পাঞ্চাল নরেশের বীতকাম মন্ত্রে সঞ্জাতা,
আমি দ্রৌপদী, কৃষ্ণা-পাঞ্চালী, দ্রুপদ-নন্দিনী;
যজ্ঞ-অগ্নির পবিত্রীকৃত শিখায় উত্থিতা,
নীলোৎপল সৌরভা, শ্যাম বরনা যাজ্ঞসেনী।
পাপাচারী সকৌরব ক্ষত্রিয় কুলনাশান্তে-
ধর্মরাজ্য স্থাপনে পাণ্ডবের সহকারিণী,
বাসুদেব-কৃষ্ণ সখী,পার্থ-অর্জুন বিজিতা,
এক অঙ্গে পঞ্চ-পাণ্ডবের প্রধানা ঘরণী।

এই পরিচয়ে আমি খ্যাতা সমগ্র ভারতে;
কোথাও অসাধ্বী রূপে পঞ্চ পতির কারণে।
কেহ কি কভু চিন্তিয়াছে কেন এই রূপেতে
প্রকাশ; কি বা কারণ পঞ্চ পাণ্ডব বরণে?
অর্জুনের শৌর্যে বিজিতা, তাই অবশ্য তার
সমধিক অনুরাগিণী, তা পরম নিশ্চিত,
তথাপি ইন্দ্রতূল্য পঞ্চ পাণ্ডবেরে একটি
মালিকায় গ্রন্থিত রাখিতে, ইহাই বাঞ্ছিত!
-এই সুকর্ম সেদিন কয়জন ভেবেছিল
পূর্ণ ভারতে? অথচ কয়মনে একজনে
ভজে, এমন নারীর সংখ্যা এই ধরাতলে
গণনার সারণিতে আছে নিতান্ত নগণ্যে।


জানি আমি যুগযুগান্তরে চলিতে থাকিবে
মোর দুঃসাহসিক কর্মের এই বিশ্লেষণ;
অথচ ঔচিত্য প্রশ্ন আসেনা কি পার্থ ছাড়া
অন্য পাণ্ডবের পত্নীগমনের আচরণ?
কোন দ্বিধা তো দেখি নাই অন্যান্য পাণ্ডবের
মোর সান্নিধ্যে, বরং দেখেছি আগ্রহ অত্যুগ্র
গর্ভ সঞ্চারণে! তাই বারবার হাসিমুখে
করেছি গর্ভধারণ, যেন কামনা উদগ্র!
কোন্ নারী চাহে বারবার সন্তান প্রসব
করি বিগত-যৌবনা হতে এ তিন ভুবনে?
আমার অন্তরের সেই অসহনীয় ক্লেশ,
হৃদয় উন্মুক্ত করি এবে প্রকাশি কেমনে?
নিরুপায় তাই আমি পঞ্চ পতিরে ভজেছি
দেহ-শতদল মেলি। গর্ভে নিয়ে দৃপ্ত বীর্য
উপহার দিয়েছি ক্রমে ক্ষুদ্র পঞ্চ পাণ্ডবে,
প্রকাশে সমর্থ যারা আপন আপন শৌর্য।
হে প্রিয় সখা কৃষ্ণ, কেবল জ্ঞাত ছিলে তুমি
মোর অন্তরের তীব্র বেদনার ভাষা, তাই
পঞ্চ পুত্রেরই সত্তা নষ্ট করে রাখিলেনা
দশ পাণ্ডবে একত্রে, কোন গুঢ় কামনায়।

যজ্ঞ-বেদি হতে উত্থানের পর অদ্যাবধি
অসংখ্য যাতনা সহিয়াছি আমি, যে গুলির
কোনটাও ঘটে নাই অন্য কোন রমণীর
জীবনাচরণে। তাই মুক্ত-বেণী বন্ধনীর
এই স্মরণীয় লগনে, চালচিত্রের মতো
একে একে আসিতেছে সব, স্মৃতি রোমন্থনে।
-পার্থের লক্ষ্যভেদ, ভীমসেনের দুষ্ট বধ
ছাড়া কোন রমণীয় স্মৃতি আসেনা স্মরণে।


যজ্ঞ-বেদি হতে আমার উত্থানও ছিলনা
কাঙ্খিত, দ্রোণ বধের নিমিত্ত ধৃষ্টদুম্নের
আবির্ভাবই ছিল একান্ত অভিষ্ট। দিলনা
কেহই মোরে ঈপ্সিত সম্মান; ভীমসেনের
দুষ্ট বধে—রক্ষণ ও বেণী বন্ধন ব্যতীত।
ত্রয়োদশ বর্ষব্যাপী যে ভয়াল দাবানল
প্রজ্জ্বলিত অন্তরে আমার, হয়ত বা আজ
তা কিঞ্চিত প্রশমিত, তথাপিও রয়ে গেল
চিরস্থায়ী ক্ষত রূপে পূর্ণ জীবনের মতো।
কোন রমণীয় মুহূর্তও আসেনা স্মরণে,
যা বিস্মরণ করাতে পারে কৌরব সভায়
যে অমানবিকতা ঘটেছিল বস্ত্রহরণে!
সুরাপান, মৃগয়া ও পর-দার গমনের
মতো রাজ-অক্ষক্রীড়া এক অধর্ম ব্যসন।
তদুপরি কেমনে কপটতায় সিদ্ধহস্ত
শকুণিরে দ্যূতমঞ্চে নির্বাচনে দুর্যোধন!
কেশব, এই জ্বলন্ত জিজ্ঞাসা যাজ্ঞসেনীর
সর্ব সকাশে। কেমনে ধর্মধ্বজাধারীগণ
উপেক্ষা করেন কৌশলী কুচক্রী শকুণির
দুর্যোধনাদির কুকর্মে উদ্বুদ্ধের ইন্ধন?
কোন্ সে স্পর্ধায় বর্বরতার সীমানা মুছে
দুর্যোধন চেয়েছে আমার সান্নিধ্য, ভজনা?
আর ধর্মতত্ত্বের আড়ালে ধ্বজাধারীগণ
সহ আমার পঞ্চপতি করেন প্রতারণা?

জন্মসূত্রে প্রতিটি মানব এ ধরায় পূর্ণ
স্বতন্ত্র, এমনকি মাতার কাছেও স্বাধীন।
কোথায় নিহিত আছে সেই ধর্ম যা স্বাতন্ত্র
বিলোপ করি তাকে করিতে পারে পরাধীন?
অন্ধ স্তাবকদল, সভাসদ একবারও
ভাবিলনা জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির রাজচক্রবর্তী
সম্রাটই শুধু নহেন, হস্তিনাপুরেরও
তিনি অধিকারী, এ পাঞ্চালী স্বাধিকারে কর্ত্রী!
-অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র শুধুমাত্র কার্য-নিয়ামক,
তথাপি কোন্ অধিকার বলে তিনি পারেন
বলিতে পঞ্চ পাণ্ডব হল দাস, এ পাঞ্চালী
দুর্যোধনে সেবদাসীরূপে করুক ভজন।
সভাগৃহ কি বিস্মৃত হয়েছিল সেই আর্ষ—
“পরদ্রব্যেষু লোষ্ঠ্রবৎ,পর-দারেষু মাতৃবৎ”?
অবশ্যই, তা না হলে এই ঘৃণ্য আচরণ
কীরূপে সম্ভব, যা কলুষিত করে জগৎ!

শুধু বস্ত্রহরণ কেন; কীচক, জয়দ্র্থ,
উপকীচকদের দ্বারাও লাঞ্ছনার ব্যথা,
বার বার ফিরে এসে কৌরব সভার মতো
ক্লেশ দিয়ে যায়। দেখেছি কী গভীর মমতা
দিয়ে তুমি ভীমসেন, এ অসহণীয় ক্লেশ,
পাঞ্চালীর সেই সর্বলজ্জা তুমি মুছেছিলে;
পাণ্ডবের সর্বকরণীয় দুই ভুজে নিয়ে
একক সংগ্রামে তুমি মোরে জয় করেছিলে!


যখন আনুপূর্বিক সব চিন্তে দেখি,ভেসে
ওঠে ধর্মভীরু জ্যেষ্ঠ পাণ্ডবের শুষ্ক মুখ,
তখনও সকষ্টে ভাবি ধর্মশৃঙ্খলে বাঁধা-
এই অসহায় রূপে তিনি পেলেন কী সুখ!
-আমার এ হেন লাঞ্ছনায় উদভ্রান্ত হয়ে
ক্ষোভে-দুঃখে যা কিছু বলেছি তাই নহে মোর
অন্তরের কথা, কারণ পাঞ্চালী যে দেখেছে
তাদের সর্বাঙ্গে উঠেছে ফুটে মোর লজ্জার
থেকেও বহুগুন বিষাদতর অভিব্যক্তি,
নিকট ভবিষ্যে যা ধ্বংসিবে সমস্ত কৌরবে।
মান্যতার সীমা শুধু রেখে স্বীয় অধিকার
প্রতিষ্ঠা করিবে ধর্মরাজ্য-স্থাপন গৌরবে।

কৌরব ধ্বংসে, পাণ্ডবের বিজয়-রণবাদ্যে,
ধর্মরাজ্য স্থাপনের এই পূর্ণ সন্ধিক্ষণে
আরো এক আনমনা মুখ ভেসে উঠে চোখে
মিশে যায় জননী কুন্তির ক্রন্দনের সনে।
সে করুণ মুখ কাহার জানো কি কেশব?
-জ্যেষ্ঠ কৌন্তেয় দানবীর বসুসেন কর্ণের!
যাঁর অভিশপ্ত জীবনের কর্মাচরণের
ভিত্তিভূমিও ছিল অনন্য পরম ধর্মের।
জানিনা কী কারণেতে পূর্বেও অসংখ্যবার
পড়েছে স্মরণে, প্রতিবার অন্তরে যা দহে
গভীর সমবেদনায়, তা রেখেছি গোপনে;
ভেবেছি বাইরে যা প্রকাশিত, তা সত্য নহে।


তুমি তো নিশ্চিত জানিতে কেশব,পাণ্ডবের
সাথে তার রক্তের সম্পর্ক, আপন শক্তিতে;
আমার অন্তরও বলেছিল একই কথা
মোরে ঐ শ্রীচরণের প্রতি অচলা ভক্তিতে।
এ পরম শক্তি হয়ত তোমারই প্রসাদে
বর্তেছিল এই তুচ্ছা কৃষ্ণা-পাঞ্চালীর মনে,
আর তারই তরে অভিনন্দিত করিতেছি
তোমায়, জননী কুন্তি ও তাঁর ছয় সন্তানে।