আমরা মেয়েরা।
-কাকলী ভট্টাচার্য্য।

আমি পুরুলিয়ার অজ পাড়াগাঁয়ের
আদিবাসী মেয়ে পুঁটি,
আমি সারাদিন ঘরে বাইরে
অমানবিক পরিশ্রমের পর,
রাতে যেতে বাধ্য হই বাবুর বিছানা গরম করতে,
পরিশ্রান্ত ক্লান্ত দেহ আজ মৃত্যু পথ যাত্রী ।
আমি চা বাগানের চামেলি,
চা বাগান বন্ধ তাই কাজও নেই ,
আমি খেতে না পাওয়া জরাজীর্ণ রুগ্ন শরীর নিয়ে
দুটো খাবারের জন্য বাবুর বাড়ি গেলাম,
বাচ্চারা দুদিন না খেয়ে রয়েছে।
আর বলছে' মা খাবার দেনা মা খাবার দেনা', বাবুকে বললাম সব খুলে,
শুনে বাবু বললো "কি আছে তোর?
যা ভাগ-এখান থেকে,
বলেই দরজা বন্ধ করে দিল।
আজ আর কিছুই নেই আমার মৃত্যু ছাড়া।
আমি বিহারের "বিন্দিয়া"
প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে
আমি আজ মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আছি
চারটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর
আবার সন্তান সম্ভবা এনিমিয়া কঙ্কাল সার দেহ
এ অবস্থায় শ্বশুর বাড়ির চাহিদা পুত্র সন্তান,
আমার মৃত্যুর বিনিময়ে হলেও তা পুরণ করতে হবে।
আমি রাজস্থানের "রাজিয়া"
আজ ও মাইলের পর মাইল হেঁটে জল আনতে হয়-
প্রখর রোদে মাথায় করে,
তার পরে বসতে হয় ঘরকন্যার কাজে।
দাঁতেদাঁত চেঁপে সহ্য করতে হয় সমস্ত কষ্ট, ক্লান্তি অবসাদে চোখ বুঁজলে মনে হয় আমি জীবন্মৃত।
আমি ক্যানিং থেকে আসা"কাজরী"
রোজ সকালে ট্রেনে চেঁপে শহরে আসি-
বাবুদের বাড়ির সব কাজ করার জন্য,
তার পরও সহ্য করতে হয় বাবুদের কুৎসিত আচরণ
যেতে হয় বিছানায়,
তা না হলে চোরের বদনাম দিয়ে পিঁটিয়ে বার করে দেবে।
বাড়িতে অসুস্থ বাবা অন্ধ মা অনাহারে মারা যাবে যে?
রোজ আত্মার মৃত্যু হয় পোড়া দেহের মৃত্যু হয় না ।
আমি শহরের মেয়ে"শর্মিলা"
আমায় রোজ চোখের জলে ভাত মেখে খেতে হয়,
আর রোজ রাতে ভালোবাসা হীন শারীরিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়,
কারন সমাজ মেনে নেয়না স্বামী পরিত্যক্তা মেয়েকে..আমার দোষ আমি মদ্যপ মাতালের ঘর করিনি মুখবুঁজে..
এ যন্ত্রণা যেন মৃত্যু যন্ত্রণা কে হারিয়ে দেয়।
অথচ আমরা মেয়েরা মায়ের জাত
যে সব ব্যটাছেলেরা আমাদের যৌনদাসী মনে করে,
তারা কোন না কোন মেয়েমানুষেরই গর্ভজাত
আমরা গর্ভে ধারন করি,জন্ম দিয়ে পৃথিবীর আলো দেখাই মানব সন্তানকে,আমরা জন্মদাত্রী,কোন জন্মই আমাদের গর্ভ ছাড়া সম্ভব নয়।
কিন্ত কী নির্মম!আমাদেরকেই কেবল ঠেলে দেবার পায়তারা মৃত্যুসম অন্ধকার জীবনে?
আমরা মেয়েরা একসাথে মিলতে পারলাম না
তাই রুখে দাঁড়াতেও পারলাম না..এক দিন আসবে
আবার ফিরে যাব ভলগার তীরে, শুরু হবে আবার
নতুনভাবে বাঁচার জন্য পথ চলা।
ভলগা থেকে গঙ্গাঁ-যমুনা'র চরে, বয়ে যাবে মাতৃতান্ত্রিক যুগের হাওয়া।
______________________

কবিতার শিরোনামঃ আমরা মেয়েরা।
কবিঃ কাকলি ভট্রাচার্য্য।

আলোচনাঃ
কবিতাটি আদ্যন্ত পাঠ করে আমার মনে হলো কবিতাটি মানবিক মুল্যবোধ ও মানুষের বিবেকের আদালতে একটি নালিশি মামলার আর্জি।
এর বাদীনী যথাক্রমেঃ পুরুলিয়া'র "পুঁটি" চা বাগানের
"চামেলি" বিহারের"বিন্দিয়া" রাজস্থানের"রাজিয়া" ক্যানিং এর"কাজরী" শহরের"শর্মিলা" হলেও সমগ্র ভারতবর্ষ ও উন্নয়নশীল বিশ্বের ঘরে ঘরে এদের মতো ভুক্তভোগী অসহায় লক্ষ লক্ষ নারীগণ আছেন।এদের পক্ষে স্বাক্ষী ও উকিল স্বয়ং কবি "কাকলি ভট্রাচার্য্য, তিনি তাঁর বিশ্বস্ত জবানবন্দিতে যে বিবরণ পেশ করেছেন তা যেকোনো মানবতাবাদী আদালতের বিচারক,জুড়ি,সকলের অন্তরাত্মাকে বিচলিত করে দেবে।কবি দৃঢ় প্রত্যয়ে যখন ঘোষনা করেন "একদিন আসবে-আবার ফিরে যাব ভলগার তীরে/শুরু হবে নতুন ভাবে বাঁচার জন্য পথচলা/তখন আমরাও নতুন ভাবে আশাবাদী' হই মনেকরি,বিশ্বের সমগ্র মানবতাবাদী মানুষের বিবেকের আদালতে এ মামলার বিচারকার্য একদিন শুরু হবে,দোষীরা চিহ্নিত হয়ে যাবজ্জীবন দণ্ডে দণ্ডিত হবে,নির্যাতিত নারী সমাজের মা ভগ্নীদের বিজয় হবে।আজকের ভুক্তভোগীরা ততদিন বেঁচে না থাকলেও তাদের। উত্তরসুরীরা সুফল ভোগ করবে।আর সেই মহৎ নারী জাগরণের চেতনা বেগবান করবার যথেষ্ট উপাদান আমরা পেয়েছি কবি কাকলী ভট্রার্য্যের বক্ষমান কবিতায়'ই।কবির জীবন পরিক্রমা একদিন শেষ হয় কিন্ত মহত কবিতা তার স্বধর্মানুসারে কাল থেকে কালান্তরের পাঠকের গোচরে পৌঁছে যায়।হয়তো কোনদিন এই বিদুষীণি কবির নিভৃত বাণী বন্দনাও পাঠকের দৃষ্টি গোচর হবে,সেদিন সুবিবেচক পাঠকের সুবিচারে ধন্য হবেন তিনি... আর নারী স্বাধিকার আদায়ের "উচ্চকণ্ঠ কর্মীদের তালিকায়  কবি কাকলি ভট্রাচার্য্যের নামটিও স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হবে, শোষন বঞ্চনাহীন বিশ্বের সমাজ ইতিহাসে।
আমরা এই নারীবাদী কবির উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি।

কবিঃপরিচিতিঃ
কাকলী ভট্টাচার্যঃ জন্ম: ১০ আগষ্ট ১৯৭১ দেশ ভারত।
তাঁর নানাবিধ পরিচয় কবি আবৃত্তিকার ও নাট্যশিল্পী, কবিতা ও সাহিত্য বিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতি বেশ লক্ষণীয় এছাড়া রন্ধন বিষয়ক বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠানে ও তাঁর নিজস্ব রেসিপি উপস্থাপন করে থাকেন প্রায়ই সুতরাং যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে কথাটি বেশ মানায় তাঁকে। তাঁর কাব্যচর্চার মুল বিষয় মানবাধিকার ও নারীস্বাধিকার হলেও প্রেম ও প্রকৃতিধর্মী কবিতা লেখায় তিনি বেশ সিদ্ধহস্ত। ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত ও দুই পুত্রের জননী।

আলোচকঃ
মোঃসাদিকুর রাহমান রুমেন।
গ্রামঃ জামালপুর,থানাঃ জগন্নাথপুর জেলাঃ সুনামগঞ্জ, বাংলাদেশ।
কবি ও কবিতা সমালোচক।
২৮ ডিসেম্বর ২০১৬ খ্রীঃ।।