযতির লোপ ঘটেছে ।
🔰অর্ধযতি বা পদযতি লোপ💄অর্ধযতি লোপের ঘটনা বিরল হলেও ক্ষেত্রবিশেষে ঘটে থাকে । সেক্ষেত্রে পদগুলোকে চিহ্নিত করা মুশকিল হয়ে পড়ে এবং ছন্দপতনেরও আশঙ্কা থেকে যায়। কবিগুরুর রচনা থেকেই কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক--
ক) দুঃখে সুখে / বেদনায়/ বন্ধুর যে/ পথ ,
সে-দুর্গমে/ চলুক প্রে👔মের জয়/রথ।
(উজ্জীবন, মহুয়া)
খ) নিজ হস্তে নির্দয় আ👔ঘাত করি/ পিতঃ
ভারতেরে / সেই স্বর্গে/ কর জাগ/রিত।
(নৈবেদ্য )
গ) কাল বলে/ আমি সৃষ্টি/ করি এই/ ভব
ঘড়ি বলে/ তাহলে আ👔মিও সৃষ্টি তব।
(উপলক্ষ, কণিকা)
👔চিহ্নিত জায়গাগুলিতেই পদযতির অবলুপ্তি ঘটেছে । কারণ এই জায়গাগুলিতে পাঠককে নিয়মমাফিক পদান্তে থামার সুযোগ দিতে পারেননি কবি।
🔰পূর্ণযতি লোপ💄আমরা জানি যে, পূর্ণযতি পড়ে পঙক্তির শেষে। সুতরাং যেসব কবিতায় পঙক্তিগুলির সীমা নির্দিষ্ট , সেসব কবিতায় পূর্ণযতিলোপের ঘটনা ঘটে না। অর্থাৎ প্রচলিত রীতিতে রচিত কবিতায় এ ধরণের যতিলোপ ঘটতে পারে না। সাধারণত প্রবহমান ছন্দে লিখিত কবিতাতেই পূর্ণযতিলোপ ঘটে থাকে ।
যেমন --
"সম্মুখ সমরে পড়ি বীর-চূড়ামণি
বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে
অকালে, কহ, হে দেবী অমৃতভাষিণী,
কোন্ বীরবরে বরি সেনাপতি-পদে,
পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি
রাঘবারি?"
মধুসূদন দত্তের 'মেঘনাদবধ কাব্যের' ' এই অংশটিতে পঙক্তিশেষে পূর্ণযতি লঙ্ঘিত হয়েছে। যতি পড়েছে ভাব অনুযায়ী । এই ধরণের রচনাকে পঙক্তিযতিলঙ্ঘক কবিতাও বলা যেতে পারে।
💄আশা করি, এতক্ষণে যতিলোপ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পেরেছন। তবু যদি কোন অস্পষ্টতা থেকে যায়, প্রশ্ন করতে পারেন নির্দ্বাধায়।
🔰💄👓🔰💄👓🔰💄👓🔰💄👓🔰💄👓🔰💄
পর্ব-বিভাজন ও ছন্দরীতি-নির্ণয়ের পদ্ধতি
🔰💄👓🔰💄👓🔰💄👓🔰💄👓🔰💄👓🔰💄
💄আমরা জেনেছি যে, কবিতাপাঠের সময় প্রথমেই কয়েকটি ধ্বনিগুচ্ছ উচ্চারণের পর পাঠসুষমা বজায় রাখার জন্য আমাদের সামান্যক্ষণ থামতে হয়। প্রথম যেখানে থামি সেটিই হল গোটা কবিতার 'পূর্ণপর্ব'-এর রূপ। ( ব্যতিক্রম অতিপর্বসমন্বিত কবিতা)। এই পূর্ণপর্ব চিহ্নিত করতে পারলেই ছন্দ-চেনা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। অর্থাৎ ছন্দ-চেনার জন্য প্রথমেই যেটি দরকার সেটি হল পূর্ণ পর্ব চিহ্নিত করা। যেমন--
ক) "ঈশানের পুঞ্জমেঘ অন্ধবেগে ধেয়ে চলে আসে
বাধাবন্ধহারা"
--এই ছত্রদুটি কোন্ ছন্দে রচিত হয়েছে সেটি জানার জন্য প্রথমেই এর পূর্ণপর্বটি চিহ্নিত করতে হবেঃ-
'ঈশানের ' -এই ধ্বনিগুচ্ছটি উচ্চারণের পরেই আমরা থামতে পারছি। সুতরাং এটিই পূর্ণ পর্ব। এবার বিভিন্ন রীতিতে পর্বগুলির মাত্রাবিশ্লেষণ করে দেখা যাক।
ঈশানের= ঈ+শা+নের্= 1+1+1=3 মাত্রা (স্বরবৃত্তে)
=1+1+2=4 মাত্রা (মাত্রাবৃত্তে)
= 1+1+2=4 মাত্রা (অক্ষরবৃত্ত)
পুঞ্জমেঘ = পুন্+জ+মেঘ্ = 1+1+1=3 (স্বরবৃত্তে)
= 2+1+2=5 (মাত্রাবৃত্ত)
= 1+1+2=4 (অক্ষরবৃত্তে)
এবার তিনটি ছন্দরীতিতেই ছত্রদুটির পর্ব-বিভাজন করে প্রতিটি পূর্ণপর্বের মাপ দেখা যাক---
স্বরবৃত্তেঃ-
ঈশানের/পুঞ্জমেঘ/ অন্ধবেগে/ধেয়ে চলে/ আসে 3+3+4+4+2
বাধাবন্ধ👔হারা" 4+2
মাত্রাবৃত্তেঃ-
ঈশানের/পুঞ্জমেঘ /অন্ধবেগে/ ধেয়ে চলে/আসে 4+5+5+4+2
বাধাবন্ধ👔হারা" 5+2
অক্ষরবৃত্তেঃ-
ঈশানের/পুঞ্জমেঘ/অন্ধবেগে/ধেয়ে চলে/আসে 4+4+4+4+2
বাধাবন্ধ👔হারা 4+2
** ছন্দবদ্ধ কবিতার ক্ষেত্রে দুটি শর্ত অবশ্যই পালনীয় --
♊(1) পূর্ণপর্বগুলির মধ্যে অবশ্যই সমতা থাকতে হবে।
♊(2) পূর্ণপর্ব কখনই চারমাত্রার কম হতে পারবে না।
তাহলে দেখা যাক, এক্ষেত্রে কোন্ ছন্দরীতিতে শর্তদুটি পুরণ হচ্ছে--
স্বরবৃত্তে পূর্ণ পর্বগুলি কোথাও 3 আবার কোথাও 4 মাত্রার হচ্ছে। অর্থাৎ সমতা নেই । তাছাড়া পূর্ণ পর্ব কখনোই 3 মাত্রার হতে পারে না। সুতরাং নির্দ্বিধায় বলা যায় , ছত্রদুটি স্বরবৃত্তে রচিত নয়।
আবার মাত্রাবৃত্তে পর্বের মাপ কোথাও 4 ও কোথাও 5 হচ্ছে। সমতা নেই। সুতরাং ছন্দটি মাত্রাবৃত্তও নয়।
অক্ষরবৃত্তে পূর্ণ পর্বগুলি সর্বত্রই 4 মাত্রার, অর্থাৎ সমমাপের। তাহলে দেখা গেল যে, একমাত্র অক্ষরবৃত্ত রীতিতেই দুটি শর্তই পুরণ হচ্ছে।সুতরাং কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত (বা মিশ্রকলাবৃত্ত) ছন্দে রচিত।
💄 খ) "দুন্দুভি বেজে ওঠে ডিম ডিম রবে
সাঁওতাল পল্লীতে উৎসব হবে।"
এখানে 'দুন্দুভি' বলার পর একটু থামি, তারপর আবার 'বেজেওঠে'র পরেও থামতে পারি। সুতরাং পর্ব চিহ্নিত করা গেল সহজেই।
দুন্দুভি=দুন্+দু+ভি=1+1+1=3 (স্বরবৃত্তে)
=দুন্+দু+ভি=2+1+1=4 (মাত্রাবৃত্তে)
=দুন্+দু+ভি=1+1+1=3 (অক্ষরবৃত্তে)
বেজে ওঠে=বে+জে+ও+ঠে=1+1+1+1=4 মাত্রা (তিনটি রীতিতেই )
এবার তিনটি ছন্দরীতিতেই ছত্রদুটির পর্ব-বিভাজন করে পূর্ণ পর্ব গুলির মাপ দেখা যাক --
স্বরবৃত্তেঃ- দুন্দুভি / বেজে ওঠে/ ডিম ডিম/ রবে 3+4+2+2
সাঁওতাল/ পল্লীতে/ উৎসব/ হবে। 2+3+2+2
মাত্রাবৃত্তেঃ- দুন্দুভি / বেজে ওঠে/ ডিম ডিম/ রবে 4+4+4+2
সাঁওতাল/ পল্লীতে/ উৎসব/ হবে। 4+4+4+2
অক্ষরবৃত্তেঃ- দুন্দুভি / বেজে ওঠে/ ডিম ডিম/ রবে 3+4+4+2
সাঁওতাল/ পল্লীতে/ উৎসব/ হবে। 3+3+3+2
--সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে, এটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। কারণ অন্যদুটি ছন্দরীতিতে পর্বগুলির মধ্যে সমতা রক্ষিত হয়নি এবং কয়েকটি পূর্ণপর্বের মাপও 4 মাত্রার কম হয়েছে।
💄 গ) "তাদের ঘাটে পূজার জবা মালা
ভেসে আসে মোদের বাঁধা ঘাটে"
এক্ষেত্রে 'তাদের ঘাটে' -এই কথাগুলি উচ্চারণের পরেই একটু থামতে পারি।
তাহলে, উপরের ছত্রদুটিকেও একইভাবে পর্ব-ভাগ করে তিনটি ছন্দরীতিতেই পূর্ণপর্বগুলির মাত্রা গণনা করে দেখতে হবে --
স্বরবৃত্তেঃ-
তাদের ঘাটে/ পূজার জবা/ মালা 4+4+2
ভেসে আসে/ মোদের বাঁধা/ ঘাটে 4+4+2
মাত্রাবৃত্তেঃ-
তাদের ঘাটে/ পূজার জবা/ মালা 5+5+2
ভেসে আসে/ মোদের বাঁধা/ ঘাটে 4+5+2
অক্ষরবৃত্তেঃ-
তাদের ঘাটে/ পূজার জবা/ মালা 5+5+2
ভেসে আসে/ মোদের বাঁধা/ ঘাটে 4+5+2
--- বুঝতেই পারছেন, মাত্রাবৃত্তে ও অক্ষরবৃত্তে পূর্ণপর্বগুলি কোথাও 4 , আবার কোথাও 5 মাত্রার। অর্থাৎ শর্ত লঙ্ঘিত হয়েছে । একমাত্র স্বরবৃত্ত ছন্দরীতিতেই শর্তদুটি পুরণ হয়েছে। সুতরাং কবিতাটি স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত ।
--------
🔰💄কোন কোন কবিতার ক্ষেত্রে প্রথম ছত্রের প্রথম পর্বেই লঘুযতি বা পর্বযতির লোপ ঘটে থাকতে পারে। তাই পর্ব চিনতে হলে অন্তত দুটি ছত্র আবৃত্তি করার মত করে পাঠ করা দরকার এবং পাঠের সময় কোথায় কোথায় সামান্য থামতে হচ্ছে সেগুলি চিহ্নিত করতে পারলেই খুব সহজে পর্ব-বিভাজন করা যাবে।