ত্রিপুরার এই অসামান্য অনুষ্ঠানে যোগদান ক'রে তারপর দেশের অন্য কিছু প্রান্ত ঘুরে এই সপ্তাহে নিজের শহর কোলকাতায় এসে পৌঁছলাম, তাই একটু দেরি হয়ে গেল হয়ত ত্রিপুরা প্রসঙ্গে লিখতে।
কোথা থেকে শুরু করি... যখন প্রথম এই আয়োজনের কথা জানলাম, তখন মনে পড়লো ২০১৮ তে কলকাতার সূর্যসেন মঞ্চের কবি সম্মেলনের কথা.. অতি মনোরম ছিল সেই অনুষ্ঠান.. ভেসে এলো বেশ কয়েকটি মুখ, মুখ্য আয়োজক সৌমেন-দা, তারপর সমীর প্রামানিক দা, অসিত রায় (রক্তিম-দা), কবি সুমিত্র দত্ত রায়, কবিয়েত্রি মল্লিকা রায়, সানারুল-দা, বিশ্বজিৎ শাসমল, সৈকত, তরুণকান্তি, তমালবাবু ও পারমিতা ব্যানার্জী যুগল, মৈত্রেয়ী কবি রিনা-দি, কবি রণজিৎ মাইতি এবং আরও অনেকে। এনাদের সাথে পুনর্মিলিত হওয়ার আকাঙ্খা এবং বাংলাদেশ থেকে আগত আরো অনেক কবি যাদের লেখা পড়ে অভ্যস্ত ছিলাম তাদের সাথে মিলিত হওয়ার প্রবল ইচ্ছে মনে জাগলো এবং তৎক্ষণাৎ ত্রিপুরার অনুষ্ঠানে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করলাম।
তারপর এসে গেলো সেই বাঞ্ছিত দিনটি, ১১ই আগস্ট শুক্রবার সকাল সকাল শিয়ালদহ স্টেশন থেকে যখন কাঞ্চনজঙ্ঘা ট্রেনটি ধরি তখন মনে হয়েছিল, স্টেশন, প্ল্যাটফর্ম বা ট্রেনেই হয়তো কয়েকটি পরিচিত মুখের সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে, কোনো কারণে সেটি হলো না, তাই দীর্ঘ ৩৭ ঘন্টার ট্রেন যাত্রায় সঙ্গী রইলো শুধু কয়েকটা ইংরেজি ও বাংলা মেশানো গল্পের বই।
তবে আসল 'ফীল' টা পেতে শুরু করি ট্রেনযাত্রার দ্বিতীয় দিন, অর্থাৎ ১২ই আগস্ট শনিবার, যখন হোয়াটস্যাপ গ্রুপে সবার আগমনের বার্তা পেতে শুরু করলাম। একদিকে হাফলং এর নৈসর্গিক দৃশ্য ট্রেনের বাইরে, ট্রেনের ভিতরে হাতে রাসকিন বন্ডের ট্রেনকে ঘিরেই ছোট গল্পের গুচ্ছ, আর মনে আগামীর এন্টিসিপেশন, সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত সুন্দর মনের অবস্থা তৈরী হলো। ধর্মনগর স্টেশন যখন এসে পৌঁছলো, মনে পড়লো কবি সঞ্চয়িতা রায়ের কথা, হ্যাঁ উনি তো এখানেই থাকেন, তবে কি দেখা হবে ওনার সাথে, ওনার পাতায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল একসময়ে, উনিও নিয়মিত পড়তেন ও মন্তব্য করতেন আমার লেখায়। বিকেলে ট্রেনে বসে বসেই যখন মোবাইল স্ক্রিনে আমাদের মোহন বাগান ইস্ট বেঙ্গলের লাইভ ডার্বি ম্যাচ দেখছি, সেটাও যেন এপার বাংলা ওপার বাংলার একটা ঐতিহ্য বহন করে ও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে আমার এই যাত্রায়।
যাত্রাশেষে পরিতোষ-দা ও তার টিম আমাদেরকে বরণ করে নিল এবং সুদীর্ঘ এক উড়ালপুল পার হয়ে আমরা হোটেলে এসে পৌঁছলাম। এখানে এক অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি হলো বটে, সেটি হচ্ছে আমাদের সমীর প্রামানিক বাবুর সান্ন্যিধ্য পাওয়া হোটেল রুমের রাত্রিযাপনে। রাত্রিকালীন আহার শেষে আমরা পরের দিনের কথা ভেবে শুয়ে পড়ছিলাম বটে, কিন্তু তখন আমি সমীরদাকে জানাই যে দুটো কবিতা চয়ন করেছি, তবে দুটির মধ্যে কোনটা পাঠ করবো, একটু দোনামনাতে আছি, উনি উৎসাহভরে দুটোই শুনলেন, মতামত দিলেন, এবং নিজের লেখাটিও প'ড়ে শোনালেন। তারপর ঘন্টা খানেক যে বাংলা সাহিত্য নিয়ে আমাদের গল্প চললো, সেটি আমার কাছে এক বিশেষ প্রাপ্তি বটে। আমার যাবতীয় যা অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি, সব ওনাকে খুলে বললাম হৃদয় উজাড় করে এবং উনিও সেই আলোচনা উপভোগ করলেন ব'লে মনে হলো।
এরপর কয়েক ঘন্টা পরেই এল কাঙ্খিত দিনটি, এবং পকেটে রাখা মোবাইল ক্যামেরাটি মুখ্য ভূমিকা নিতে শুরু করলো, প্রতিটি মুহূর্তের সাক্ষী হয়তো ক্যামেরা হতে পারেনি, তবে আমি নিজে হয়েছি, এবং প্রাণভরে সাদরে সবকিছু গ্রহণ করেছি। কবীর হুমায়ুন মহাশয়ের আগমন ঘটলো বেশ ক্যারিজমেটিক ছন্দে, উনি আসতেই কেউ ওনাকে স্যার বলে সম্বোধন করলেন এবং তৎক্ষণাৎ উনি আপত্তি জানালেন ইংরেজদের শেখানো এই ভেদাভেদের সম্বোধনে, SIR সম্বোধনটিকে উনি "Slave I Remain" হিসেবে ব্যাখ্যা করলেন, বেশ উপভোগ করলাম ওনার মতামতকে। হাফ-হাতা টি-শার্ট পড়া যিনি এলেন, ব্যায়ামবিদের মতো চেহারা, তাঁকে তো চিনতেই পারিনি, তিনি আমাদের কবি আর্যতীর্থ, পেশায় অর্থোপেডিক সার্জন, যাঁর পাতায় আমি একসময়ে নিয়মিত যেতাম।
কবি সংহিতা সহ আরো কিছু কবির নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হলো অনুষ্ঠানে।
কবিতা আবৃত্তি সবার শুনলাম, উপভোগ করলাম, কিন্তু ভিন্ন বৈচিত্র নিয়ে আলাদা করে মন কেড়ে নিলো সৌমেন-বাবুর কবিগুরুর 'বিসর্জন' নাটকের শক্তিশালী পাঠ।
অনুষ্ঠান শেষে জগন্নাথ বাড়ি মন্দির দর্শনের সময়ে মিলিত হলাম শ্যামল-বাবু ও তাঁর স্ত্রীর সাথে, শ্যামল-দার সঙ্গও খুব উপভোগ করেছি পুরো এই তিনদিন। চেষ্টা সত্ত্বেও রাজবাড়ী সেই সন্ধ্যায় আমাদের দেখা হলো না বটে, উনাকটি ও অভয়ারন্যও বাকি রয়ে গেলো, তবে আপশোস অতটা নেই কেননা আমি জানি আমি আবার আসব ত্রিপুরার পুণ্যভূমিতে, হয়তো এবার স্বপরিবারে।
সেদিন নৈশভোজের ব্যবস্থা ছিল বলিউড রেট্রো নামক এক রেঁস্তোরায়, গানবাজনায় ভরপুর সেই ক্ষণগুলি স্মৃতির মণিকোঠায় থেকে যাবে, মৌমিতা (সংহিতা) ও তাঁর পরিবার, বিশ্বজিৎ, সৈকত, বিদ্যুৎ, সুখেন্দু, সঞ্জয়, অসিত-বাবু (রক্তিম-দা), সৌমেন-দা, সঞ্জয় কর্মকার মহাশয়, শ্যামল-দা ও তাঁর স্ত্রীর উপস্থিতিতে টেবিল ঘিরে সেই আনন্দঘন মুহূর্তগুলি সহজে ভুলে যাবার নয়।
১৪ই আগস্ট সোমবার ত্রিপুরার একমাত্র সুপারস্পেসিয়ালটি হাসপাতাল ILS ও নবপ্রান্তিক শিশু ও বয়স্ক সেবাশ্রম পরিভ্রমণ করলাম ও তাঁদের অভিজ্ঞতা ও সংগ্রামের কথা শুনলাম, মধ্যাহ্নভোজ সারলাম নবপ্রান্তিকের ছোট ছোট শিশু কিশোরদের সাথে একই টেবিলে, এও এক অনন্য অভিজ্ঞতা। সন্ধ্যাতে মুক্তধারা অডিটোরিয়ামে অপূর্ব কিছু লোকসংগীত ও নৃত্যকলার সাক্ষী রইলাম, ভারতের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে বলে সেই বিষয়কও কিছু পারফরমেন্স দেখলাম, তবে নতুনত্ব খুঁজে পেলাম ত্রিপুরার মাটির নৃত্যকলায় ও সঙ্গীত পরিবেশনে। কবি, গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী মুকুল সরকার মহাশয়ের গানের ভিডিও রিলিজও হলো সেই সাংস্কৃতিক সন্ধ্যাতেই। অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক যিনি ছিলেন, অনুষ্ঠান শেষে দর্শকমণ্ডলীর অনুরোধে তিনি যে কবিতাটি (সম্ভবতঃ স্বরচিত) আবৃত্তি করলেন, মন ছুঁয়ে গেল একেবারে।
রাজস্থানের জয়পুরের জলমহল দেখেছিলাম দুই দশক আগে, এইবার ভারতবর্ষের দ্বিতীয় এইরকম মহল দেখলাম ১৫ই আগস্ট, মঙ্গলবার - 'নীরমহল', মেলাঘরে রুদ্রসাগর দীঘির উপর অবস্থিত রাজা বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুরের সৃষ্টি, অদ্ভুত লাগে উনি হয়তো একটি পাথরও স্থাপন করেননি নির্মাণকার্যে, কিন্তু আমরা তাঁরই নাম জানবো, জানবো না শতশত কারিগরের নাম যারা এই সুন্দর সৃষ্টিকে রূপ দিয়েছেন।
নীরমহল দর্শনের আগে দীঘির আরেক পাড়ে যখন দুপুরের আহার সারছি, তখন জীবনে প্রথমবার এমন একটি জিনিস খেয়ে প্রীত হলাম, যা আগে কখনো হইনি, হ্যাঁ, ছোট্ট ক'রে বাঁশ খেয়েছি, কিন্তু সেই বাঁশ বড়ো সুস্বাদু ছিল, ব্যথা দেয়নি মোটেই।
সেদিন বাসযাত্রায় কিছুটা আলাপ হলো সরদার আরিফ উদ্দিন মহাশয়ের সাথে, তিনি আমাদের বাসের ব্যাকবেঞ্চার তরুণ ব্রিগেডের জীবনমুখী গানে যেভাবে যোগদান করলেন তা দিলো ওনার বয়েস পার্থক্য সত্ত্বেও তাজা তরুণ মনের পরিচয়। সৌভাগ্যবশতঃ ১৩ তারিখের অনুষ্ঠানে উন্মোচিত তাঁর একটি অনুকাব্যের বই আমার হাতে এল, যা আমি টুকরো টুকরো প্রতিদিন উপভোগ করছি।
ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির পরিদর্শনের সময়ে পরিচয় হলো এক হাস্যমুখ কিশোরের সঙ্গে, যে নিঃস্বার্থ ভাবে আমাদের ছবিপ্রিয় বিদ্যুৎের ব্যক্তিগত আলোকচিত্রীর কাজটি নির্বাহ করল বিনা দ্বিধায়, বিনা বিরক্তিতে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে, জানলাম সেই ছেলেটি আমাদের পরিতোষ-দারই সুযোগ্য পুত্র।
অনেকের সাথে অল্পবিস্তর কথোপকথন হলো এই তিনদিনে, সমীর-দা, বিভূতি-দা ও তাঁর স্ত্রী, শ্যামল-দা ও তাঁর সহধর্মিনী, ফরীদ হাসান মহাশয়, চিত্তবাবু, আরিফ উদ্দিন মহাশয়, সঞ্জয় কর্মকার মহাশয়, কবি সুদীপ মুখার্জী, কবি মুকুল সরকার, কবিয়েত্রি জে. আর. এগ্নেস, কবিয়েত্রি রিঙ্কু রায়, ইত্যাদি এবং আরো অনেকের সাথে ভবিষ্যতে ভালোভাবে পরিচয়ের আকাঙ্খা রাখি, এক হোটেলে থাকলে হয়তো একটা সুযোগ হতো, তবে মানি, লজিস্টিক কারণে সেটা সম্ভব ছিল না, বিশেষ ক'রে যখন ভগৎ সিং যুব আবাসে দুর্ভাগ্যজনকভাবে পুরো আয়োজনটি করা গেল না। আর একটা আপশোস থেকে যায় যাদের লেখা পড়ি, ভালো লাগে, মন্তব্য করি, তারাও উত্তর দেন, কিন্তু কোনো কারণে তারা এইপ্রকার অনুষ্ঠানে যোগদান করতে পারেন না, ফলে সামনাসামনি দেখা, কথা, পরিচয় হয়ে ওঠে না কখনোই। তবে এই পুরো তিনদিন যাদের সাথে এই পুরো সময়টা কাটিয়েছি হাসি ঠাট্টা, আনন্দে, ফটোসেশনে, তারা এপার বাংলার তরুণ ব্রিগেড - বিশ্বজিৎ শাসমল এন্ড কোং তথা সৈকত পাল, বিদ্যুৎ বরণ বারিক, সঞ্জয় ঋজু ও সুখেন্দু মাইতি। ফেরা যাত্রায় আমার একমাত্র সঙ্গী ছিলেন কবি স্বপন বিশ্বাস মহাশয়, যার সাথে কিছু বিষয়ে বাক্য বিনিময়েও নিজেকে সমৃদ্ধ মনে করলাম।
পরিশেষে আসি পরিতোষ-দার কথায়, আলাদা করে কিছু বলবো না, এই সুবিশাল কর্মযজ্ঞের যিনি কান্ডারি তার জন্যে কোনো প্রশংসাই হয়তো যথেষ্ট নয়, তবে ত্রিপুরার মাটি ছেড়ে যাওয়ার পর যখন তাঁর অসুস্থতার কথা জানলাম তখন মনে হলো যেন এ এক দক্ষ দৌড়বিদের মতো যে অন্তিম রেখা সফলভাবে পার হয়ে তবেই গিয়ে ভূমিতে শায়িত হয়, দা কোলাপ্স আফটার দা ফিনিশিং লাইন, এই কোলাপ্স নিশ্চয়ই ক্ষণস্থায়ী ছিল, আশা করি উনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
কিছু কথা, কারো কথা বাকি রয়ে গেল কিনা জানি না, হয়তো আবেগতাড়িত হয়ে অনেক বেশি কথা বলেও ফেললাম, অনাবশ্যক দীর্ঘায়িত করে ফেললাম বোধহয় আমার বিবরণ, তবে হৃদয় উজাড় ক'রে বলেছি, ত্রিপুরার প্রতিটি মুহূর্ত স্মৃতিতে ঠাসা, এ রেশ সহজে যাবার নয়...
সকলে ভালো থাকবেন, আবার মিলিত হবো হয়তো ভবিষ্যতের এরকমই আরো এক সুন্দর কোনো অনুষ্টানে বাংলার অন্য কোনো প্রান্তে.. সেই অপেক্ষায় রইলাম...