জালালুদ্দিন রুমি নামটা ইসলামি ঘরনার বেশিরভাগ মানুষের কাছেই পরিচিত। উনার একটা বিখ্যাত আধ্যাত্মিক কাব্যগ্রন্থ আছে। নাম মসনবি। এই বইয়ের ভূমিকায় তিনি বলেছিলেন, যারা গভীর চিন্তা করতে আগ্রহী; শুধু তারা-ই মসনবি নামক বইখানা পড়বেন। অন্যথা বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রকট। কিন্তু কী কারণে তিনি গভীর চিন্তাশীল ব্যক্তি ছাড়া অন্যান্যদের বইটা পড়তে নিরুৎসাহিত করেছেন; তার প্রমাণ বইটার পরতে পরতে। পাতায় পাতায় জালালুদ্দিন রুমিকে কাফের ফতোয়া দিতে ইচ্ছে করেছিল আমার; কিন্তু নিজেকে গভীর চিন্তাশীল প্রমাণ করার জন্য ধৈর্য ধরে পুরোটা পড়েছিলাম। সে এক মহা আত্মযুদ্ধ। কিন্তু দ্বিতীয় বার যখন পড়তে গেলাম, তখন কবির আধ্যাত্মিকতার পরিচয় পেতে শুরু করলাম। বইটা মোট সাত-আট বারের মতো পড়েছি। এতদিন পরে হুট করে কেন এই গল্পটা বলছি, তা নিয়ে বিভ্রান্ত হতে পারেন আপনারাও। বিভ্রান্ত হওয়ার আগে আমিই বলে দিচ্ছি কারণটা।
সম্প্রতি একটা বই তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছে। সমালোচনার তোড়ে রকমারি.কম এর মতো জনপ্রিয় ওয়েবসাইটও তাদের সাইট থেকে সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছে বইটা। যারা সমালোচনা করছেন, তারা বইটি পড়ে সমালোচনা করছেন ব্যাপারটা তেমনও নয়। বইয়ের শিরোনাম আর কবিতার কিছু খণ্ডিত লাইন নিয়েই যত সমালোচনা। ও হ্যাঁ, বইয়ের নামটাই তো বলা হলো না। বইটার নাম ‘দ্বিতীয় ঈশ্বর’।
“দ্বিতীয় ঈশ্বর! আমরা যারা মুসলিম আছি; আমরা এক ইলাহে বিশ্বাসী। আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই; এটাই আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করল বইয়ের শিরোনাম? সুতরাং বইয়ের লেখক ভ্রান্ত। তাকে কতল করা ফরজ/ওয়াজিব।”–এমনতর মন্তব্যও করছেন অনেকে। অনেকে ঈমান রক্ষার স্বার্থে গালিগালাজও করছেন। সেটা উনারা করতেই পারেন। স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে গালি দেবার অধিকার থাকবে না; এটা তো হতেই পারে না।
“প্রেমিকাকে দ্বিতীয় ঈশ্বর কেন বলতে হবে? আর কোনো উপমা কি নাই? প্রেমিকার চিন্তায় সাহু-সিজদাতে ভুল তাসবি কেন পড়ে ফেলবে? ঈশ্বর চুলের ঘ্রাণ নকল করে হরিণের কস্তুরি সৃষ্টি করেছেন বলার সাহস কোথায় পেল এই খ-বর্গীয় পোলা? বুখারী শরীফ, সূরা কাউছার ইত্যাদি নিয়ে কেন টানাহেঁচড়া করা হচ্ছে?”– এতটুকুই মোটাদাগের অভিযোগ।
অভিযোগকৃত লাইনগুলো কবি বিভিন্ন সময়ে নিজের টাইমলাইনে পোস্ট করেছিলেন। ওখান থেকে নিয়ে যত সমালোচনার ঝড়। অভিযোগগুলোর দিকে মনোযোগ দিলে দেখা যায়, মূল সমস্যাটা উপমা প্রয়োগে। পাঠকের (পড়ুন সমালোচক) দাবি, উপমাগুলো ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক। পাঠকের দাবিকে সত্য-মিথ্যা বলার আগে উপমা প্রয়োগ কী রকম হওয়া উচিত আর এর মর্ম উদ্ধার কিভাবে করতে হবে, তা বোঝা জরুরি।
কাউকে ‘বাঘের বাচ্চা’ বললে, সে রাগ করবে না। কেন করবে না? কারণ সবাই জানে ‘বাঘের বাচ্চা’ দ্বারা ‘চতুষ্পদ জন্তু’ বোঝানো হয় না; যার চারটা পা, সারা শরীর লোম, পিছনে লেজ আর হিংস্র থাবা দেওয়ার মতো হিংস্র নখ আছে। বরং ‘বাঘের বাচ্চা’ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘বাঘের মতো সাহসী’। অর্থাৎ, উপমায় ব্যবহৃত শব্দটির উদ্দেশ্যটুকু গ্রহণ করতে হয়; পুরোপুরি শাব্দিকভাবে গ্রহণ করা যায় না।
কেউ যদি চিন্তা করে, “আমাকে বাঘের বাচ্চা কেন বলল? আমি কি জানোয়ার হয়ে গেছি? আমার কি চারটি পা আছে? হিংস্র নখ আছে? সারা শরীর লোম আছে?” তাহলে তার জন্য ভাষা নয়। সে প্রতি পদে পদে ভুল অর্থ করবে, আর মানুষের সাথে মারামারি করবে।
মানুষের সহজাত কথার চেয়ে অনেকগুণ বেশি উন্নতমানের উপমার সংমিশ্রণে গড়ে ওঠে সাহিত্য। তাই সাহিত্য বুঝতে আরও কয়েকগুণ উপমা বোঝার যোগ্যতা রাখা বাধ্যতামূলক। অন্যথা লেখককে গালি দেওয়া, কাফের বা ফাসেক ফতোয়া দেওয়া কিংবা হত্যার হুমকি দেওয়া নিজের জন্য অনিবার্য করে নিবেন পাঠক। আর আলোচ্য পরিস্থিতিতে এমনটাই ঘটেছে।
এবার আসি পাঠকের অভিযোগকৃত উপমায় লেখকের উদ্দেশ্য কী হতে পারে বা একজন পাঠক হিসেবে আমি কী বুঝেছি, তার কিঞ্চিৎ আলোচনা।
• বইয়ের নাম কেন ‘দ্বিতীয় ঈশ্বর’?
এই প্রশ্নের জবাব লেখক বইয়ের ভূমিকায় নিজেই দিয়ে রেখেছেন; আমি তা হুবহু তুলে দিলাম এখানে। “দ্বিতীয় ঈশ্বর নামটাই অনেকের কাছে বিভ্রান্তিকর ঠেকেছে। তাদের জন্য দু-চারটে শব্দ না বললে ভূমিকার হক আদায় হবে না মনে হচ্ছে। দ্বিতীয় ঈশ্বর নত হওয়া কলবের আর্তনিনাদ।। স্বভাবগত দিক থেকে আমরা ঈশ্বরের কাছেই নত হই। আর এই নত হওয়ার উপলব্ধিকে সামনে রেখেই নত কলবের কেবলাকে দ্বিতীয় ঈশ্বর বলাটা অযৌক্তিক বা অযাচিত কোনো উপমা নয় আমার কাছে।” অর্থাৎ দ্বিতীয় ঈশ্বর বলতে ঈশ্বরের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য উদ্দেশ্য নয়; বরং নত হওয়া হৃদয়ের আর্তচিৎকার যার জন্য, সে-ই উদ্দেশ্য।
• প্রেমিকার চিন্তায় সাহু-সিজদাতে ভুল তাসবি কেন পড়ে ফেলবে?
মানুষের সহজাত একটা অভ্যেস হলো দুশ্চিন্তার সময় ভুল করে ফেলা। পৃথিবীতে এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর হবে, যিনি দুশ্চিন্তার সময় ভুল করেন নি। অন্যদিকে নামাজ হলো প্রতিটি মুসলিমের জন্য ফরজ একটা ইবাদাত। ফলে হাজার দুশ্চিন্তার মাঝেও নামাজকে আঁকড়ে ধরতে হবে। কিন্তু নামাজ আর দুশ্চিন্তা যখন একসাথে হবে, ভুল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। ঠিক এই কারণে নামাজের ভুল সংশোধনের জন্য একটা পদ্ধতি রেখে দিয়েছে ইসলাম; যার নাম ‘সাহু-সিজদা’। এখন কথা হচ্ছে, ভুল কি শুধু মূল নামাজে হয়? সাহু-সিজদাতে কি হতে পারে না? অবশ্যই পারে। ঠিক সেটাই বুঝাতে চেয়েছেন কবি। যখন দুশ্চিন্তার চরম মাত্রাও অতিক্রম হয়ে যায়, তখন সাহু-সিজদার তাসবিও ভুল হয়ে যেতে পারে। এটা কিভাবে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক, সেটা বুঝতে পারছি না আমি।
• ‘তোমার চুলের ঘ্রাণ নকল করেই; ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন হরিণের কস্তুরি।’–এটার ব্যাখ্যা কী?
‘দয়াল–
নিজের মুখটা আয়নায় দেইখা
ঘণ্টা ঘণ্টা ধইরা;
বানাইয়াছো তুমি তারে,
কত যতন কইরা।’
না, এটা দ্বিতীয় ঈশ্বর বইয়ের কোনো কবিতার লাইন না। এটা মনির খানের গাওয়া গান। দেড়-দুই যুগ ধরে মানুষ গানটা শুনে আসছে। কেউ প্রতিবাদ করে নি। কিন্তু এটাকে যদি শাব্দিক অর্থে নেওয়া হয়, আল্লাহ নিজের মুখের সাথে মিলিয়ে মনির খানের প্রেমিকার মুখ বানানোর জন্য ঘণ্টা ঘণ্টা ধরে আয়না দেখেছেন; তাহলে তার ঈমান তো থাকবে না। আর কেউ এই অর্থে নেয়ও না। এটা সৌন্দর্যের বিস্তৃতি বোঝানোর জন্য বলা; সবাই জানে। তাই প্রতিবাদও নেই। এখানকার বিষয়টিও তাই। কবি প্রেমিকার প্রেমে কতটা ডুবে আছেন, সেটা বোঝানোর জন্য এই উপমা আনা।
• ‘তোমার সাথের এক কোটি বছর; মনেহয় সূরা কাউছারের মত সংক্ষিপ্ত...’—এর ব্যাখ্যা কী হতে পারে?
আগেই বলেছি উপমা শব্দকে পরিপূর্ণ ধারণ করে করে না; শুধু উদ্দেশ্যকে ধারণ করে। সূরা কাউছার আয়তনের দিক থেকে সবচে সংক্ষিপ্ত হলেও মর্যাদার দিক থেকে অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত। ঠিক প্রেমিকার সাথে কাটানো সময়টা আবেগের দিক থেকে অনন্য উচ্চতায় থাকলেও খুবই সংক্ষিপ্ত মনে হয়৷ সংক্ষিপ্ততা আর অনন্য উচ্চতার মিশেল অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ এই উপমা। সুতরাং, এখানে সূরা কাউছারকে অপমান করা হয় নি।
• ‘তোমাকে ভাবি প্রিয় বুখারী শরীফের দ্যুতিময় কালো অক্ষর। তোমাকে পাঠের নেশায় শিখে ফেলি ভাষার দুর্বোধ্য ব্যাকরণ।’—দ্বারা উদ্দেশ্য কী?
বুখারী শরীফ– হাদিসের সবচে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ। এই গ্রন্থের মর্যাদা এবং এর ভেতরকার জ্ঞান পুরো পৃথিবীবাসীর মুসলিমকে সমৃদ্ধ করে। আর এই সমৃদ্ধ হওয়ার স্বার্থে আমরা একটা বিদেশি ভাষার দুর্বোধ্য ব্যাকরণ শিখে ফেলি। একটা গ্রন্থের প্রতি কতটা ভালোবাসা থাকলে মানুষ এমনটা করে! হ্যাঁ, এই ভালোবাসাকে আঁকতে গিয়েই কবি তার কবিতায় বুখারী শরীফের কথা উল্লেখ করলেন। অর্থাৎ, এই উপমায় কবি তার প্রেমিকার প্রতি ভালোবাসার তীব্রতা বুঝাতে চেয়েছেন।
১৩-ই জুন, ২০২৩
লামা, বান্দরবান।
#