জীবনানন্দ তাঁর 'নগ্ন নির্জন হাত' কবিতায় লিখেছিলেন 'অনেক কমলা রঙের রোদ ছিলো'। তিনি মূলত দয়িতার শূন্যতা-বোধ থেকে সৃষ্টি বর্তমান সময়ের অতলান্তিক বেদনাকে বুকে নিয়ে অতীতের সুখপ্রেমস্মৃতির সন্ধানে রত ছিলেন। গত হৃদয়ের ক্ষত থাকলেও সে অতীতে 'অনেক কমলা রঙের রোদ' ছিলো। এটা একটি উত্তম চিত্রকল্প এবং রূপকও বটে। তবে আমাদের লক্ষ্য হলো রং এর অর্থোদ্ধার করা। আমরা ফ্রেঞ্চ তাত্ত্বিক রোঁলা বার্থ (Roland Barthes) এর নাম শুনে থাকবো যিনি তাঁর S/Z গ্রন্থে কোনো 'টেক্সট' এর 'মিনিং' উদ্ধার করার জন্যে পাঁচটি 'কোড' এর কথা বলেছিলেন। পাঁচটি কোডের মধ্যে দুইটি কোড : সিমবলিক কোড ও সিম্যানটিক কোড এর মাধ্যমে রং এর অর্থোদ্ধার করা সম্ভবপর। যদি 'কমলা রঙের রোদ' এ শব্দবন্ধটি 'সিমবলিক কোড' এর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করি তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায় : 'অতলান্ত আশা' বা 'গভীর আশা'। কমলা রং আশার প্রতীক এবং রোদও আশা-প্রত্যাশা-সুখ-আনন্দের প্রতীক। এখন কবিতার ছত্রগুলো পাঠ করলে অর্থের জট খুলে যাবে। এটাকে 'সিমবলিক কোড' এর মাধ্যমেও ব্যাখ্যা করা সম্ভবপর। সেক্ষেত্রে সিগনিফায়ার কমলা হয়ে যাবে সিমবল এবং রোদ হয়ে যাবে একটা আইকন। আবার কনোটেটিভ মিনিং এর মাধ্যমে একটা সেমিওটিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যাবে। তবে এ লেখার মূল উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন রং এর সিমবলিক মিনিং নিয়ে আলোচনা করা।
লাল রং মূলত যুদ্ধ, গতি, আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসা, গোলাপ, নাটকীয়তা, আগুন, উত্তাপ, উষ্ণতা, প্রতাপ, বল, উত্তেজনা, ভাবাবেগ, রক্ত, লালসা, বিপদ, সহিংসতা, রাগ, বিদ্বেষ, এ্যাগ্রেশনকে সিমবোলাইজ করে। তাছাড়াও লাল রং কালার অব একশানও বোঝায় যেমন ট্র্যাফিক সিগন্যালে লাল সংকেত মানে 'স্টপ'। তবে রং এর সিমবলিক অর্থ অনেকক্ষেত্রে সাংস্কৃতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে। তবে এখানে মূলত অভিন্ন বা বেশ প্রচলিত অর্থ নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে।
কমলা রং সাধারণত আবেগ, যৌবন, আশাবাদ, উৎসাহ, উল্লাস, সুখ, তেজ, সূর্যাস্ত, নিরাপত্তা, প্রাচুর্যকে সিমবোলাইজ করে। কিছু নেতিকেও সিমবোলাইজ করে যেমন অতিরিক্ত প্রদর্শন, সেল্ফ ইনডালজেন্স, অধৈর্য, কমোটিমেন্ট-ফোবিয়া ইত্যাদি।
হলুদ রং তামাশা, বাধা, বন্ধুত্ব, সুখ, রোদ, কল্পনা ইত্যাদিকে সিমবোলাইজ করে। নেতি যেমন পরশ্রীকাতরতা, বিশ্বাসঘাতকতা, কাপুরুষতা (এ শব্দটি উচ্চারণ করতেও অস্বস্তি লাগে), পাগলামি, প্রতারণা, শঠতা, প্রবঞ্চনা প্রভৃতিকেও সিমবোলাইজ বা প্রতীকায়িত করে।
সবুজ রং হলো প্রকৃতির রং। জীবন ও প্রাণের রং। এটি প্রকৃতি, বাস্তুসংস্থান, প্রশান্তি, সতেজতা, পেলবতা, মেদুরতা, স্নিগ্ধতা, বৃদ্ধি, নবজন্ম, প্রতিবেশ, প্রাচুর্য ও টেকসই ইত্যাদিকে প্রতীকায়িত করে।
বাংলা সাহিত্যে নীল একটি বহুল ব্যবহৃত প্রিয় রং। নীল রং প্রযুক্তি, সমুদ্র, স্নিগ্ধতা, প্রশান্তি, স্থিরতা, বিশ্রাম, উদ্বেগহীনতা, আনুগত্য, নির্ভরশীলতা, আস্থাকে প্রতীকায়িত করে। কিছু নেতি যেমন ডিপ্রেশন, বেদনা, বিষাদ, অবসাদ, কর্তৃত্বকেও প্রতীকায়িত করে।
বেগুনি রং ইন্দ্রিয়তা, নিষ্ঠুরতা, আনুগত্য, প্রজ্ঞা, সৃজনশীলতা, রহস্য, ভেলকি, ধ্যান, বিলাসিতা, নোবিলিটি, রহস্য, রোমান্স, উৎসব, ব্যর্থতা, বিষণ্ণতা, খেদ, নির্বেদ, শোক প্রভৃতিকে প্রতীকায়িত করে।
নারীবাদ বিকাশের ফলে গোলাপি বা পিংক রং নিয়ে বর্তমানে কিছুটা প্রতর্ক রয়েছে। এটি প্রধানত ফেমিনিন কালার হিসেবে ভাবা হয়। কেয়ারিং, টেনডারনেস, সরলত, চতুরতা, উদ্দীপনা, একসেপটেন্স ইত্যাদি ধারণাকে প্রতীকায়িত করে।
বাদামি রং মূলত সহিষ্ণুতা, মৃত্তিকা, কৃষি, আরথিনেস, সরলতা, স্থিরতা, বাস্তবতা, কাদা, ময়লা এমন আরও অনেককিছুকেই প্রতীকায়িত করে।
ধূসর রঙের প্রয়োগও বাংলা সাহিত্যে চোখে পড়ার মতো। এটি মূলত খেদ, কষ্ট, বেদনা, বিরক্তি, হাহাকার, শূন্যতা, ম্যাচুরিটি, বাস্তবতা, বিনয়, বুদ্ধি ইত্যাদি বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
সাদা/শাদা হলো কালো এর বাইনারি অপোজিট। এতে ঔপনিবেশিক বয়ানের ফলে কিছু পক্ষপাতদুষ্ট প্রতীকায়নের 'এসোসিয়েশন' ঘটেছে। শাদা সাধারণত পিওরিটি, সতীত্ব, সারল্য, পরিচ্ছন্নতা, শীত ইত্যাদিকে সিমবোলাইজ করে। অন্যদিকে কালো রং হলো অন্ধকারাচ্ছন্ন, রহস্য, মৃত্যু, শোক, ইভল (evil), দাপট, সফিসটিকেশনের প্রতীক।
বাংলা কবিতায় মাঝে মাঝে অনেক কবিয়াল/অকবি এমনকি কবিও রঙের ভুল প্রয়োগ করে থাকেন। প্রতিটি শব্দই ইমেজ। আরও স্পষ্ট করে বললে প্রতিটি শব্দ হলো সাইন (sign) যা দুটো জিনিসের সঙ্গমে সৃষ্ট : সিগনিফায়ার ও সিগনিফাইড। আবার সিগনিফকেশনের ফলে দুই ধরনের অর্থ দেখা যায়। মূল কথায় বরং ফিরে আসি। যদি কোনো কবি লেখেন 'নীল দেয়াল' তাহলে নীল ও দেয়ালের আলাদা আলাদা অর্থ আছে, আছে গভীর প্রতীকায়ন। প্রতিটি শব্দের-ই প্রতীকায়ন আছে। তাই লেখার সময় রং এর অর্থ মনে রাখলে অযাচিত ভুল প্রয়োগ এড়ানো যেতে পারে। এতে লেখাটিও ঋদ্ধ ও লক্ষ্যভেদী হতে পারে।