সামসময়িক যারা বাংলা কবিতা চর্চা করেন, যারা কবিতার আবাদ করেন, ছোঁ-মারা চিলের মতো শাব্দসমুদ্র থেকে শিকার করেন প্রকৃষ্ট শাব্দ, অস্ট্রিক ঋষি তাদের মধ্যে একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি। অল্পপ্রজ ও মেধিষ্ঠ এই তরুণ কবি নিভৃতে কাব্যদেবীর আরাধনা করে যাচ্ছেন। কাব্যই তার সাধনার বিষয়, তার ধ্যান ও জ্ঞানের আশ্রম, তৃষ্ণকতা ও ক্ষুদবোধ।
প্রথমেই কাব্যটির নামকরণ নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয়। সতী মূলত একজন পৌরাণিক চরিত্র যিনি ব্রহ্মার অন্যতম মানসপুত্র দক্ষপ্রজাপতির কন্যা ও মহাদেবের স্ত্রী। মূলত শব্দটির সাথে দেবীত্ব আরোপ করা হয়েছে তখন। ঋষি তার একটি কবিতায় বলেছেন যে শব্দও পারফিউম পরে থাকে। একটি শব্দের কোনো স্থির অর্থ নেই। অর্থ নির্ভর করে কনটেক্সট-এর উপর। বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক সোস্যুর-এর মতে ভাষায় সব শব্দই 'differentiating networks'-এর মাধ্যমে কাজ করে থাকে। পতিতালয় এর বিপরীত শব্দবন্ধ সতীতালয়। অনেক পাঠক হয়তো নামকরণ ও প্রচ্ছদ দেখে বিভ্রান্ত হতে পারেন। একটা শব্দের মূলত দুই ধরনের অর্থ থাকে যথা: denotation ও connotation। এখানে সতীতালয় শব্দটি আমার মতে connotative অর্থই বেশি দেয়। নামটি কিছুটা paradoxical এবং ironical এই অর্থে যে যাদের প্রথাগত অর্থে আমরা 'সতী' আখ্যায়িত করি, তাদেরকে এই সতীত্ব বজায় রাখতে গিয়ে অনেককিছু বিসর্জন দিয়ে তা প্রমাণ করতে হয়। ক্ষমতার পার্থক্য ও ম্যাটেরিয়াল কন্ডিশন-এর কারণে এই বদ্বীপে নারীরা নির্যাতিত ও শোষিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে এবং তাদেরকে বিভিন্ন ট্রমার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। যা-কিছু পতিতালয় নয় তা-ই যদি সতীতালয় হয়ে থাকে তাহলে এই সতীতালয়ের বিভিন্ন ধরনের জটিল মানসিক ও অস্তিত্ব সংকট, বিভিন্ন যৌনবাসনা ও অবদমন, পুরুষ ফ্যান্টাসি, সমাজের ভেতরে চাপাপড়া বিবিধ ব্যাধি এবং বিভিন্ন habitus-এ বসবাসরাত ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের মগ্নচৈতন্য গভীরভাবে জানতে, বুঝতে ও অনুধাবন করতে হলে, এবং একইসাথে কবিতার শরাবে মুগ্ধ হয়ে এক ধরনের sublime অনুভব করতে হলে পাঠ করতে হবে এই বইটি।
অস্ট্রিক ঋষির 'সতীতালয়' ভিন্ন ধরনের স্বাদের সন্ধান দেয় যা বাংলা সাহিত্যে অনাস্বাদিতপূর্ব। একটি কবিতার ভাব যেখানে শেষ বলে প্রতীয়মান হয় পরবর্তী কবিতার ভাবটি ঠিক সেখান থেকেই শুরু। ঠিক যেন সীমান্তের মতো—শুরু-শেষের খেলা। কবিতাগুলোর শেষে কোনো দাঁড়ি চিহ্ন নেই। এর দ্বারা প্রতিটি কবিতার ভাব ও প্রবহমানতা পরবর্তী কবিতায় সংক্রমিত হয়েছে। এভাবে ৪৮টি কবিতার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এক সুদীর্ঘ কবিতার শরীর। লক্ষণীয় বিষয় এই যে কবিতাগুলোর আলাদাভাবেও রস আস্বাদন সম্ভবপর। একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্তও পড়া যায় আবার ভিন্ন ভিন্নভাবে আলাদা করেও পাঠ করা যায়। Narrative style মূলত fragmentation এবং juxtaposition এভাবে গড়ে উঠেছে যা কালিক বৈশিষ্ট্যকেই ফুটিয়ে তুলেছে।কবিতাগুলোতে মাঝে মাঝে প্রশ্ন রাখা হয়েছে যা পাঠকের স্নায়ুকে আন্দেলিত করবে, কল্পনাকে বিস্তার করার ক্ষেত্রে অনুঘটক হিশেবে কাজ করবে। এটি ঋষির কবিতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ঋষি শুধু ছত্রের পর ছত্র সাজিয়েই ক্ষান্ত হন না, মাঝে মাঝে দার্শনিকের ন্যায় প্রশ্নও ছুড়ে দেন। যেমন:
"ঝরনা কি কেবলি আনন্দস্রোত, নাকি পাহাড়ের ক্ষতস্থান বেয়ে নেমে যাচ্ছে জলজ রক্তপাত?"
কবিতাগুলোতে ড্যাশ-এর ব্যবহার লক্ষণীয়। সাধারণত ভাবের চ্ছেদ কিংবা ভিন্ন বিষয়ের অবতারণা, কিংবা অর্থকে স্থগিত রাখা, কিংবা অনুক্ত রাখতে কবিতায় ড্যাশ ব্যবহার করার প্রচলন আছে। প্রখ্যাত আমেরিকান কবি Emily Dickinson-এর কবিতায় ড্যাশ এর প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। নমুনা:
"I taste a liquor never brewed –
From Tankards scooped in Pearl –
Not all the Frankfort Berries
Yield such an Alcohol!
Inebriate of air – am I –
And Debauchee of Dew –
Reeling – thro' endless summer days –
From inns of molten Blue –"
বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দ দাশও প্রচুর ড্যাশ ব্যবহার করেছেন যা তার কবিস্বভাবের সাথে তাৎপর্যপূর্ণ। নমুনা:
"জীবনের এই স্বাদ– সুপক্ব যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের–
তোমার অসহ্য বোধ হ’লো;
মর্গে কি হৃদয় জুড়োলো
মর্গে— গুমোটে
থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে।"
ঋষির এই কাব্যগ্রন্থেও প্রচুর ড্যাশ-এর দেখা মেলে। সতীতালয়ে সতীদের ট্রমা, স্ট্রাগল, মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন, কৈশোরিক যৌনানুভূতি, মনোবিকলন, ট্যাবু, কবিতার অন্তর্গত ভাব ও বোধকে প্রকাশ করতে ড্যাশ-এর ব্যবহার যথাযথ। নমুনা:
"একটা কিশোরী—মহারাত্রির বুক খুঁড়ে খুঁড়ে—আনমনে হেঁটে যায় যদি
বখাটে ছেলের মতো যদি তার পিছু নেয় চাঁদ, যদি তাকে সতর্কে রাখে
জ্যোৎস্নার সংক্রমণে, আহ্লাদে, কৃতজ্ঞতায়—বনে বনে ফুটে উঠবে ফুল"
আধুনিক ও বিশেষকরে উত্তরআধুনিক কবিতায় ছন্দ তেমন গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ নয়। প্রথাগত ছন্দ না থাকলেও প্রতিটি উৎকৃষ্ট কবিতায় অন্তর্গত ছন্দ থাকে। আধুনিক বাংলা কবিতায় মুক্তক অক্ষবৃত্তে রচিত কবিতার সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। অনেকে গদ্যছন্দেও লিখে থাকেন। কবিতায় অন্ত্যমিল থাকতে হবে এমন কোনো কথা নেই। ওয়াল্ট হুইটম্যান, টি. এস. এলিয়ট, জীবনানন্দ দাশসহ অনেক আধুনিক কবির কবিতায় শেষে অন্ত্যমিল নেই। সমকালিক জীবনবোধ, বিচ্ছিন্নতা, ট্রমা, নৈঃসঙ্গ্য, অর্থহীনতা প্রভৃতি বোঝাতে গিয়ে অনেকেই প্রথাগত ছন্দে লিখতে চান না। ঋষির কবিতায় এককভাবে প্রথাগত ছন্দ অনুপস্থিত থাকলেও মাঝে মাঝে অক্ষরবৃত্তের সন্ধান মেলে। নমুনা:
"তোমার সৌন্দর্য নিয়ে কথা হবে; মহল্লার মাঠে, ল্যাম্পপোস্টের আলোয়
মাছের দাঁড়ার মতো ভেসে উঠে—ঝটকা দিয়ে চ'লে যাবে তুমি
বঁড়শিসহ টোপ নিয়ে, হঠাৎ ফাতনার মতো দুলে উঠবে আমাদের হৃদয়।"
'উপমাই কবিত্ব' বলেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। কবি শামসুর রাহমান বলেছিলেন 'প্রতীক চিত্রকল্পই কবিত্ব'। হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন 'চিত্রকল্পই কবিত্ব'। সতীতালয় জুড়ে চিত্রকল্পের পর চিত্রকল্প, প্রতীকের পর প্রতীক। একটি দৃশ্য শেষ না হতেই আরেকটি দৃশ্যের অবতারণা। কবি একের পর একে দৃশ্য শব্দের রঙে রাঙিয়ে তুলছেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় উপমার ছড়াছড়ি থাকলেও তাঁর উপমা শুধু উপমাই নয়। এগুলো একাধারে উপমা ও চিত্রকল্প। নমুনা:
"চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে—
কুড়ি বছর পরে
কিংবা
চায়ের পেয়ালা ক’টা বেড়ালছানার মতো—ঘুমে—ঘেয়ো
কুকুরের অস্পষ্ট কবলে"
সতীতালয়ের প্রতিটা কবিতা জুড়ে রয়েছে চিত্রকল্পের পর চিত্রকল্প। এখানে কিছু কিছু উপমা একইসাথে চিত্রকল্পও বটে। কিছু নমুনা:
"দানে ছড়িয়ে পড়া সবচেয়ে বড় মার্বেলটির মতো সহজ লক্ষ্যবস্তু হয়ে ভেসে ছিলো যে পানকৌড়ি
সঙ্গমপূর্ব ঠোঁটের মতো চেয়ে দেখো মধ্যাহ্নের দুপুরে
বখাটে ছেলের মতো যদি তার পিছু নেয় চাঁদ
কিংবা
সহসা শিশ্নের মতো একদিন জেগে উঠবে চাঁদ"
আরেকটি নমুনা:
"শিকারীর থাবা থেকে মুক্ত হ'য়ে এসেছে যে ছিন্নভিন্ন শরীর, তার
সংক্ষুব্ধ শিরায়—আঁচড়ের রক্তাক্ত দাগে—সংঘবদ্ধ মাছির বিরুদ্ধে
লেজের প্রতিবাদ হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছো, তুমি; সঙ্গমপূর্ব ঠোঁটের মতো
চেয়ে দেখো মধ্যাহ্নের দুপুরে—বনের ছায়ার মাঝে কেঁপে উঠছে রোদ"
প্রত্যেক শক্তিমান কবির একটা নিজস্ব শৈলী রয়েছে। ঋষি তার কবিতায় ভাবনার ভেতরে অনুভাবনা, দৃশ্যের ভেতরে দৃশ্যান্তর ঘটান। ঋষির ভাষায় 'ফাঁকা মেঠোরাস্তায় একটু পরপর গাছের মতো'। ডিকশন বিনিমার্ণে ঋষি যেন এক সুচারু শব্দপ্রকৌশলী। কিছু নমুনা: স্বনির্মিত সন্ধ্যা, স্রোতের স্তন, যৌন-অনুষদ, দুপুরের যৌনাঙ্গ, কুয়াশার নাভি, কিশোরী হাওয়া। ঋষির কবিতাগুলোতে এপিগ্রাম ও এফোরিজম ভরপুর। যেমন:
১. তুমি সেই মাছ, কাঁটার উপরিভাগে মেলে ধরো মাংসের ছলনা
২. যে আত্মহত্যা বেঁচে নেয় সে সাহসী, যে জীবন বেঁচে নেয় সে দুঃসাহসী
৩. হরিণের পিছে যে বাঘ ছুটছে—সে-ও জীবন বাঁচাতেই ছুটছে
৪. ফাটার নিয়তি নিয়ে বেলুনেরা ফোলে
৫. যে ফুলটা তুলে দিচ্ছ প্রেমিকার হাতে, মনে রেখো, বোঁটার সাথে রয়েছে তার বিচ্ছেদের সম্পর্ক।
ঋষির কবিতায় প্রতিতুলনাজাত অলঙ্কারের মধ্যে উপমার প্রয়োগ সর্বাধিক। উৎপ্রেক্ষারও দেখা মেলে। যেমন:
"এমনভাবে চুমো খান, যেন আমি কসাইয়ের ছুড়ে দেয়া মাংসপিণ্ড"
আরেকটি নমুনা:
"ঘুমন্ত খরগোশ যেন তুমি"
এগুলো মূলত বাচ্যোৎপ্রেক্ষা। রূপকের দৃষ্টান্তও আছে। যেমন:
১. প্রেম এক বিশুষ্ক চারা
২. আমি সে নদীর ঢেউ
৩. পৃথিবী তো সেই পরিত্যক্ত টায়ার
আধুনিক কবিতার শরীর জটিল, তিগ্ম ও দুরবগাহ। এর ভাব, অনুষঙ্গ ও প্রকরণ চর্যাপদীয়। পাঠকেরা প্রায়ই অভিযোগ করেন আধুনিক কবিতা বোঝা যায় না। সুধীন্দ্রনাথের ভাষায় 'যে দুরুহতার জন্ম পাঠকের আলস্যে, তার জন্য কবির উপরে দোষারোপ অন্যায়'। ইংরেজি রোমান্টিক আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিলো কবিতায় সহজ ও আটপৌরে শব্দ ব্যবহার, কিন্তু ভিক্টোরিয়ান পিরিয়ড-এর পরে আধুনিক যুগে এসে তা সর্পিল থেকে বিসর্পিল হতে থাকলো। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো 'The Waste Land'।
যেকোনো 'টেক্সট'কে দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। একটি গতানুগতিক অর্থাৎ ছন্দ, ডিকশান, উপমা, রূপক, ও কবিতার ভাব। অন্যটি সাহিত্য তত্ত্বের সাহায্যে। ঋষির কবিতায় প্রতিতুলনাজাত অলঙ্কারের মধ্যে উপমার বাহুল্য লক্ষ করার মতো। অন্যান্য অলঙ্কার তেমন দেখা মেলে না। কেউ কেউ অবশ্য কাব্যকে অলঙ্কারবিহীন করার পক্ষে, তবে এমন আন্দোলন এখন পর্যন্ত সফল হয়নি। কিছু কিছু উপমার বদলে উৎপ্রেক্ষা ব্যবহার করা যেতো কিংবা রূপক ব্যবহারের মাধ্যমে অবয়বে পরিবর্তন ঘটানো যেতে। কবিতার বিষয়বিচিত্রতাও কম প্রতীয়মান হতে পারে। কিছু কিছু জায়গায় ভাবের রিপিটেশন লক্ষ করা যায়। তবে একথাও প্রায় সর্ববিদিত যে একালে কবিতার ভাবই মূল বিষয়। কবিতার দেহ থেকে কবিতার মন কিংবা 'psyche' অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
এবার দৃকপাত করা যাক কাব্যের অন্তর্গত বয়ানের দিকে। একটি কবিতাকে ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্বের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। আলোচ্য কাব্যগ্রন্থটির মনকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে আমরা মনোবিশ্লেষণ-এর কিছু tools ব্যবহার করবো। গ্রন্থটিতে আমরা একজন কথক/narrator-এর দেখা পাই যে বিবিধ ঘটনার ব্যাখ্যাকার মাত্র। ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে জগৎ ও যাপিত বাস্তবতাকে সে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করছে। কথক মূলত একজন 'decentered self' যে একজন 'বাদ পড়াদের দলে' এবং 'জীবন থেকে একটু দূরে গিয়ে বসে' বিভিন্ন সমাজবাস্তবতা ও ঘটনা পরখ করছে। একজন 'অনির্বাচিত কবিতা', তাকে 'বিষণ্ন কপোল থেকেও সম্প্রচার' করতে হয় হাসি। নিচের ছত্রে তার অস্তিত্বের সংকট ফুটে উঠেছে এভাবে:
"আমি সেই খয়েরি পাতাটি, শুকিয়ে মর্মর; সবুজ পোকার পাশে উৎকর্ষে ম্লান"
তবে কথক হলেন সেই দুর্মর বেতস গাছের মতো যে অতলান্ত হতাশা, মহাসাগরীয় সংকটের মাঝেও খুঁজে নেয় জীবনের রঙিন। কথকের কথায়:
"যে আত্মহত্যা বেঁচে নেয় সে সাহসী, যে জীবন বেঁচে নেয় সে দুঃসাহসী"
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যমান বিভিন্ন ধরনের পীড়ন, অসঙ্গতি কথার বিশেষকরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থার কথা তুলে ধরছেন এভাবে:
"হাত পা ও শ্রবণশক্তিহীন অন্ধ ভিক্ষুকের থালার মতো অরক্ষিত, অনিরাপদ
সন্ধ্যার বাগানে শুয়ে থাকা, ছিন্নবসনা, ক্ষুধায় কাতর কোনো কিশোরীর
দৃঢ় ইজ্জতের পাশে থালাভর্তি ভাতের প্ররোচনা নিয়ে দাঁড়িয়েছে যে দালাল
তার হাসির শব্দের মতো রহস্যময় অশ্লীল একটা সম্বন্ধ এসেছে তোমার।"
আগেও বলা হয়েছে যে কথকের মাঝে আমরা বিভিন্ন ধরনের হতাশা লক্ষ করি। তার এই হতাশার কারণ হতে পারে oral fixation। ফ্রয়েডের মতে শৈশবে এই স্টেজে যদি কোনো শিশুর satisfying needs মারাত্মক ব্যাহত হয় তবে সে সাধারণত pessimistic হয় যার প্রভাব যৌবনে তীব্রভাবে প্রতিফলিত হয়। এমনি এক হতাশাবিধৌত যৌন অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে:
"আর আমি,—প্রথম সঙ্গম শেষে বিধ্বস্ত শয্যায়—শুয়ে থাকা মধ্যবয়সিনীর
আরও বেশি বিধ্বস্ত, আশাহত মুখের দিকে চেয়ে—অপরাগতার লজ্জায়
প্রমাদ গোনা তরুণের সংক্ষিপ্ত শিশ্নের মতো নিস্তেজ, চুপসে আছি ভয়ে—"
লক্ষ করার বিষয় এই যে এটি কথকের প্রথম যৌমসঙ্গম। কাব্যের কথক যখন আনমনা বালক (মনে রাখতে হবে যে কথক একজন decentered self যে ভিন্ন ভিন্ন আমিতে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিতে ও দৃশ্যে উপস্থাপন করছে!) তখন খালার বিবাহ জনিত কারণে তার মাঝে এক ধরনের হতাশা অনুমান করা যায়। যদিও বলা হয়েছে আনমনা বালক, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে আনমনা নয়। আনমনা হলে তো ঘটনাটি তার মাঝে এত শূন্যতা সৃষ্টি করবে কেনো? তাহলে সে কি defense mechanisms ব্যবহার করার মাধ্যমে নিজেকেই self-deception-এর আশ্রয় নিচ্ছে? কথকের খালার বিবাহের জন্য মন খারাপ হওয়া না কি অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে যা সভ্য সমাজে প্রকাশ করা কঠিন? নমুনা:
"আমি আনমনা বালক, নানার বাড়িতে এসে—খেলতে গিয়ে নবান্নের মাঠে
সন্ধ্যায় ফিরে দেখি—সুনসান বাড়ি, কোথাও আনন্দ নেই—ওম নেই,
খালার বিবাহ হয়ে গেছে"
কথকের বর্ণনার মাধ্যমে আমার পারিপার্শ্বিক জীবন, ঘটনা, ও বিবিধ সংকট সম্পর্কে জানতে পারি। জানতে পারি কীভাবে একটি কিশোরের মাঝে যৌনবাসনা গড়ে ওঠে, কীভাবে সে যৌনতার ধারণা পায়, তার মাঝে গড়ে উঠে বিভিন্ন ফ্যান্টাসি। যেমন:
"স্নানঘাট ছেড়ে যাওয়া আদ্রবসনা মহিলাদের পদছাপ দেখে দেখে
যে কিশোর স্বপ্ন দেখবে ফুল, তার নিদ্রা-পরাগায়নে—মুখের লালায়
উৎকট গন্ধময় একটি বালিশ—এই সমাজ, তুলে এনে রোদে নিয়ে যাও,
বদলে দাও ওয়াড়"
প্রায় প্রতিটি কবিতায় কোনো না কোনো ভাবে যৌন অনুষঙ্গ উঠে এসেছে। কবিতাগুলোতে মূলত অবদমিত যৌনবাসনার কথা প্রকটভাবে বলা হয়েছে, এবং এর পেছনে মূলত রাজনৈতিক ও সমাজবাস্তবতা কাজ করেছে তীব্রভাবে। এখানে মূলত পুরুষদের desires ও fantasies-এর ওপর দৃকপাত করা হয়েছে। সতীতালয়ে নারীদের সবসময় সতী হওয়ার জন্য লড়াই করে যেতে হয়। বদ্বীপের বাস্তবতায় তাদের যৌনবাসনা দমন করে রাখতে হয়। C. G Jung যাকে বলেছেন 'The Persona' যা মূলত 'an aspect of our personality that we present to the world as a means of social adaptation and personal convenience'. এখানে অনেকেই 'persona'। মূলত শৈশব থেকেই একজন শিশু নিজেকে আলাদা ভাবতে শেখে। ফ্রয়েড যাকে ego বলেছেন এই পর্যায়ে এসে একজন শিশু সে নিজেকে বুঝতে শেখে। তার মাঝে self-এর ধারণা গড়ে ওঠে। Lacan যাকে symbolic অর্ডার হিশেবে বর্ণনা করেছেন। এই symbolic order-এ এসে ভাষার মাধ্যমে শিশু নিজেকে আলাদা সত্তা ভাবতে শুরু করে। এখানে থেকেই lack-এর ধারণা শুরু হয়। আমাদের সমাজে নানা ধরনের ট্যাবু রয়েছে এবং বিভিন্ন অবদমনের মাধ্যমে যেতে হয়। একটি কবিতায় এই দ্বিধান্বিত কিশোরকে 'খাতাজুড়ে স্কেচ' আঁকতে দেখা যায়। কীসের স্কেচ আঁকে তা আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় না। কৈশোরিক ফ্যান্টাসির নমুনা:
"মার হাতে বেত্রাহত কিশোর, লুকিয়ে পড়ে পাশের বাড়ি—চাচীর আঁচলে
বুক ও বিশ্বস্ততার মন্দিরে, স্নেহসংযোগ নিবিড়—শরীরের আচ্ছন্নতার মতো
একটা চাঁদ—ঢুকে পড়ছে মেঘে, লুপ্ত হওয়ার বাসনায়।"
Necrophilia বা শবপ্রীতির কথাও উল্লেখ আছে। এটি মূলত এক ধরনের বিকৃত বাসনা। নমুনা:
"সহসা লেকের জলে—ভেসে উঠবে বস্ত্রহীন রমণীর লাশ, শহর এমন
অজ্ঞাতকুলশীল কুমারীর খোলা বুকের দিকে তাকিয়ে—দারাগো ও ডোম
যখন খুঁজে ফিরছে কোনো ইঙ্গিত, শরীরজ চিহ্ন তাদের ব্যর্থ দৃষ্টির মতো
উদাস হাওয়ায়—"
যৌনতার বহুমাত্রিক দিক কবিতায় উঠে এসেছে। যুদ্ধাহত বন্দি সৈনিকও শুক্রশিবিরে সেবিকার প্রতি যৌনাকাঙ্ক্ষা অনুভব করে। মেইল গেইজ, অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ, যৌনতার জন্য নারীর প্রতি সমাজের ডাবল স্ট্যান্ডাড, ব্যক্তিগত ব্যর্থতাবোধ, সমকালিক যুগযন্ত্রণা, অসম প্রেম, মার্জার (গোপন প্রেমিক), বন্ধকীদের কথাও উঠে এসেছে। অমর্ষের প্রসঙ্গ যেমন আছে তেমনি অজাচারও বাদ যায়নি।