. ক্রিস গেইল অথবা বিরাট কোহলি যখন বলে বলে ছক্কা হাঁকায় তখন আমরা অনেক সময় বলে থাকি, ' ছক্কা হাঁকানো তো এদের কাছে বাঁয় হাত কা খেল।' কিন্তু এই সাফল্যের পিছনে যে কী পরিমাণ পরিশ্রম ও অধ্যাবসায় আছে সেটা একমাত্র তারাই জানে। আমাদের এই আসরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আগুন নদীর ক্ষেত্রেও বোধ হয় এই কথাটা প্রযোজ্য। দিনের পর দিন একটার পর একটা মনকাড়া কবিতার জন্ম দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। মেধা তো প্রশ্নাতীত; তা ছাড়াও কী পরিমাণ পড়াশুনা, চর্চা ও অধ্যাবসায় থাকলে এমনটি সম্ভব! তা বুঝতে পন্ডিত হওয়ার দরকার হয় না। নিঃসন্দেহে এমন কবি এই আসরের সম্পদ।
যাই হোক, তাঁর কবিতাগুলি যখন পড়ি তখন মনে হয় ভাল লাগা অনুভূতিটা সকলের সাথে শেয়ার করি। কিন্তু সময়াভাবে সেটা আর হয়ে ওঠে না। তাই ভাবলাম, আজ একটু চেষ্টা করেই দেখা যাক না তাঁর যে কোন একটি কবিতা কাটা-ছেঁড়া করে! আমার মতো আনাড়ি সার্জেনের হাতে কবিতাটির কী হাল হয়! কবিতাটি নিশ্চয় আপনাদের অনেকেরই পড়া। আমি জাস্ট আমার অনুভূতিটা সবার সমক্ষে তুলে ধরতে চাইছিঃ-
http://www.bangla-kobita.com/aghun67/onotit-shiter-geet
অনতীত শীতের গীত
-- আগুন নদী
মৌসুমি শীতের দল পালিয়ে যাবার আগে
সুকণ্ঠ পাখির ডাক এক অবেলায়
ভুল করে এসে পড়ে অবুঝ বসন্ত
তখনো সফেদ রোদে সকালের মোহ;
সলজ্জ শিশিরস্নানে জল মাখামাখি
বৈকালবাতাসে ভেজা পানেরবরজ
হলুদিয়া পাখিদের পিরিতি প্রভাব:
থেমে থেমে জমে উঠা নব প্রেমালাপ!
পূবাল বাতাস ঘুরে দখিনা দুয়ারে লাগে;
বেলেহাজ হেসে ওঠে বিরল গোলাপ!
বুলবুলি ভুলে যায় নাচুনে স্বভাব;
আড়াল আভাসে জাগে প্রাণের গরজ
ফাঁকি দেয়া আঁখিজলে ছিঁড়ে যায় রাখি
আবার নতুন বোধে সাজ ধরে দেহ;
বিশাখ কেতকী বনে সবুজ হসন্ত!
বৈকুণ্ঠ গীতের মতো গুপ্ত বেহালায়
অনতীত শীতকালে বাসন্তী দোহার জাগে।
------------------------------------------------
কবি এই কবিতাটিকে একাধারে প্রকৃতি ও রূপক এই দুই শ্রেণিতেই ফেলেছেন। প্রকৃতি তো বুঝলাম কিন্তু রূপক কেন? আমার মতে এটি ঠিক প্রকৃতির কবিতা নয়। সম্পূর্ণভাবে রূপক কবিতা।রহস্যটা যাতে আরও ঘনীভূত থাকে সেই উদ্দেশ্য নিয়েই কবি প্রকৃতিতেও ক্লীক করেছেন! অর্থাৎ পাঠককে তিনি একটুখানি ধাঁধায় ফেলতে চেয়েছেন। তিনি চেয়েছেন একমাত্র মনোযোগী পাঠকরাই এর মর্ম উদ্ধার করুক, যেটি কমবেশি সকল কবিই চেয়ে থাকেন।এখন প্রশ্ন হলো, কেন আমি এটিকে প্রকৃতির কবিতা বলতে রাজি নই? সেটির ব্যাখ্যাই এবার দিই তাহলে :
লক্ষ করলে দেখা যাবে ঋতু, পাখি, বন এসবের উল্লেখ থাকলেও তাদের বিষয়ে কোন বর্ণনা নেই।পরিস্কার বোঝা যায়, সেগুলি উপমা হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
শিরোনাম :- কবিতায় শিরোনামের একটা বিশেষ তাৎপর্য থাকে। অনতীত অর্থাৎ যে শীত এখনও বিদ্যমান এমন এক শীতের গান গাইতে চেয়েছেন কবি।
সাধারণত শীতকে জড়তার ঋতু বলা হয়ে থাকে। এ সময় পাখিদের তেমন গান গাইতে দেখা যায় না। মানুষের মধ্যেও কেমন যেন একটা জড়তার ভাব লক্ষ্য করা যায়। সেরকম এক শীত পুরোপুরি বিদায় নেওয়ার আগে হঠাৎই সুকণ্ঠ এক পাখির ডাক কর্ণকুহরে ভেসে আসে। কিন্তু সে সময়ে তো তার আসার কথা নয়। সেটি যে অবেলা। তবু এসেছে, শুধু আসেই নি, আহ্বানও(ডাক) জানিয়েছে। এই অপ্রত্যাশিত ও বিরল আগমনে ও আহ্বানে বসন্ত কি আর বুঝ মানতে পারে? সেও ভুল করে উড়ে এসে জুড়ে বসে দেহ-মনে।"সফেদ রোদকে" যদি প্রৌঢ়ত্বের প্রতীক আর "সকালকে" যদি যৌবনের প্রতীক হিসাবে দেখি তাহলে স্তবকটির মর্মার্থ বেশ খানিকটা পরিস্কার হয়ে যায়।পুরুষেরা সহজে যৌবনের মোহ ত্যাগ করতে পারে না।তাই "তখনো সফেদ রোদে সকালের মোহ।" হলুদিয়া পাখিদের অর্থাৎ নবীনদের পিরিতি অথবা যৌবন কালের স্মৃতির প্রভাবে বৈকালবাতাসে পানের বরজ ভিজে যাওয়ার মতোই প্রবীণদেরও দেহ-মন সিক্ত হয়ে ওঠে।এখানে "বৈকাল" প্রবীণতার প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে বলেই আমার ধারণা।
সুতরাং পুবাল বাতাস ঘুরে কেন দখিনা দুয়ারে লাগলো সেটি বেশ পরিস্কার হয়ে যায়।
যে প্রেমের দেখা মেলাই ভার (বিরল গোলাপ) তার সহাস্য আহ্বানে বুলবুলি তো তার নাচুনে স্বভাব অর্থাৎ কর্মব্যস্ততার কথা সাময়িক ভুলে যাবেই।আড়াল আভাসে প্রাণের গরজ জেগে ওঠে।কবি এখানে খুবই দক্ষতার সাথে 'রাখি' শব্দটির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। একটা বয়সের পর দয়িত-দয়িতার সম্পর্ক ভাই-বোনের মতো হয়ে ওঠে। কিন্তু বিশেষ মুহূর্তে অকাল বসন্তের মতো যখন প্রেম জাগ্রত হয় তখন অদৃশ্য আনন্দাশ্রুতে সিক্ত হয়ে সেই রাখি ছিন্ন হয়, "আবার নতুন বোধে সাজ ধরে দেহ।" শাখাবিহীন অর্থাৎ বিগত-যৌবনা কেতকী বনে যৌবনের সবুজাভা ব্যঞ্জনান্ত হসন্তের মতো যৌবনান্ত দেহে প্রলিপ্ত হয়। বৈকুণ্ঠ অর্থাৎ স্বর্গীয় গীতের মতো গুপ্ত বেহালায় তখন সুর বেজে ওঠে ;অনতীত সেই শীতে বসন্তের দোহার (যে সহকারী গায়ক ধুয়া ধরে) জেগে ওঠে।এখানে দয়িতা যদি মূল গায়িকা হয় তাহলে দয়িত দোহার। অথবা দয়িতের জীবনকালের শীতপর্বে বাসন্তী দোহার ধুয়া তুলে যায়।
------------------------------------------------------------------------------
পুনশ্চঃ জানিনা কবিতাটির এই ব্যাখ্যা কবির ভাবনার সাথে মিলবে কি না, তবে নিজের ভাবনাটা আপনাদের সাথে শেয়ার করতে পেরেছি এটাই বা কম কী? আপনারাও নির্দ্বিধায় জানাতে পারেন আপনাদের প্রতিক্রিয়া। ভিন্ন মত হলেও স্বাগত।
আর হ্যাঁ, কবিতাটিকে কবি "ভিন্ন ধারার" বলে অভিহিত করেছেন। কেন ভিন্ন ধারা? কারণ এর গঠনগত অবয়ব। আমি হলে ফুটনোটে ইঙ্গিত দিতাম। কিন্তু এই কবি পাঠকের উপর এতটাই আস্থা রাখেন যে সেসবের তোয়াক্কা করেননি।অক্ষর বৃত্ত ছন্দে ৮/৬/২ এবং ৮/৬ মাত্রায় লিখিত হলেও কবিতাটির পঙ ক্তি সং খ্যা ও বিণ্য্যাস এবং অন্ত্যমিল ভিন্ন ধারার।খুব মনোযোগী পাঠক ছাড়া এই অভিনব অন্ত্যমিল নজরে এড়িয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। মোট সতের পঙক্তির কবিতা। অন্ত্যমিল ১, ৯,১৭/ , ২/১৬, ৩/১৫, ৪/১৪,৫/১৩, ৬/১২, ৭/১১, ৮/১০ । কতটা প্রতিভা আর অধ্যাবসায় লাগে এরকম অভিনব গঠনের কবিতা লিখতে? তাও কবিতার সবরকম গুণ বজায় রেখে! গিরীশ চন্দ্র ঘোষ প্রবর্তিত ছন্দকে আমরা যদি গৈরিশ ছন্দ বলে থাকি তাহলে এই ধারাকে নিঃসন্দেহে "আগুন নদীয়" অথবা "ডক্টর রহমানীয়" ধারা বলা যেতে পারে।