শক্তিক্ষয়ে হতোদ্যম দুর্যোধন, আশা লভেছিল,
আমার সৈনাপত্যে ও শল্যের সারথ্যে। ভেবেছিল
পর্যুদস্ত পাণ্ডবের পর, সমগ্র ভারতভূমি
কাঙ্খিত পুষ্পের অঞ্জলির মতো, পদযুগে চুমি
বরিবে বিজয়ীরূপে দুর্যোধনে। এ জয় কামনা
ছিলনা মরীচিকা সম অবাস্তব মিথ্যা কল্পনা।
অশ্বত্থামা, কৃ্প, শকুনি, শল্যাদি দুর্যোধন সনে—
কর্ণ জিনিতে পারে, নর-নারায়ণ, কৃষ্ণ-অর্জুনে।
আমার সংগোপনে লালিত, সেই সুদীর্ঘ বাসনা,
স্তব্ধ হল, সায়ংকালে, জাহ্নবী তীরে। যে কামনা,
জ্ঞানোন্মেষের সাথে সুতীক্ষ্ণ শেল হয়ে আছে গাঁথা
যতবার শুনিয়াছি, অর্জুনের বীরত্বের কথা।
ধিকিধিকি তুষানলের অসহ্য হিংসিত প্রবৃত্তি,
প্রজ্জ্বলিত ঘৃতাহুতি রূপে; আজ ঘটাতে নিবৃত্তি—
দুর্যোধন বরিয়াছে কুরু সেনাপতি রূপে মোরে
জিনিতে পাণ্ডবে। কিন্তু বিধি পাঠালেন জননীরে,
শোনাতে এক নির্মম ইতিহাস। তাঁরই গর্ভজ
সে যে, কানীন কৌন্তেয়, ঐ পঞ্চ পাণ্ডবের অগ্রজ!
নিষ্ঠুর সত্য উদ্ঘাটিত হল, প্রায়-অন্তিম দিনে,
মোর গর্ভধারিণীর শ্রীমুখের মৃদু উচ্চারণে।
এই পরিচয় লভি মানবেরা ধন্য হয়ে যায়,
আর পুণ্য এই সত্যটি নিথর করিল আমায়।
নিমেষেই ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল বিজয় প্রয়াস;
লভিলাম অন্তরেতে দিব্যজ্ঞান, করিছে নিরাশ
যা সেই শিশুকাল হতে বারংবার। রয়েছে জ্ঞাত,
ধরায় প্রথম আলোক স্নানের পর মোর মাতঃ,
ভাসায়েছে মোরে বেতস মান্দাসে, জাহ্নবী সলিলে,
অদৃষ্টের হাতে। সৌরি হয়ে সূত জননীর কোলে
স্থান লভি, ভাগ্য গুণে সেই ক্রোড়ে স্তন-দুগ্ধ মাখি
বলবীর্যে প্রদীপ্ত হয়েছি। তারপর ভূমে রাখি
পদদ্বয়ে কৈশোরে এসেছি। জানিনা কিসের ঘোরে
ছলনায় ব্রাহ্মণের বেশে অস্ত্র-বিদ্যা শিক্ষা তরে,
জামদগ্ন্য-পাদপদ্মে স্থান লভি, শিক্ষান্তে গুরুর
মর্মান্তিক অভিশাপ লভেছি, যা দিয়েছে মরুর
ঊষরতা, আমার বিড়ম্বিত জীবনে। আনয়ন
করিবে যা এই জীবনের পূর্ণচ্ছেদের কারণ।
শিক্ষাচ্ছলে, অনিচ্ছাকৃত সামান্য এক ভ্রান্তিবশে,
বধেছি দরিদ্র ব্রাহ্মণের গো-বৎসেরে,যার রোষে,
পেয়েছি অন্তঃকালে রথচক্র মৃত্তিকায় গ্রাসের
অভশাপ। যে চিহ্ন ছিল পরম শত্রুর ত্রাসের
দেবরাজ ইন্দ্রের চাতুর্যপূর্ণ অন্যায় কৌশলে
হারিয়েছি মোর সেই সহজাত কবচ-কুণ্ডলে।
ব্যয় করেছি বিনিময়ে প্রাপ্ত একাঘ্নি দিব্যবাণে,
ভয়াল নিশিযুদ্ধের কালে ঘটোৎকচের হননে।
কুরু-পাণ্ডবের অস্ত্র-পরীক্ষার দিনে, অকারণে
কুবাক্য লভেছি, সূতপুত্র বলি। একই কারণে,
দৌপদীর স্বয়ংবর সভায় জ্যা-বদ্ধ শরক্ষেপে
বিরত হয়েছি। আর আ্জ, এই অন্তিম দিনান্তে,
ভাগীরথী তীরে হারালাম সব, জন্মের বৃত্তান্তে!
জানি আমি, পৌরুষ দ্বারা দৈবও পরাভূত হয়,
কিন্তু কি জ্যেষ্ঠ হয়ে গাণ্ডিবী হনন, কখনও নয়।
জানুক না ভুবন, কর্ণাপেক্ষা অর্জুনের শ্রেষ্ঠত্ব,
আমার মৃত্যুর পর অর্জুন তো জানিবে অন্ততঃ;
কেন চলিলন মোর দিব্যবাণ বজ্রসম তেজে,
অগ্রে জাত হয়ে কেমনে বধিব আপন অনুজে?
কৌরবেরা বুঝিবে, কর্ণ বিমুখ নহে রণাঙ্গনে,
অন্ততঃ শেষ চেষ্টা করিয়াছে, রক্ষিতে দুর্যোধনে।
কেবল পাইনি উত্তর আমি একটি জিজ্ঞাসার—
সূর্যপুত্র হয়ে কেন পেলাম এই বিড়ম্বনার
জীবন? সমগ্র ভুবন যাঁর কৃপায় পুষ্ট হয়,
তাঁর পুত্র কর্ণ, কেন এত প্রতিকূলতাকে সয়!
হে দেবার্চিত দুর্বাসা, এত ঘটনার আদিমূলে
একমাত্র তুমি। জানিনা কিজন্য ফলাফল ভুলে
দাতা সেজেছিলে গর্ভধারিণীর কাছে?পরিতুষ্ট
ছিলে যদি অন্য বর ছিলনা কি করিতে সন্তুষ্ট
তোমার ঝুলিতে? দাতার সম্মান লভি,তুমি খ্যাত
ত্রিভুবনেতে; আর পুত্রের বর লভি মোর মাতঃ,
কাটালেন তিতি অশ্রুজলে, তাঁর সারাটি জীবন;
বল, ত্রি-কালজ্ঞ ঋষি, এই বর কিসের নিদান?
হে আমার পিতৃদেব, তুমিই বা কেমন জনক?
পুত্রকে তোমার ধরায় রক্ষিতে কেন অপারক?
তুমি তো এই সমগ্র সৌর-জগতের অধিপতি;
তোমার সন্তান তবে কেন হল এত মন্দমতি?
বেশ তো ছিলাম আমি রাধা জননীর কোলে;
কেন জন্ম নিল এত আশা জিনিতে অস্ত্র-কৌশলে!
কে কু-ইচ্ছা প্রজ্জ্বলিত করেছিল ছলিতে গুরুরে,
বিপ্রের মিথ্যা পরিচয়ে? কেন বধেছি গো-বৎসেরে
তুচ্ছ ভুলে, শস্ত্র-পারঙ্গমতা লভি? কোন্ আশায়,
দুর্যোধন সঙ্গে বার বার চাটুবাক্যের ধারায়,
উত্তেজনা বাড়িয়েছি? কখনও কেন ভাবি নাই,
এ অনুচিত, এ অন্যায়, এ পরমতম অন্যায়!
তাই ভাবি, অভিমন্যুর মতোই আজি নিশিকালে,
অমিও পরিবেষ্টিত হয়ে আছি সপ্ত-মহাকালে।
নির্মম মতিতে শিশুরে বধিতে তুলিয়াছি শরে,
যেগুলি সপ্ত-মহাকাল রূপেতে বেষ্টিয়াছে মোরে,
চারিদিকে একই কৌশলে। –অভিশাপ শ্রীগুরুর,
অভিশাপ ব্রাহ্মণের —দুই মহাকাল। জননীর
জন্মকালে পরিত্যাগ, দেবেন্দ্রের কবচ হরণ—
আরো দুই কাল। অস্ত্র পরীক্ষার দিন আস্ফালন—
পঞ্চম; যাজ্ঞসেনীর স্বয়ংবরে সূতপুত্র বলে
মোরে বর্জন—ষষ্ঠ মহাকাল; আর দিনান্তকালে
মোর মাতার পুত্র সম্বোধন—সপ্তম মহাকাল
রূপেতে আগমন।
সপ্তরথীর থেকেও ভয়াল
আমার নিয়তি রূপে আসিতেছে দৃঢ় পদক্ষেপে
মিটাতে যুদ্ধ-বাসনা। কেউ জানিবেনা কী আক্ষেপে
কর্ণ নাম লুপ্ত হবে এই ধরা হতে,অনাদরে
অসংগীত থেকে! জননী আমার, যাঁর উদরেতে
কাটিয়েছি গর্ভকালীন আমার এই দেহখানি,
তিনিও বিমুখ সত্য কথনে! অয়ি,অভিমানিনী
থাকো তুমি পঞ্চ পুত্রেরই মাতারূপে, রাখো জ্ঞাতে,
কোন জনমেই আর নাহি চাহি জনম লভিতে
ঐ গর্ভেতে! শোনো, যে কথা দিয়েছি নহি হবে আন্
অর্জুন ব্যতীত কাহারেও হানিব না মৃত্যুবাণ।
সদ্যগত সন্ধ্যাকালে, যবে কথা দিয়েছিনু আমি,
এক রূঢ় প্রশ্ন প্রাক্-উচ্চারণে গিয়েছিল থামি।
-পঞ্চ পাণ্ডবের জন্ম-ইতিহাস সকলের জ্ঞাত,
জ্যেষ্ঠ হয়ে মোর ইতিহাস কেন থকিবে অজ্ঞাত?
কেন সমক্ষে বলিতে পারোনা, ‘কর্ণ, পুত্র আমার,
সূর্য-বরেতে জন্ম নিয়েছিলি এই তুচ্ছ ধরায়’।
-পঞ্চ পাণ্ডবের জন্মের পর এই সত্য প্রকাশ,
রাখিত না কুন্তি মাতার লজ্জার কোন অবকাশ।
পিতামহী সত্যবতী তো গোপনে রাখেননি তাঁর
কন্যাকালে প্রসূত ব্যাসদেবের পরিচয়, যাঁর
বরে কৌরব-পাণ্ডব সম্মানিত সমগ্র ভারতে!
একই বংশের বধু হয়ে কেন পরোনা জানাতে
মোর জন্ম-ইতিহাস?
যাক্ মাতা, যা ঘটেছে যাক্,
মোর বিড়ম্বিত কথা, মৃত্যুপূর্বে অনুক্তই থাক্।
এই অন্তিম সময়ে ঊর্ধ্বাকাশের উল্কাপতন
হেরি বুঝিতেছি দ্রুত আসিতেছে আমার শমন।
তাই, আরো কিছু হৃদয়ের উদ্বেলিত গুপ্তকথা,
বলে যাই, এই রণভূমে, মধ্যযামে, যা বারতা
হিসাবেতে ধরে নিতে পারো—হে ত্রি-জগতের প্রভু,
কৃষ্ণ-নারায়ণ। তুমি তো সকলই জানিতে! কভু
কি এক পরম আন্তরিকতায় আমারে চাইতে
ষষ্ঠ-পাণ্ডবের প্রথম পাণ্ডব হিসাবে বরিতে?
হে ত্রি-জগতের নাথ, -আমি যে মূঢ়, কার্যকারন
তো বুঝিনা; তবুও প্রশ্ন, এই কর্ণেরে নিবারণ
করা ছিল কি তোমার পক্ষেও নিতান্তই দুঃসাধ্য,
বোঝালেও বুঝিবনা, আমি কি এমনই অবাধ্য?
জানি, জীব জন্মে এ ধরায় কিছু কর্তব্য সাধনে,
মোর জন্ম কি শুধু পাণ্ডবের বৈরিতা সম্পাদনে?
তা না হলে শৈশাবধি, কেন অদৃশ্য শক্তির টানে,
পতঙ্গের মতো ছুটিয়া চলেছি পাণ্ডবের পানে,
দুর্বার গতিতে।
তুমিই শুধু জানোনা নারায়ণ,
আমিও জানি, কখন কর্ণের সর্বশেষ শয়ন।
-অর্জুন বধিবে আমারে আগামী সূর্যস্তের আগে,
এক দূরন্ত রণে। অঞ্জলি পাতি তাই কর্ণ মাগে,
এক সম্মানীয় বীরগতি, প্রভু, করোনা নিরাশ,
অন্তে, তব শ্রী-পদে রাখি মিটিও অন্তিম পিয়াস।