অস্ট্রিক ঋষি সামসময়িক কবিদের মধ্যে অন্যতম। এই ধীমান ও স্বল্পপ্রজ কবির কবিতার মাঝে রয়েছে এক অদ্ভুত চন্দ্রকর যা সংক্রমিত করে একজন কবিতাপ্রেমীর হৃৎপিণ্ড। তার প্রতিটি শব্দের ভেতরে রয়েছে সুঘ্রাণ, সেই সুঘ্রাণের ভেতরে রয়েছে জগৎ ও জীবনের ক্লেদ। তার কবিতার ঔজস্য পাঠকের চিত্তকে ঋদ্ধ করে মুগ্ধ করে শুদ্ধ করে।

বইমেলা ২০২২-এ সহস্রাধিক কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। যে কয়টি কবিতার বই পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে তার অধিকাংশই উৎকৃষ্টরূপে নিম্নমানের। এত কাব্যগ্রন্থের ভীড়ে কিছু মেদুর, পেলব, মৌহালী ও অনবদ্য কাব্যগ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে যেগুলোর পাঠে হৃদয় তৃপ্ত হয়, মন প্রশান্ত হয়, দেহ পায় প্রশান্তির মাদক। কবিতার একজন একনিষ্ঠ অনুরাগী হিশেবে, আমার বিবেচনায়, এটুকু বলতে পারি যে এবারের বইমেলায় যে কয়টি কাব্যগ্রন্থের হদিস পেয়েছি তার মাঝে অস্ট্রিক ঋষির 'নদী সব মিশে যাচ্ছে এন্ড্রয়েড ফোনে' অন্যতম। তিন ফর্মার এ গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে এমন কিছু কবিতা যেগুলোর ভাব ও ভাষা লক্ষ্যভেদী, সুচারু সুন্দর ও অলোকসাধারণ। এর কিছু কিছু কবিতা, আমার মতে, উৎকৃষ্ট ও মেদহীন। মৌহালী শব্দবল্লরি আপনার চিন্তাকে নাড়া দেবে, আপনার বোধকে বিভ্রান্ত করবে,আধুনিক কবিতার মরুতে আপনি যে জলের সন্ধান করবেন তৃষ্ণা মেটানোর জন্য তা পাবেন ঋষির ঋষিপ্রোক্ত লেখায়। তার কবিতার শরীরের সৌন্দর্য একজন পাঠককে নিয়ে যাবে সুউচ্চ পাহাড়ে, বিবিধ দিগন্তে কিংবা জনাকীর্ণ মাঠে। কবিতার জন্য, শুধু কবিতার জন্য এমন নেশা, এমন সম্মোহন, এমন স্বমেহন জাগাতে পারে অস্ট্রিক ঋষির কবিতা।

ঋষির কাব্যগ্রন্থটি কি সাহিত্যের মানদণ্ডে উৎকৃষ্ট? উত্তর চর্যাপদীয় নয়, হ্যাঁ। প্রশ্ন করা যেতে পারে উৎকৃষ্ট কাব্য জিনিসটা কী? মেদহীনভাবে বলা যেতে পারে যে কাব্যের ডিকশান ঋদ্ধ, ভাব ও বোধ কালিক ও কালোত্তীর্ণ হওয়ার স্থিতিস্থাপকতা আছে, পাঠে হৃদয় পরিশুদ্ধ হয়, ঝংকৃত হয় আত্মায় ও নিউরনে, উপমা-রূপক-উৎপ্রেক্ষাসহ নন্দনতত্ত্ব ও সাহিত্যদর্শনের প্রতিফলন ঘটে তাকে উৎকৃষ্ট কাব্য বলা যেতে পারে। কবিতা কাকে বলে এবং কবি হওয়ার তরিকা কী কী সেসব মাথায় রেখেই বলা যেতে পারে এ সময়ের অন্যতম ধীমান ও ঔজসিক কবি হলেন অস্ট্রিক ঋষি যে একেকটা কবিতাকে 'এমনভাবে টেনে-ছিঁড়ে হাজির করতে চায় যেন নিজের স্বরটাকে দিতে পারে প্রকৃষ্ট ঘেউ-রূপ'। গতানুগতিক ও প্রথাগত কবিতার ভূগোল থেকে দূরে অথচ পলাতক নন এমন একটি ভিন্ন স্বর, যাকে তিনি অভিহিত করেছেন 'ঘেউ-রূপ' হিশেবে, দেখা যাবে তাঁর সাড়াজাগানো বই 'নদী সব মিশে যাচ্ছে এন্ড্রয়েড ফোনে'।

উত্তরকাঠামোবাদ-এর দৃষ্টিকোণ থেকে একটি গ্রন্থকে আমরা 'টেক্স' হিশেবে আলোচনা করতে পারি কিংবা একে আমরা বিমানবিকীকরণ তত্ত্ব কিংবা রোলাঁ বার্থ-এর 'লেখকের মৃত্যু' এই আলোকেও পাঠ করতে পারি। গ্রন্থটিতে মোট ২৬টি কবিতা ও ৩টি অণুকবিতার সমাহার রয়েছে। আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক কবিতার শরীর, বুনন, গঠন, রসায়ন, এর আত্মা ও আত্মজ অনুষঙ্গ মনে রাখলে কবিতার রস আস্বাদনে তেমন জটিলতা দেখা যায় না। ঋষির কবিতা সহজপাঠ্য সহজপাচ্য হলেও সহজবোধ্য নয়। ঋষির কবিতার প্রকৃত স্বাদ পেতে হলে আপনাকে ধৈর্যশীল হতে হবে, পাঁচটি ইন্দ্রিয়কে সবর্দা সক্রিয় রাখতে হবে। তবে আশার বাণি এই যে আপাত দুর্বোধ্য সত্ত্বেও পাঠক পাতার পর পাতা পড়ে যাবেন এক অলৌকিক আবেশে।

গ্রন্থটির প্রথম কবিতাটির নাম অর্থময়তা। এই অর্থময়তা শব্দটি পলিসেমি হিশেবে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থহীন জীবন—টাকা কিংবা মিনিং দুই ছাড়া জীবন আপাত অচল। তবে মিনিং শব্দটি আপেক্ষিক এবং সাবজেক্টিভ। কবিতাটিতে এই  সাবজেক্ট এবং অবজেক্ট-এর দ্বন্দ্বের মাধ্যমে এর ভাব প্রমূর্ত হয়ে ওঠেছে। জগতে কোনোকিছুই চূড়ান্ত বিচারে অর্থহীন নয়। কবিতাটিতে একটি দার্শনিক সংকটকে উসকে দেওয়া হয়েছে। মানুষ যে স্নায়ু নিয়ে পৃথিবীতে আসে তার রং শাদা, পরে তা রঙিন হয়ে ওঠে বিভিন্ন দূষণে ও অদূষণে। এই দূষণ-অদূষণের বাইনারিতে আমরা আরোপ করি আমাদের অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস। নাম কবিতাটিতে মূলত কালিক ও কালোত্তীর্ণ একটি ভাবের বৃত্তায়ন করার প্রচেষ্টা লক্ষ করার মতো। আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এদেশের বিরাট অংশ এন্ড্রয়েড ফোন ব্যবহার করে থাকে। আইফোন ব্যবহার করার মতো সক্ষমতা সবার নেই। এ এন্ড্রয়েড ফোনের রূপকের ভেতর দিয়ে একটা জাতিরাষ্ট্রের মনোভাব তিনি ব্যক্ত করেছেন। আমাদের বর্তমানিক জীবন, চিন্তাধারা প্রায় সবকিছু মিশে যাচ্ছে এই এন্ড্রয়েড নদীতে।

অস্ট্রিক ঋষিকে বলা যেতে পারে শব্দসন্ত, যে শব্দের গভীর থেকে ছেঁকে আনেন অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য—নিক্ষেপপূর্ব মিসাইল। তার কবিতার প্রতিটি শব্দ পৃথক হয়েও আশ্চর্য বিন্দুতে গ্রথিত—ভাব ও বোধ, চিন্তা ও কল্পনার বিন্দু থেকে জায়মান হতে থাকে জ্যামিতিক বিহ্বলতা, যেমন 'নদী সব মিশে যাচ্ছে এন্ড্রয়েড ফোনে' কবিতায়:

আজ
এই মুক ও বিষণ্ণ গভীর মেঘনায়
বৈঠার অবুঝ আঘাতে
ছিন্নভিন্ন চাঁদের মতোই একা ও অস্থির আমি
ফুটে উঠেও ফেটে পড়ছি জলে।

আধুনিক কবিতার জগৎ জটিল ও বিপর্যস্ত। মতিভ্রষ্ট বৃদ্ধের ভাষার মতো দুর্বোধ্য ও চর্যাপদীয়। তাই পাঠক পাঠের সময় বিভ্রান্ত হয়ে পরিত্যাগ করেন কবিতা ভোগের সুখ। অস্ট্রিক ঋষির কবিতা দুর্বোধ্য হলেও সুখবোধ্য। তার কবিতার মাদকতা সংক্রমিত করে বোধকে, চিন্তার ফল্গুধারাকে। তার 'নভোকল্পনা' কবিতায় পরাবাস্তববাদের ভেতর দিয়ে প্রমূর্ত হয়ে ওঠেছে এমন এক জগৎ যেখানে থাকবে না কোনো 'সংখ্যাতাত্ত্বিক চিহ্ন', যেখানে কবির স্বপ্নবীর্য থেকে সৃষ্ট নারী, ঋমু যার নাম, হারিয়ে যায়, এবং যেখানে 'অস্ত্রাগার তৈরির জন্য মানুষের চিহ্নমাত্র নেই'। 'সম্প্রীতি' কবিতায় কবি বিসাদৃশ্যের মাঝে প্রছন্ন সাদৃশ্য-সম্প্রীতি লক্ষ করেছেন। কিছুটা 'কেইয়স থিওরি'র মতো।

অস্ট্রিক ঋষি চাষ করেন শব্দের, যে শব্দ ভাষাহীন তাকে দান করেন শাব্দনির্মাল্য। তিনি মালিন্য দূর করে সৃজন করে সৌন্দর্যের। তাই তার কবিতায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কুৎসিত সৌন্দর্য, যে সৌন্দর্য ফেটে পড়ে গভীর কষ্টে, সুনিপুণ ব্যথায়, ও পরম আশ্চর্যে। তার 'ডিম ফাটার মুহূর্তে' কবিতায় আমরা রূপকের ভেতরে আবিষ্কার করি এমন সব বোধের, এমন সব সংকটের, এমন সব স্থবিরতার যারা দ্রোহী, গতিশীল, এবং নিউটনীয় জড়তাতত্ত্ব অতিক্রম করে কবিকল্পনায়, যেমন:

খড়কুটো, নাড়া আর ফেঁসোর ভিতরে
ধীরে ধীরে ফাটতে থাকে ডিম।

ভাষিক বৈপরীত্য দিয়ে থাকা না-থাকার দ্বন্দ্ব বোঝা যায়। আলো আছে মানে আলো নেই। মৃত্যু আছে মানে জীবন আছে। বিশ্বাস আছে মানে অবিশ্বাসও আছে। এই বিশ্বাস ও অবিশ্বাস, আস্থা ও অনাস্থা, অমৃত ও গরল এমন কতিপয় বাইনারির দ্বন্দ্ব দেখা যাবে 'মানুষ-সংলগ্ন কয়েকটি অব্যয়' কবিতাটিতে। মানুষ সম্পর্কিত তিনি যে বাইনারি এঁকেছেন তা শাশ্বত, যেমন:

তবু, মানুষ-মূলত একটা ফুল;
মধুর বিপরীতে যে লালন করে বুকভরা বিষ।

আবার এ মানুষই মানুষকে খুন করে, ধ্বংস করে একটা জনপদের স্বপ্ন, ঘুম করে কল্পনা। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত কিংবা পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মানুষই হরণ করে অন্য মানুষের সুখ, সঙ্গম, জীবন, যেমন 'যে জীবন অস্ত্রাঘাতে শুরু' কবিতায় বলেছেন:

জন্মের পর কার সাথে পরিচয় হয়েছিল তোমার?
ধাত্রী? নাকি ধাত্রীর হাতে থাকা ছুরি—
কে তোমাকে অভিবাদন জানিয়েছিলো প্রথম?

যদি ছুরি হয়, সে তো অস্ত্রই
যদি ধাত্রী হয়, হাতে তো অস্ত্রই ছিল

মানুষ—
চিরকাল তোমাকে অস্ত্রের সাথেই পরিচয় করাবে

শেষের তিনটি কবিতা মূলতা অণুকবিতার সমাহার। আমি যাকে বলি 'স্ট্যাটাস কবিতা'। ইংরেজদ কবি ও সমালোচক ম্যাথিউ আরনল্ড-এর টাচস্টোন মেথড প্রয়োগ করেছি এ অণুকবিতগুলোর মূল্য নিরূপণ করতে। আমার মতে এগুলোও চমকপ্রদ। কেউ কেউ প্রবচন, ম্যাক্সিমও বলে থাকেন। কিছু নমুনা:

১. ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের মতো মা আমাকে পড়ে ফেলেন নিমিষেই।
২. একটি মাছের আয়ুর সমান একটি বকের খিদে
ও মাছরাঙা, ঠোকর মারো আমার মৎস-হৃদে।
৩. স্বাধীনতার প্রতীক যে পতাকা সেও থাকে রশির কাছে বন্দী
৪. জ্ঞান সেই প্রসাধনী যা উঠে যাবার ভয় নেই

ফর্ম এর দিক থেকেও কিছুটা নতুনত্ব লক্ষ করা যায়। যতিহীন কিংবা যতিবিহীন এই জগতে মানুষ এক শাশ্বত অনিকেত। এই বোধ থেকে হয়তো কিছু কবিতা যতিহীন থেকে যায়। এতে প্রসারিত হয় আমাদের কল্পরাজ্য— যার ভিত্তি বস্তুজগতের জটিলতা। একটা কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করছি ছন্দ এ যুগে ততটা জনপ্রিয় নয়। আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক বিশ্বসাহিত্যে ছন্দের ব্যবহার নেই বললেই চলে। ছন্দ ব্যবহার না করার অনেক কারণ রয়েছে, এর মাঝে যুগমানস অন্যতম। এ গ্রন্থের কিছু কবিতার অন্ত্যমিল রক্ষিত হলেও সেখানে প্রচলতি ছন্দ প্রয়োগের রীতি অনুপস্থিত। কবিতায় কিছু নবসৃষ্ট শব্দও রয়েছে যা হৃদয়কে পুলকিত করে। জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন 'উপমাই কবিতা'। যদিও এটি কবিতার ক্ষেত্রে খুবই সংকীর্ণ একটি ধারণা, তবুও উৎকৃষ্ট উপমা আমাদেরকে মন্ত্রমুগ্ধ সর্পের ন্যায় মোহিত করে। এ বইটিতে তেমনি কিছু উপমা লক্ষ করার মতো:

সিজারিয়ান মহিলার পেটের সেলাইয়ের মতো একটা রেললাইন চলে গেছে বস্তির উদর চিরে
(বিষণ্নরকমের সুন্দর)

নোট: এটি একটি সরল ও নাতিদীর্ঘ আলোচনা।