প্রাচীন চর্যাপদ মূলত নগরকেন্দ্রিক। গ্রামের কোনো উল্লেখ সেখানে নেই। মধ্যযুগের সাহিত্য প্রধানত দেবনির্ভর এবং পুনরাবৃত্তি দোষে দুষ্ট। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে নগর-গ্রাম ঘুরেফিরে এসে থাকলেও বর্তমানিক সময়ে নগরকেন্দ্রিকতাই নিরঙ্কুশ। মূল আলোচনাটা কবিতার ভূগোলে সীমাবদ্ধ রাখবো।
বাংলা কবিতায় নারীর নামকরণ খুবই একপেশে এবং প্রথাগত। উপন্যাসে মুসলিম নারীর প্রচলিত নাম অঙ্কিত হলেও কবিতায় প্রায় শূন্য। আমাদের কবিতায় কিংবা গানে পারমিতা, নীলা, চারু, অবন্তী এসব কাব্যিক নামে ভরপুর। কিন্তু বাস্তবের রহিমা, হালিমা, শিউলি, মারুফা এসব নাম কবিতায় অপাংক্তেয়। কবিতার এসব গুলশানীয় নামের পরিবর্তে বস্তীয় নাম ব্যবহার করা যায় কি না তার কিছু নিরীক্ষা করা যেতে পারে। আমরা আমাদের রুচি পাঠকের ওপরে ও পাঠকের রুচি আমাদের ওপর আরোপ করে থাকি অবচেতনভাবে। বিষয়টি নিয়ে আরেকটি লেখায় বিস্তারিত আলাপ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে মিখাইল বাখটিন ও রোল্যান্ড বার্থেসের সাথে পরিচয় থাকলে লেখার সময় লেখক-পাঠক-তৃতীয় সত্তার ত্রিভুজীয় প্রভাব সম্পর্কে পষ্ট একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
বাংলা কবিতায় ঘুরেফিরে যেসব শব্দ বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে, যাকে বলা যেতে পারে বাঙালি অ/কবিদের শব্দের ভূগোল সেসব শব্দের একটি তালিকা হতে পারে অনেকটা এরকম: বৃক্ষ ফল ফুল নদী হাঁস রাত সকাল দুপুর সন্ধ্যা শীত বসন্ত রৌদ্র সাগর ঝরনা জল ওষ্ঠ চোখ দেহ শরীর আকাশ নক্ষত্র পাতা দেয়াল নিখোঁজ অন্ধকার নীল কালো শাদা হাত স্তন নাভি শহর নগর পুকুর ঢেউ মৃত্যু জীবন স্নায়ু বৃষ্টি মেঘ বেদনা কষ্ট যন্ত্রণা শরৎ স্বপ্ন বিপ্লব কৃষ্ণচূড়া গোলাপ বৈশাখ শিমুল পলাশ দুঃখ বক্ষ বই ঘোড়া এরকম আরও কিছু প্রথাগত শব্দ। দুশো বা তিনশোর মতো শব্দ অভিজাত শ্রেণির, বাকিগুলো প্রায় ব্রাত্য।
বাংলা কবিতায় নিম্নবর্গের ও মধ্যবর্গের মানুষের শ্রম ঘাম অভাব ব্যাধি বেকারত্ব ক্ষোভ দ্রোহ প্রেম বিরহ বিচ্ছেদ ক্লেদ নির্বেদ আটপৌরে জীবন ইত্যাদির স্তবে মুখর। কিন্তু উচ্চবর্গের জীবনের প্রেম কষ্ট বেদনা বিরহসহ আরও জটিল অনুষঙ্গগুলো কবিতায় অনুপস্থিত। এর কিছু কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বেশিরভাগ কবিরাই মধ্য ও নিম্নবর্গের। তাই তারা তাদের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে পুষ্ট করে কবিতার শরীর। উচ্চবর্গের জীবন সম্পর্কে যেহেতু তারা ওয়াকিবহাল নন, সেহেতু কবিতায় তারা ব্রাত্য, অনুপস্থিত।
রৈবিক ও উত্তররৈবিক যুগের কবিদের মন মূলত ইউরোপকেন্দ্রিক। অধিকাংশ কবিরা মনের বিউপনিবেশায়ন করতে পারেননি৷ তাদের বোধেরও বিমানবিকীকরণ করতে পারেননি। পাশ্চাত্যের তুলনায় বাংলা কবিতায় মৌলিকত্ব খুবই কম ও নগণ্য। এখানে এমন অনেক কবি আছেন যারা বইয়ের পর বই বের করেছেন, কিন্তু উৎকৃষ্ট কিংবা মৌলিক কবিতা রচনা করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন৷ শামসুর রাহমান কিংবা নির্মলেন্দু গুণ-এর বইয়ের সংখ্যা সংখ্যাতীত।
সমকালিক বাংলাদেশের কবিতার প্রধান বিষয়দুটো হলো: লুতুপুতু প্রেম আর প্রকৃতি। প্রায় ৯৯% কবিতাই প্রথাগত, পুনরাবৃত্ত এবং অতিকথিত। এগুলো পদ্যও নয়, প্রলাপ। স্বভাবকবি অধিকাংশ এবং এদের জ্ঞান ও জীবনবীক্ষণ খুবই সংকোচিত সংকীর্ণ ও সীমিত। জীবনানন্দ দাশ তাঁর 'বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ' প্রবন্ধে বলেছিলেন, "কেবলই খণ্ড কবিতার সিদ্ধি নিয়ে দূরতর ভবিষ্যৎ তৃপ্ত হয়ে থাকবে বলে মনে হয় না।" তিনি দীর্ঘ কবিতার ভবিষৎবাণী করেছিলেন। পরিতাপের বিষয় এখন দুই লাইন এমনকি এক লাইনের প্রলাপে সয়লাব বাংলা কবিতার সমকালিক শরীর। ভবিষ্যতে হয়তো দীর্ঘ কবিতার পুনরুত্থান হবে না, কিন্তু এরকম হ-য-ব-র-ল অবস্থা যে কাটবে তাও মনে হচ্ছে না। তবে একথা চিরন্তন সত্য যে যতই সময় গড়াবে প্রকৃতি কবিরা ততই প্রোজ্জ্বল ও উজ্জ্বল হয়ে ওঠবে।