পূর্বকথা

১৯০৯ সালে এফ.এ পাস করেন ত্রিশালের ছেলে কাজী রফিজউল্লাহ । ১৯১০ সালে চাকুরির জন্য ময়মনসিংহ সদরে যান । সাব-ইন্সপেক্টর পদের জন্য আবেদন করেন এবং চাকরি পেয়ে যান । তাঁর পোস্টিং হয় পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের আসানসোলে ।
  কাজী রফিজউল্লাহ তাঁর ছোট ভাই কাজী আবুল হোসেনকে একসময় সেখানে নিজের কাছে নিয়ে যান এবং আসানসোল হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দেন । নজরুল তাঁর সহপাঠী ছিলেন । বার্ষিক পরীক্ষায় নজরুল প্রথম হয়ে সপ্তম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন । আবুল হোসেন উঠতে পারেননি, আগের শ্রেণিতেই থাকেন । কিন্তু তাঁদের সম্পর্ক অটুট থাকে । নজরুল মাঝে মাঝে এসে আবুল হোসেনকে পড়াতেন ।
   জানা যায়, শিক্ষকগণ মেধাবী ছাত্র নজরুলকে খুব পছন্দ করতেন । কারণ, তাঁকে যা বোঝানো হতো খুব সহজেই বোঝে ফেলতেন । শিক্ষকগণ মাঝে মাঝে তাঁকে ক্লাস নিতে বলতেন । এমনও হয়েছে নজরুল ক্লাস নিচ্ছেন, আর শিক্ষক বসে আছেন ।
    যাহোক, অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে একসময় নজরুলের লেখাপড়া বন্দ হয়ে যায় । তাঁকে স্কুল ছাড়তে হয় । তিনি সেখানকার এক রুটির দোকানে মাসিক পাঁচ টাকা মাহিনায় চাকরি নেন ।

ত্রিশালে নজরুল

কেউ কেউ বলেন, কাজী রফিজউল্লাহ্‌ দারোগা নজরুলকে বাসার সিঁড়ির নিচে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পান । তারপর দয়াপরবশ হয়ে তাঁকে ময়মনসিংহে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন ।
   যাহোক, ১৯১৪ সালে রফিজ উল্লাহ্‌ দারোগা নজরুলকে বর্ধমানের আসানসোল থেকে ত্রিশালের কাজির সিমলায় নিয়ে আসেন । দরিরামপুর হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন ।
   নজরুল প্রথমে কাজির সিমলা থেকে পাঁচ মাইল হেঁটে সহপাঠীদের সাথে স্কুলে আসতেন । বর্ষা-বাদলের দিনে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হতো । কারণ, রাস্তাঘাট এখনকার মতো পাকা ছিলোনা । হাঁটু সমান কাদা মাড়িয়ে আসতে হতো । এহেন সমস্যার কারণে একসময় তাঁকে বটতলা নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারীর বাড়িতে লজিং থাকতে হয় ।
   এখানে নজরুল একবছর পড়াশোনা করেন । একাডেমীক রেজাল্টও খুব ভালো ছিল তাঁর । শিক্ষকগণও তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হতেন । একবার কোন কারণে, যদ্দুর জানা যায়, পরীক্ষার খাতায় নাম্বারিং নিয়ে কোন এক শিক্ষকের সাথে তাঁর মনোমালিন্য হয় । তিনি স্কুল ছেড়ে বেপারী বাড়ি চলে আসেন এবং সারারাত খুব কান্নাকাটি করেন । সবাই কারণ জানতে চাইলে তিনি নিশ্চুপ থাকেন । পরদিন কাউকে না বলে রানীগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা দেন । প্রচণ্ড অভিমানী নজরুল আর কখনো ত্রিশালে আসেননি ।
   ১৯২৬ সালের ১৭ জানুয়ারি তারিখে ময়মনসিংহের টাউন হলে জেলা কৃষক ও শ্রমিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য নজরুলকে দাওয়াত দেয়া হয় । অসুস্থতার অজুহাতে তিনি আসেননি । তবে ময়মনসিংহের অবদান সম্পর্কে লিখেছেনঃ

  “ময়মনসিংহ আমার কাছে নতুন নহে । এই ময়মনসিংহ জেলার কাছে আমি অশেষ ঋণী । আমার বাল্যকালে অনেকগুলি দিন ইহারই বুকে কাটিয়া গিয়াছে । আজও আমার মনে সেইসব প্রিয় স্মৃতি উজ্জ্বল ভাস্বর হইয়া জ্বলিতেছে । বড় আশা করিয়া ছিলাম আমার সেই শৈশবচেনা ভূমির পবিত্র মাটি মাথায় লইয়া ধন্য হইব, উদারহৃদয় ময়মনসিংহ জেলাবাসীর প্রাণের পরশমণির স্পর্শে আমার লৌহপ্রাণকে কাঞ্চনময় করিয়া তুলিব । কিন্তু তাহা হইল না, দুর্ভাগ্য আমার ।”

ত্রিশাল এখন

নজরুল নেই, কিন্তু এখনো আছে সেই বটগাছ; যার নিচে বসে নজরুল আপন মনে বাঁশি বাজাতেন । কাটিয়ে দিতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা । এখনো আছে সুতিয়া নদী, যার কূল ঘেঁষে নজরুল হাঁটতেন; যদিও নদীতে নাব্যতা নেই ।
   কাজির সিমলায় নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে । বটতলা নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারী বাড়িতে নজরুল যাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে । দরিরামপুর হাইস্কুলের নাম পাল্টে এখন নজরুল একাডেমী রাখা হয়েছে । নজরুলের নামে ত্রিশালে গড়ে উঠেছে অনেক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান । শুকনি বিলের ওপর ২০০৬ সালে একটি  সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয়ও স্থাপন করা হয়েছে । যার নাম রাখা হয়েছে “জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়” । দূর-দূরান্ত থেকে হাজারো শিক্ষার্থী এসে নজরুল সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করছে । নজরুলের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে প্রতিবছর নজরুল জয়ন্তী হয়, নজরুলের ওপর আলোচনা হয় । গানবাজনার পাশাপাশি নজরুলের সাহিত্য নিয়ে নাতকও হয় । অভিনয় করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা । এই জয়ন্তী এখন ত্রিশালবাসীর বাৎসরিক উৎসবে পরিণত হয়েছে ।

   ঈশ্বর
কাজী নজরুল ইসলাম
কে তুমি খুঁজিছ জগদীশ ভাই আকাশ পাতাল জুড়ে’
কে তুমি ফিরিছ বনে-জঙ্গলে, কে তুমি পাহাড়-চূড়ে?
হায় ঋষি দরবেশ,
বুকের মানিকে বুকে ধ’রে তুমি খোঁজ তারে দেশ-দেশ ।
সৃষ্টি রয়েছে তোমা পানে চেয়ে তুমি আছ চোখ বুঁজে,
স্রষ্টারে খোঁজো-আপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে ।
ইচ্ছা-অন্ধ! আঁখি খোলো, দেখ দর্পণে নিজ-কায়া,
দেখিবে, তোমারি সব অবয়বে প’ড়েছে তাঁহার ছায়া ।
শিহরি’ উঠোনা, শাস্ত্রবিদের ক’রোনা ক’ বীর, ভয়-
তাহারা খোদার খোদ ‘প্রাইভেট সেক্রেটারি’ ত নয়!
সকলের মাঝে প্রকাশ তাঁহার, সকলের মাঝে তিনি!
আমারে দেখিয়া আমার অদেখা জন্মদাতারে চিনি!
রত্ন লইয়া বেচা-কেনা করে বণিক সিন্ধু-কূলে-
রত্নাকরের খবর তা ব’লে পুছো না ওদের ভুলে’ ।
উহারা রত্ন-বেনে,
রত্ন চিনিয়া মনে করে ওরা রত্নাকরেও চেনে!
ডুবে নাই তা’রা অতল গভীর রত্ন-সিন্ধুতলে,
শাস্ত্র না ঘেঁটে ডুব দাও, সখা, সত্য-সিন্ধু-জলে ।