বাংলা সাহিত্যে যেসব কবি প্রাতিস্বিকতার জন্যে বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছেন কাজী নজরুল ইসলাম তাদের অন্যতম। রবীন্দ্রবলয় ও পঞ্চপাণ্ডববিশ্বের মাঝে নজরুলের আগমন সত্যিই বিস্ময় জাগানিয়া। বিদ্রোহের বৈজয়ন্তী উড়িয়ে তিনি কবিতাকে নিয়ে এসেছিলেন মৃত্তিকার কাছাকাছি, হয়ে উঠেছিলেন জনগণমনের ভীম কণ্ঠস্বর। ঔপনিবেশিক ক্ষমতার বলয় থেকে ছিটকে পড়া এবং ঔপনিবেশিক মনন থেকে বাদ পড়া অন্ত্যজ শ্রেণির প্রতিনিধি ছিলেন কাজী নজরুল। মূল আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে আমি আলোচনাটির তাত্ত্বিক দিকে একটু দৃকপাত করতে চাই। বিশ্ববিশ্রুত ইতালিয়ান তাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামসি তাঁর সুবিখ্যাত 'Prison Notebooks'-এ proletariat শব্দের বদলে subaltern শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন মার্ক্সীয় ঘরানার বুদ্ধিজীবী। জেলে বন্দিকালীন তিনি এই বইটি রচনা করেছিলেন বিধায় অনেক শব্দ তাঁকে ঘুরিয়ে লিখতে হয়েছিলো। গ্রামসির মতে subaltern বা নিম্নবর্গ হলেন তারা যারা শাসকদের hegemony-এর সাথে জড়িত। তিনি subaltern এবং proletariat শব্দ দুটোকে প্রায় সমার্থক অর্থেই ব্যবহার করেছিলেন। নজরুলের চিন্তাবিশ্ব বুঝতে হলে সর্বহারা বা proletariat নিয়ে দু'চার কথা বলাটা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। কমরেড মুজফফর আহমদ 'কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা' বইয়ে দাবি করেছেন যে নজরুল রুশ বিপ্লব দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, "নজরুল ইসলাম যখন ব্যথার দান গল্পটি আমার নিকট পাঠিয়েছিলো তখন তাতে এই দু'জনের (সয়ফুল মুল্ক্ ও দারা) লালফৌজে যোগ দেওয়ার কথাই...ছিলো। আমিই তা থেকে লালফৌজ কেটে দিয়ে তার জায়গায় মুক্তিসেবক সৈন্যদের দল বসিয়ে দিয়েছিলাম। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ ভারতে লালফৌজ কথা উচ্চারণ করাও দোষের ছিলো।" ১৯২৬ সালে নজরুল তাঁর সর্বহারা কাব্যটি প্রকাশ করেন। এতে তিনি কৃষাণের গান, শ্রমিকের গান, ধীবরদের গান অর্থাৎ সমাজের ব্রাত্যদের নিয়ে জাগরণীমূলক কবিতা লিখেছিলেন। তিনি উচ্চকণ্ঠে বলেছিলেন:
ওরে ধ্বংস-পথের যাত্রীদল!
ধর্ হাতুড়ি, তোল্ কাঁধে শাবল।।
১৯৮০-এর দশকে বিশ্বব্যাপী subaltern studies জনপ্রিয় হতে থাকে। উত্তর-ঔপনিবেশিক কিছু ভারতীয় তাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদ যেমন দীপেশ চক্রবর্তী, রণজিৎ গুহ, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, পার্থ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ এই নব তত্ত্ববিপ্লবের ককপিটে ছিলেন। যারা ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে প্রান্তে অবস্থান করে, যাদের নিজস্ব কোনো স্বর নেই, যারা ঔপনিবেশিকতার পাটাতনে পিষ্ট-নিষ্পেষিত সেসব নারী, কৃষক, শ্রমিকরাই হলো subaltern বা নিম্নবর্গ। নিম্নবর্গরা hegemony বা শাসকদের আধিপত্যের সাথে জড়িত নয়। গায়ত্রী স্পিভাক তাঁর 'Can the Subaltern Speak' প্রবন্ধে স্পষ্টতই বলেছেন যে নিম্নবর্গের মানুষেরা কথা বলতে পারে না। তাদের কথা ঔপনিবেশিক শাসক কিংবা মধ্যবর্গীয় জাতীয়তাবাদী শাসকদের কর্ণে প্রবেশ করে না। কিন্তু কিছু কিছু পণ্ডিতদের মতে নিম্নবর্গের কন্ঠস্বরই শোনা যায় না। এই নিম্নবর্গের মানুষেরাই নজরুলের কবিতায় মূল অনুষঙ্গ। সাহিত্যের উচ্চমার্গীয় ধারণাকে এড়িয়ে নজরুল নিম্নবর্গের জ্বালা-দাহ-নিপীড়ন-দমনকে করেছিলেন তাঁর কবিতার উপজীব্য। এখানে আরেকটি বিষয় বলে রাখা ভালো যে সাহিত্যে যে শিল্পের জন্য শিল্প, শাশ্বত মূল্য এসব পুঁজিবাদী/এলিটিস্ট নন্দনতত্ত্ব উপেক্ষা করার জন্য নজরুলকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। জীবনানন্দ দাশ তাঁর 'নজরুলের কবিতা' প্রবন্ধে লিখেছেন, "মনের উৎসাহে লিখতে তিনি প্রলুব্ধও হয়েছিলেন; নিভে যাবার আগে বাংলার সময়পর্যায় তখন বিশেষভাবে আলোড়িত হয়ে উঠেছিল বলে। এ-রকম পরিবেশে হয়তো শ্রেষ্ঠ কবিতা জন্মায় না, কিংবা এতেই জন্মায়, কিন্তু মননপ্রতিভা ও অনুশীলিত সুস্থিরতার প্রয়োজন। নজরুলের তা ছিলো না। তাই তাঁর কবিতা চমৎকার, কিন্তু মানোত্তীর্ণ নয়।" হুমায়ুন আজাদ নজরুলকে 'মহাপদ্যকার' হিশেবে আখ্যায়িত করেছেন। নজরুলের সমকালে এই নিয়ে তাঁকে অনেক বিদ্রুপ সহ্য করতে হয়েছিলো। তাঁর সর্বহারা কাব্যের অন্তর্গত 'আমার কৈফিয়ত' কবিতায় তিনি বলেছেন:
বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই 'নবি'।
কবি ও অকবি যাহা বল মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি!
কেহ বলে, তুমি ভবিষ্যতে যে
ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে!
যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে বাণী কই কবি?
দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী!
আমাদের সকলেরই জানা যে নজরুলের শৈশব ছিলো অতলান্ত দারিদ্র্যে ক্লিষ্ট। জীবিকার জন্য কখনও তাঁকে মক্তবে শিক্ষকতা, কখনও রুটির দোকানে চাকরি, এবং শেষে সৈনিক জীবন বেঁচে নিতে হয়েছিলো। তাঁর জন্মস্থান ছিলো চুরুলিয়া গ্রাম যেটি মূলত কয়লাখনি প্রধান একটি এলাকা। তিনি কয়লা শ্রমিকদের জীবন প্রত্যক্ষ করেছিলেন, উপলব্ধি করেছিলেন আপামর জনসাধারণের দুঃখ-কষ্ট-গ্লানি-বেদনা-কন্ঠরোধ। তাই তাঁর কবিতায় ঘোষিত হয়েছিলো শোষিত-নিপীড়িত মানুষের উচ্চকিত জয়গান। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের বিখ্যাত তাত্ত্বিক ওয়াল্টার বেনজামিন তাঁর 'The Work of Art in the Age of Mechanical Reproducibility'-তে শিল্পের শাশ্বত মহিমা, সৃজনশীলতা, প্রতিভাকে সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছিলেন যে এগুলো মূলত পুঁজিবাদী চিন্তাদর্শকেই বেগবান করে। প্রত্যেক যুগই তার স্বপ্রয়োজনে সাহিত্য উৎপাদন করে এবং আমরা যাকে আধুনিকতা বলে মানি তাও একসময় অনাধুনিক হয়ে যাবে। নজরুল আধুনিক কবি কি না এটি এই আলোচনা বিষয়বস্তু নয়, বরং নিম্নবর্গের মানুষকে নজরুল কীভাবে তাঁর কবিতায় চিত্রায়িত করেছিলেন তা-ই এই আলোচনায় দেখাতে চেষ্টা করবো। শুরু করা যাক ১৯২২ সালে প্রকাশিত 'অগ্নিবীণা' কাব্য থেকে। এই কবিতাগ্রন্থে তাঁর সুবিখ্যাত 'বিদ্রোহী' কবিতায় তিনি প্রচলিত বাইনারি অপজিশনকে ভেঙে দিয়ে শক্তিহীনদের গান গেয়েছেন। সাধারণ থেকে বিশেষ, দুর্বল থেকে শক্তিমান, বিজিত থেকে জয়ী, অবনত শির থেকে দুর্বীনিত শিরে রূপান্তর হওয়ার দুর্মর বাসনা ব্যক্ত করেছেন। ঔপনিবেশিক শাসনের শোষণ-তোষণ ভেঙে দিয়ে তিনি 'একা চির উন্নত-শির'-এ পরিণত হয়েছেন। তিনি 'মানব-বিজয়-কেতন', তিনি সেদিনই শান্ত হবেন:
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না—
নিম্নবর্গের প্রতি নজরুলের অসাধারণ মমত্ববোধ প্রকাশ পেয়েছে 'সাম্যবাদী' কাব্যে। এই কবিতাগ্রন্থে মানবতাবাদী কবি নজরুল সমাজের ব্রাত্য-পতিত মানুষের জয়গান গেয়েছেন উচ্চকিত কণ্ঠে। কবিতার শরীর হবে বিমূর্ত, কবিতায় সর্বদা সত্য ও সুন্দরের স্তবগান গাওয়া হবে নজরুল এমনটা মনে করতেন না। তিনি তাঁর ব্যক্তিক অভিজ্ঞতায় যা প্রত্যক্ষ করেছেন তা-ই ব্যক্ত করেছেন তাঁর কবিতায় ও গানে। সাম্যবাদী কাব্যে তিনি দলিত-নিষ্পেষিত নারীদের জয়গান গেয়েছেন ভীম স্বননে। তিনি বলেছেন:
"বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি'।
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে!
আলোচ্য কবিতাটি 'জেন্ডার চেতনার অগ্রপথিক'। এই কবিতাটি নারীবাদীতার প্রধান পাথেয় হয়ে আছে।তৎকালীন ঔপনিবেশিক চিন্তাকাঠামোয় বারাঙ্গনাদের নিয়েও যে কবিতা লেখা যায় তা অকল্পনীয় ছিলো। নজরুল জাতপাত এসবের ঊর্ধ্বে উঠে সমাজের একদম নিচুস্তরের, অস্পৃশ্য বারাঙ্গনাদের নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তিনি তাদের মা বলে সম্বোধন করেছেন। বারাঙ্গনাদের ঘৃতাচী, গঙ্গা-মেরির সমান আশ্রয় দিয়েছেন। এখানেও নজরুল সমস্ত বাইনারি শৃঙ্খল ভেঙে দিয়েছেন। পাপ কবিতায় পাপী-তাপীদের ভাই বলে সম্বোধন করেছেন। তিনি বলেছেন:
বিশ্ব পাপস্থান
অর্ধেক এর ভগবান, আর অর্ধেক শয়তান
ধর্মান্ধরা শোনো
অন্যের পাপ গনিবার আগে নিজেদের পাপ গোনো!
চোর-ডাকাত, মিথ্যাবাদী, রাজা-প্রজা, কুলি-মজুর প্রভৃতি কবিতায়ও তিনি subaltern বা নিম্নবর্গের মানুষদের জয়গান গেয়েছেন, ভেঙে দিয়েছেন বিভেদরেখা, গুটিয়ে দিয়েছেন বাইনারি অপজিশন যার মাধ্যমে সমাজে হেজেমনিক ও আইডিওলজিক্যাল নিষ্পেষণ বলবৎ থাকে। চোর-ডাকাত কবিতায় বলেছেন:
পেতেছে বিশ্বে বণিক-বৈশ্য অর্থ-বেশ্যালয়,
নিচে সেথা পাপ-শয়তান-সাকি, গাহে যক্ষের জয়!
প্রলয় শিখা কাব্যের অন্তর্ভুক্ত 'চাষার গান' কবিতায় তিনি লিখেছেন:
আমাদের জমির মাটি ঘরের বেটি,
সমান রে ভাই!
কে রাবণ করে হরণ
দেখব রে তাই।।
আমাদের মতে নজরুল প্রধানত সংগীতজ্ঞ, দ্বিতীয়ত কবি। গান সম্পর্কে নজরুল বলেছিলেন: "আপনারা আমার কবিতা সম্পর্কে যা ইচ্ছা হয় বলুন কিন্তু গান সম্পর্কে নয়। গান আমার আত্মার উপলব্ধি।" নজরুল প্রায় তিন হাজার গান লিখেছিলেন যার মাঝে প্রায় ৭০০-এর মতো শ্যামা সঙ্গীত। নজরুল শ্যামা সঙ্গীত রচনার মাধ্যমে মূলত নিষ্পেষিত, নির্যাতিত, কালো নর-নারীর গান গেয়েছেন, যাদের কথা ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছাতো না। আমরা জানি যে রবীন্দ্রসঙ্গীতে কথাই মুখ্য, নজরুলগীতিতে সুরই প্রধান, কথা গৌণ। তিনি বিভিন্ন জাগরণী গান, মার্চ সংগীত রচনার মাধ্যমে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে এক নতুন সাম্যের সমাজ বিনিমার্ণের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর 'জাগো নারী জাগো বহ্নি শিখা', 'ও ভাই মুক্তি সেবক দল', 'ওঠরে চাষী, জগদ্বাসী, ধর ক'ষে লাঙ্গল' এরকম অসংখ্য গানে নিম্নবর্গের করুণ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন।
কাজী নজরুল ছিলেন রাজনৈতিক সচেতন কবি। ঔপনিবেশিক সরকারের সমালোচনা, ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি, নিম্নবর্গের আর্তবক্ষের নাদ শব্দে রাঙানোর জন্য তাঁর পাঁচটি গ্রন্থকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো; জেলে যেতে হয়েছিলো বেশ কয়েকবার। সাম্য, নিম্নবর্গ ও সংশ্লেষণের কবি কাজী নজরুল চেয়েছিলেন সমাজে বিদ্যমান যেসব বাইনারি বিরোধিতা যুগের পর যুগ বৈষম্য জিইয়ে রাখে তাদের মূলোৎপাটন করতে। তাইতো তিনি কবিতা আর গানকে বেঁচে নিয়েছিলেন অব্যর্থ আয়ুধ হিশেবে যার মাধ্যমে তিনি শোষিত-নিপীড়িত-অন্ত্যজ শ্রেণির জয়গান গেয়েছিলেন, লিখেছিলেন এমন সব জীবনের বাদ পড়া কথা-স্বর যাদের জীবনগাঁথা কবিতায় ছিলো চিরউপেক্ষিত। চণ্ডীদাসের পর নজরুলের মতো এত বড় মানবতাবাদী কবি কেউ ছিলেন না—এতটুকু বললে মনে হয় অত্যুক্তি হবে না।