[‘সানাউল্যা মাহী’র ছড়াগ্রন্হ ‘উত্তরসূরী’ উপর আলোচনা/ সমালোচনা তৈরী করেছেন সা’দ শারীফ। জাহাঙ্গীরনগরবিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত দ্রোহ ও ভালোবাসার পত্র ‘চিরকুট’ তা প্রকাশ করেছে বইমেলা সংখ্যায়। বাংলা কবিতার বন্ধুদের জন্যে এটি আলোচনা সভায় প্রকাশ করা হলো। মতামত কাম্য]

১৯৯৩ সালের ১২ এপ্রিল দ্বীপ জেলা ভোলায় জন্মগ্রহন করেন সানাউল্যা মাহী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার ও রাজনীতি বিভাগে পড়াশোনার পাশাপাশি মূলত সাংবাদিক হিসেবে পরিচিতি অর্জন করলেও শৈশব থেকেই ছড়া কবিতার মাধ্যমে যে সাহিত্য চেতনার লালন করতেন তার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছেন সচেতন ভাবে। প্রতীবাদী চিন্তার অনবদ্য বহিঃপ্রকাশ “উত্তরসূরী” তাঁর প্রকাশীত প্রথম ছড়াগ্রন্হ । একুশে গ্রন্হমেলা ২০১৪ তে গ্রন্হটি প্রকাশের মাধ্যমে সমাজমনস্ক ও প্রতিশ্রুতিশীল ছড়াকার হিসেবে সাহিত্যের এ অঙ্গনে নিজেকে পেশ করেন তিনি।

গ্রন্হ পরিচিতি:
স্বনাম ধন্য বুকস ফেয়ার প্রকাশনীর পক্ষে মোঃ ফারুক হোসেন গ্রন্হটি প্রকাশ করেছেন। ধবধবে উন্নত অফসেট আর মজবুত বাধাইয়ে মুদ্রীত গ্রন্হটির মূল্য রাখা হয়েছে ৯০ টাকা। প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী মাহমুদুল হাসান আর চিত্রাংকন করেছেন নাজিব আমীন চৌধুরী জয়। সকল যুগের সকল শ্রমিক, শোষিত ও মানবতাবাদী বিপ্লবীদের বইটি উৎস্বর্গ করা হয়েছে। গ্রন্হটিতে ছোট বড় মোট চুয়াল্লিশ টি শিরোনামে ছড়া প্রকাশীত হয়েছে। সম্পূর্ণ ভিন্ন কতগুলো বিষয় নিয়ে অনেকগুলো মানবিক আবেদনমূলক ছন্দময় বার্তা সাহিত্য প্রেমীদের আলোচনার বিষয় হিসেবে বিবেচিত হতেই পারে।

নামকরণ:
দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীও নেতৃত্বের প্রতি বিদ্রুপ ছুড়ে দিয়ে দৃশ্যমান বাস্তবতার এক অদ্ভুত চিত্রাংকণ করেছেন বাছাইকৃত শিরোনামের ছড়াটি তে। এটিকে বর্ণবাদের একটি নতুন রুপ হিসেবে অভিহিত করে বজ্রকন্ঠের প্রতিবাদ ছুড়ে দেন এইভাবে-

“রাজার ছেলে হচ্ছে রাজা
পীরের ছেলে পীর,
এসব দেখি বর্ণবাদের
নতুন রুপী ভীড়। ”

সমাজের প্রতি যারা দায়বদ্ধতার চর্চা করেন না তারাই ওয়ারেসী সম্পত্তির মতো যেন ক্ষমতার মসনদে জুড়ে বসেন কেবল রক্তের উত্তরসূরী হওয়ার সুবাদে। ছড়াকার এমন উপলদ্ধি থেকেই প্রশ্নের তীর নিক্ষেপ করেছেন-
“রাজার ছেলে যোগ্য রাজার
পেলাম এটা কোনখানে
যায়নি দেখা কভু যারে
রাজনীতির ঐ ময়দানে।”

চলমান বাস্তবতার এমন একটি ভাইটাল ইস্যুকে একগুচ্ছ প্রতীবাদের শিরোনাম হিসেবে চয়ন করে নামকরণের স্বার্থকতাই লেখক প্রমাণ করলেন।

বিষয়বস্তু নির্বাচন ও প্রসঙ্গিক পর্যালোচনা:

এখানকার প্রত্যেকটি ছড়ার ভিন্ন প্রতিটি বার্তাই সময়ের প্রতিনীধিত্ব করে। তিনি একাধারে সমাজ বাস্তবতার নানামুখী দিক নিয়ে কলম ধরেছেন। একদিকে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া মূল্যবান ঘটনাগুলো তার ছড়ার বিষয় বস্তু তে পরিনত হয়েছে, অন্যদিকে শোষিত, নিগৃহীত জনতার ভাগ্যের নানা বিপর্যয় নিয়ে তাঁর বক্তব্য পাঠকের চিন্তার জগতে সন্দেহাতীত আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। পাশপাশি জীবনের ছোট ছোট অনুসঙ্গগুলো হাজীর হয়েও নৈতিক মূল্যবোধের জায়গা তৈরী হয়েছে।

জনগনের বন্ধুরুপী শাসকদের প্রতি তীব্র সন্দেহের জায়গা থেকে লিখা প্রথম ছড়াটির নাম ভাবনা।  শাসকের পরিবর্তন হচ্ছে কিন্তু শোষিতের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছেনা মর্মে লেখা দ্বিতীয় ছড়াটির নাম ভাবনা” রাজার শেষে রাজা”।
যেমন-
“রাজার ছেলে হচ্ছে রাজা
কিবা তাতে হচ্ছে গো ফল
দেশের ভাগ্য হয়না বদল
নায়ক বেশে আসে তো খল।”

দুর্ভিক্ষ শিরোনামে তৃতীয় ছড়াটিতে একটি দুর্ভিক্ষের চিত্রাংকন করেছেন-
“সারি সারি হোটেলগুলো
কানায় কানায় ভরা
তারি পাশে হাড় গোনা লোক
শুধুই অশ্রু ঝরা।”

একই ভাবে শৈশব, সত্যিকারের মানুষ হবার আহবান, আত্মনির্ভরশীলতা, মাতৃভাষা, সকল শ্রেনীপেশার মানুষের বস্তুবাদী দৃষ্টিভংগীর বর্ণনা করা হয়েছে।
শ্রমিকের কথা, জীবনের নিরাপত্তার কথা, সমাজে বসবাস রত বিভিন্ন শ্রেনীর ভেতরকার বৈষম্যের কথা, সকল প্রকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা, যান চলাচলে জন সচেতনতার কথা ইত্যাদী তার ছড়াগ্রন্হের পাতায় পাতায় সাজানো। দ্রোহের কথা, চারপাশের কথা, নিজের দ্বীপজেলা ভোলার কথা, প্রকৃতির কথা, পারিবারিক সৌন্দর্য়ের কথা, বীরত্বের কথা, গ্রামের কথা, শহুরে প্রজন্মের নানান অধপতন এবং  কৃত্বিমতার অনেকগুলো চিত্র ফুটে উঠেছে তাঁর সচেতন বর্ণনা ভঙিতে--
‘এই শহরে’ শিরোনামের ছড়াটিতে একজায়গায় বলা হয়-
“এই শহরে নেইকো আইন/
মানুষ গুলো ক্ষত/
যে চলে যার নিজের খুশী/
স্বৈরাচারের মতো।”

”মজিদের বাপ”  ছড়াটিতে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে মজিদ কে এক বুক আশা নিয়ে  বাবা ভার্সিটি পাঠানোর বর্ণনা এসেছে এভাবেই --

মেধারণে জিতে সে
ভার্সিটি গেলো,
বাপ তার স্বর্গটা  
যেন ঘরে পেলো।
পড়ালেখা শেষে সে
বিসি এস দিলো
ভাইভা রিটেন জিতে
এ্যডমিন নিলো।
কত যে সুখ পেলো
মজিদের বাপ’
ক্ষেতে মরা কষ্টের
রইলো না ছাপ।

কিন্তু পরের চরনেই আমরা এ সুখ অনুভূতির বিপরীত চিত্র  দেখতে পাই-

এদিকে ঈদ এলো/
আসবে সে বাড়ি/
কেনাকাটা কিছু করে /
ধরলো যে গাড়ি
আসা তার হলো না/
কফিন যে এলো/
সিন্ধুসম স্বপ্নটা/
মিমিষেতে গেলো
কে দেবে সান্তনা/
মজিদের ঘরে/
রোজ রোজ সড়কে/
মানিকেরা ঝরে।

এভাবেই হাজারো মজিদের সড়ক দূর্ঘটনায় প্রাণহানির সুকরুন দৃশ্য বেশ অভিনব কায়দায় ছড়াকার বর্ণনা করেছেন, যা পাঠকের মনে সমাজমনস্ক চিন্তার উদ্রেক করে।

ক্ষেতে কাজ করা বাবা কিভাবে কষ্টার্জিত অর্থে বড় করেছিলেন সন্তানকে তার নিখুঁত ছবি এঁকেছেন।
কাটাতারের সীমান্তে ফেলানীদের রক্তের চিত্র টেনে দেখিয়ে দিয়েছেন এ মাটির হাজারো অবিচারের কথা। সমগ্র দেশে বাংলায় রক্তের ছাপ অংকন করে দেখিয়ে দিয়েছেন এমন হাজারো অবিচারের কথা। বিবেকে কে করেছেন প্রশ্নবিদ্ধ।

তাজরীন ফ্যশন’স, রানা প্লাজা সহ বিভিন্ন জায়গায় হাজারো শ্রমিকের প্রাণ হাণীকে কেন্দ্র করে ‘হিরণের মা’ ছড়াটিতে ছড়াকারের অসামান্য জীবনদৃষ্টির গভীরতা ফুটে উঠেছে। মর্মান্তিক ঘটনা উল্লেখ করে তিনি পাঠকের আবেগের জায়গাকে স্পর্শ করেছেন।

ছন্দ, মাত্রা ,অন্ত্যমিল এবং কিছু অসঙ্গতির কথা:

অভিনব বিষয় বস্তু আর মানবিক আবেদনের এই অসামন্য সৃষ্টি তে লেখকের ছন্দ, মাত্রা আর অন্ত্যমিলের বেশ কিছু অসঙ্গতি সমালোচনার তীব্র সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে লেখক চরম উদাসীনার চর্চা করেছেন বেশ সচেতনাতার সাথেই। যেমন তিনি ভূমিকাতেই উল্লেখ করেন- “আমার লেখাগুলো তে ছন্দের চেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়েছি বিষয়ের উপর।” এ-কথায় কারো আপত্তি থাকার কথা নয় যদি ছন্দের প্রতি যত্নশীলতাকে উপেক্ষা করা না হতো। ছড়ার সৌন্দর্য আর কাঠামোর ক্ষেত্রে একটা কথা বলা হয়ে থাকে-
“লেখতে ছড়া ছন্দ লাগে/
লাগে মাত্রা অন্ত্যমিল/
দু পাটিতে যেমন থাকে/
দাতে দাতে দন্ত্যমিল।”

বিরাট স্বচ্ছ জলরাশীর দুবিন্দু অস্বচ্ছ জলের ন্যয় কিছু বিষয় ছড়ার সাহিত্য মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কোথাও বেশ দুর্বল অন্ত্যমিল অসচেতনভাবে গ্রহন করা হযেছে, কোথাও মাত্রার ভারসাম্য কে উপেক্ষা করে সৌন্দর্যের অসংলগ্নতা সৃষ্টি করা হয়েছে। আলোচনার পরীধি দীর্ঘ হওয়ার আশংকা না থাকলে আত্মপক্ষ সমর্থনে বেশ কিছু অসঙ্গতির উদাহরণ টেনে আনার ইচ্ছে ছিলো। তবে কিছু তো না দেখালেই নয়-
ভাবনা শিরোনামের প্রথম ছড়াতেই অন্ত্যমিলের খামখেয়ালীপনা দৃশ্যমান-
“চলবো কাকে সাথে নিয়ে/
পথ যে একা সহজ না/
ভাবনা করে হচ্ছেনা ফল/
জবাব পাওয়া যাচেছ না ”

উল্লেখিত স্তবকে সহজ না এর সাথে যাচ্ছেনার যে অন্ত্যমিল টানা হয়েছে, কেনো ছড়াকার কি অন্তত ছড়াতে এমনটি ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন?

ফাঁকি ছড়াটির সেই ফাঁকিবাজ খোকার মতো ছড়াকার ও যে মাত্রা ফাঁকি দিয়ে আবৃত্তিকার কে বিপদে ফেলে দিলেন, সে ব্যপারটি ও তো পাঠকের দৃষ্টি কে ফাঁকি দিতে পারলো না-
“অংকটা আজ নতুন লাগে/
বিজ্ঞান টা ল্যব ঘরে/
সমাজ সহজ এখন পড়ি/
ইংরেজীটা তার পরে। ”

শেষ চরণে এক মাত্রার আধিক্য টা নেহায়েত অপ্রয়োজনীও ছিলো। এ ধরনের আরো বেশ ক’টি অসঙ্গতি দৃশ্যমান, যা একজন সচেতন ছড়া কারের নিকট কাম্য নয়।

এছাড়াও সামগ্রিক বিচারে নেতিবাচক দিকগুলো উল্লেখ করতে হলে বলতে হবে -বেশ  নান্দনিক ও অভিনব বর্ণনার পাশপাশি অসচেতনতা বশে শব্দ চয়ন আর বর্ণনা ভঙ্গীর যৎসামান্য জায়গায় দুর্বলতা পরীলক্ষীত হয়েছে। কিছু জায়গায় ভাষা মাধুর্যতার ঘাটতিও দেখা যায়।  সাধারণ পর্যবেক্ষনে এগুলো কে সম্ভবত যত্নশীলতার অভাব হিসেবেই অভিহিত করা যাবে।

চিত্রাংকণ প্রসঙ্গঃ
প্রতিটি ছড়ার সাথে অংকিত সামঞ্জস্য পূর্ণ চিত্রগুলোর প্রশংসা করতেই হবে। ছড়ার আবেদন কে বিভিন্ন জায়গায় অতিমাত্রায় শক্তিশালী করতে চিত্রগুলো অন্যরকম ভাবে কথা বলেছে। অংকন শিল্পী নাজির আমীন চৌধুরী কেই নিশ্চই এ সফলতার প্রধান কৃতিত্ব প্রদান করতে হবে. লেখক কে তো বটেই।

বেশ পছন্দের কয়েকটি ছড়াঃ
সম্পূর্ন গ্রন্হের ভেতর একদম ভালো লেগে যাওয়া কিছু ছড়া এবং চরণের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেই উপসংহার টানতে চাই। শ্রেষ্ঠ ছড়াগুলোর নামের ভেতর সর্বাগ্রে বলতে চাই  ‘বন্দরের প্রেম’। মেঘনা তীরের সেই “ভানুমতীর গল্প”, মজিদের বাপ আর হীরনের মা শিরোনামের তিনটি ছড়া। সোনাবরু ফেলানী, উত্তরসূরী, এই শহরে ছড়াগুলোও বারবার পড়তে ইচ্ছে হয়। বিশেষ করে মাতৃভাষা ছড়াটির শেষ অংশটি একদম হ্রদয়ে যেন গেথে গিয়েছে-

“মাতৃভাষায় শিখলে কিছু/
যায় বুঝা যায় সহজে/
অল্প কথায় অনেক বুঝায় /
যায় থেকে যায় মগজে।”

শেষকথাঃ
লেখকের গ্রন্হ ভূমিকায় সমালোচনার মুক্ত আহবান অনেকাংশেই আমাকে বইটি সমালোচনার দুঃসাহস মোকাবেলায় প্রাণীত করেছে।  আমি তার লেখক স্বত্তাকে আবিস্কার করার মাঝেই সমালোচনার স্বার্থকতা খুজতে চেয়েছি। ছড়াকার সানাউল্যা মাহীর ছড়াগুলো যুগ যন্ত্রণা আর এদেশের মানুষের জনচিত্তের কথা বলেছে বারবার। এখানকারই হয়তো কেনো কোনো চরণ বহুকাল পরে হতে পারে ইতিহাসের রাজসাক্ষী। তার ভেতর যেই ছন্দ, শব্দের গাথুনি আর চিন্তার সমন্বিত শক্তি রয়েছে এর বদৌলতে ছড়ার এই কুসুমিত বাগে পরিশুদ্ধ ছড়ার চর্চা করে তিনি সফলতার শীর্ষে আরোহন করবেন, এমন প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।