আহেরি টোলার আনন্দ খাঁ লেন এ বদরী প্রসাদ
শুয়ে আছেন।সুরের  'সৌকিন ' বলেই ডুবে আছেন
সাত সুরে ।আজও মজলিশ বসেছে ।তবে বদরীর
ঘরে নয়।দুরে,অন্য কোথাও ।পাগল করা সুর বদরীপ্রসাদের রক্তে মাতন লাগাচ্ছে ।সুরের
মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়ছে।
।এ রাগ বাগেশ্রী না হয়ে পারে
না।পন্চম স্বর  কে আরোহে বর্জন । কুশলতার সাথে
নিখাদ এর ব্যবহার ।

নারী কন্ঠ যেন কাঁদছে ।কন্ঠ ভেংগে ভেংগে যাচ্ছে
সম্ এ পড়তে-----
"ক্যায়সে কহুঁ মোরিআলী কে রতিয়া
পিয়া বিনা জিয়া মোরা কছু না সুঝাবে।"
শুরু হলো বোলতান-------
গা মা ধানি সা গা রে সা
নিধ মগ  মগ রেসা ।
সুরের লহরী গড়িয়ে চলেছে ।এমন হৃদয় বিদারি
গান যে গাইছে তাকে কি চিনতে ভুল হবে বদরীর?

না।তা হবে না ।এমন পরিস্কার স্বর বিন্যাস আর
কারও নয়।শ্রাবণের মেঘের মতো কেঁদে চলেছে
সেই নারী ।
রাতের মজলিসে র অপেক্ষায় দিন কাটে বদরী
প্রসাদের ।এই নারী বদরীর প্রাণের ও প্রিয় ।
সংগীতের আলাপ করতে করতে মাঝে মাঝে
পকড় এ আশ্রয় নিচ্ছে ।স্থায়ী  শেষ হতে শুরু হলো
বোলতান,অন্তরা ।
নিদ্রা যদি বা একটু ছিল ।ছুটে গেল অলংকারের
প্রয়োগে ।-------যব সে গ্যয়ে,সপন  না আয়ে,
------সামা  গামা ধামা  ধানি সানি সাসা
নিনি ধধ মম গগ রে সা।
যতবার তান শুরু হচ্ছে গমকে গমকে দুঃখের
তরংগ সৃষ্টি হচ্ছে ।বদরীর শরীরে রক্তের প্লাবন
হচ্ছে ।সে প্লাবন থামানোর ক্ষমতা নেই বদরী
প্রসাদের ।বুকটা মোচড় দিচ্ছে ।গান নয় যেন
আকুলিবিকুলি  করছে-----"।
চোখে ভেসে উঠলো পুরানো ছবি ।---------
"ক্যায়সে কহু "-কচি গলার কান্না ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরে ।তানপুরা,সিতার,তবলা,বাঁশি,মৃদংগ বাজছে
দ্রুত লয়ে ।এমন তবলিয়া বাজনদার ছিল জমিনদার উমেশ  প্রসাদের বাগান বাড়ির মজলিসে ।তবলার অমন তেহাই  খুব কম শোনা যায় ।
গানের রেশএ ডুবে যান বদরী প্রসাদ ।চোখের
সামনে সুদৃশ্য ভেলভেটের ফরাশ ।তার উপরে
বসে আছেন বড়ে হজুর ।পাশে মুন্নি বাই।মজলিস
আলো করে বসে আছে মুন্নি বাই।তার পাশে
অবগুণ্ঠিতা এক  নারী ।
-----কে তুমি? --প্রশ্ন করলেন বদরী ।ভাবলেন,এই
আঁধার ঘরে কে?এটা তো আনন্দ খাঁ লেন এর ঘর।
চোখ বুঝলেন ।সুরে ডুবে গেলেন ।
দৃশ্য বদলে গেল ।লখ্নৌ এর বাইজি মহল।

সদরে পৌঁছলেন এক সুন্দর যুবক ।পড়নে তার ফিনফিনে আর্দির পাঞ্জাবী আর গিলে করা ধুতি ।
হাতে বেল ফুলের গোরের  মালা।তাম্বুল রাগে
রাংগানো ঠোঁট জোড়া ।যুবকের নাম বদরী প্রসাদ ।
জমিদার পুত্র ।
বাইরে দালানে বদরীর পা পড়তেই খিদমতকারিরা
ছুটে এসেছে ।
------আইয়ে হজুর ।আরাম সে আইয়ে।আর একজন বলেছে ।--------কোঠী মে  আপকা
স্বোয়াগত  হ্যয় ।কিস কা ঘর মে আপ্ জায়েংগে?

প্রথম জন বলল-----আরে রূকনা।ছোটে হজুর
যে সে ঘরে যাবে না ।নয়ী চিড়িয়া এসেছে হজুর ।
একেবারে কচি মাংস ।
বাইশের জমিদার পুত্র থমকে গেছেন ঐ কচি
কথাটা শুনে ।একি পাঁঠা?একটা মেয়ের এমন
দুর্দশা?
সদ্য বিদেশ থেকে পড়াশুনা করে এসেছেন ছোটে
হজুর ।বড়ে হজুরের নারী লোলুপতার কথা কে না
জানে এ তল্লাটে ।তবে আর যেই জানুন ছোট হজুর
জানতো না সে কথা ।না জানলে ও মায়ের চোখের
জলের কারণ যে নারী ঘটিত তা আঁচ করেছিল
বিদেশ যাওয়ার আগে ।
বড়ে হজুরের  প্রচুরা টাকা  । সে টাকার বেশির ভাগ তিনি সুরা আর নারীতে ব্যয় করতেন।ছেলে যাতে বাবার মতো না হয় তাই মা হজুরাইনের অর্থাৎ বড়ে হজুরের স্ত্রীর ইচ্ছায় পুত্রকে বিদেশে পাঠানো হয় ।সুদীর্ঘ পাঁচ বছর পর জমিনদার উমেশ প্রসাদের ও ননীবালা চিনতে পারলেই না তাদের ছোট্ট  বদরী প্রসাদ কে।
এ কোন বদরী!সুঠাম দেহের অধিকারী এক যুবক ।
পেয়াদার সাথে উপস্থিত ।যুবক বদরী আশ্চর্য হলেন
যখন দেখলেন বড়ে হজুর তাঁকে বুকে টেনে নিলেন ।
বললেন-----খুশ রহো ।
পাঁচ টা বছর মায়ের কাছে না থেকে এখন
মায়ের আদরটা সহ্য করতে পারছে না বদরী ।
বদরীর বাবার আদর টা অন্য রকম ।হাতে এক
গুচ্ছের টাকা দিয়ে বলবেন----যাও
-মজে মে রহো ।
-মজাটা যে কি তা  অনুমান করা গেল এই 'কোঠী '
-বাড়ি তে আসার পর ।বড়ে হজুর আখতার কে
-বুঝিয়ে দিলেন ঈষাড়ায় ।তা তখন না বুঝলেও
-এখন বুঝতে পারছে বদরী প্রসাদ ।ভাবনা টা
-ছুটে গেল আখতার এর কথায় ।"চলিয়ে ছোটে হজুর নয়ী চিড়িয়াকা ঘর মে।"
-চিড়িয়া কথা টা শুনে রাগ হলেও কিছু বললো না
-বদরী ।বদরীর ধারে কাছের বয়স হবে আখতারের।
-নারী লোলুপ বলেই দাঁত বার করে হাসছে ।মুখে
-কিছু না বললে নয়,তাই বদরী জেদ করে ই বললো
------তু মেরা সাথ নহি আনা।নয়া লড়কির ঘরে
হামি যাবে ।
-------জী হজুর ।হমে কুছ-----।
আখতার ইচ্ছে করে ই কথা টা শেষ করলো না ।বদরী এক মুঠো টাকা আখতারের হাতে তুলে দিলো।

ছিমছাম ঘর।দেওয়ালে ছবি ঝুলছে মালা গলায়
রবিঠাকুরের ।মনে হচ্ছে না এটা প্রস্ কোয়ার্টার ।
ঘরের দেয়ালের তাকে অনেক বই।বদরীর প্রথম
এই জায়গায় আগমন ।বাঈজীর ঘর মানেই জলসার
জন্য একেবারে  তৈরী ঘর বলে ভেবেছিল ।
সংগের লোকটি একটা হাঁক দিলো ----বাঈজী সাহেবা!তোমার ঘরে ছোট হজুর এসেছেন ।

সংগে সংগে পাশের ঘরের দরজা খুলে গেল ।একটি
মেয়ে উঁকি দিলো।বছর পনেরো হবে বয়স ।পড়নে
স্কার্ট ব্লাউজ ।দুটো বিনুনি পিঠের উপরে ।ভাবতে
পারে না বদরী ।এমন মেয়ে কোঠী বাড়িতে থাকে!
এ তো ভদ্র বাড়ির মেয়ে মনে হচ্ছে ।
লোকটি বলল---হজুর আপ্ ঘর মে যাইয়ে।

মেয়েটি বলল----বসুন।একেবারে খাঁটি বাংলা ভাষায় ।বদরী প্রসাদ মেয়েটির নির্দেশিত সোফায় বসে পড়লো।একেবারে কাঁচা বয়স মেয়েটির ।
বদরী প্রসাদ বললো------তোমার নাম?
সেই মেয়ে উত্তরে বললো----ললিতা ।
সেই নামেই ডুবে গেছে বদরী ।নজর কাড়া সেই
মেয়ে ।বদরীর প্রথম এমন মেয়ে দর্শন ।বারেবারে
চোখ চলে যাচ্ছে সেই মেয়ের দিকে আবার নজর
ফিরছে ।কানে এলো মিষ্টি গলা।
-------এখানে কি আপনি প্রথম  এসেছেন?
বদরী ফিরে তাকালো তার দিকে ।
বললো----হ্যাঁ ।এই প্রথম ।
ললিতা বললো----আবার আসবেন ।এখানে আমার
ভালো লাগে না ।
চমকে উঠলো বদরী ।তবে কি এই মেয়ে স্বইচ্ছায়
এখানে আসেনি?সেই মেয়ের চোখে জলের আভাস।
চমকে উঠলো বদরী প্রসাদ ।না একে এখান থেকে
বার করতে হবে ।আবার আসার কথা দিয়ে উঠে
এসেছে বদরী প্রসাদ ।
****************
বেশ কয়েক দিন যেতে আখতারের ওপর রাগটা
কমেছে বদরীর ।কারণ মন টেনেছে ললিতা ।আর
ললিতার কাছে যেতে আখতার কে চাই ।
সকাল থেকে ই ঠিক করে নিয়েছে বদরী বিকেলে
আজ যাবেই যাবে ললিতার ঘরে ।সেদিন ললিতার
ঘর থেকে ফেরার পর মায়ের জেরার মুখে পড়তে
হয়েছে বদরী প্রসাদকে।মায়ের চোখে সন্দেহের বিষ
ঢুকে গিয়েছিল বদরীর হাতে বেল ফুলের গোরের মালা আর রাংগানো ঠোঁট জোড়া দেখে ।বাণ ছুটেছে
আখতারের দিকে ।
-------আখতার তু মেরি ঘরমে মৎ আয়া কর।আমার
ছেলেটাকে তুই কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস তা আমি জানি ।লেকিন এটাই শেষ ।আমার বাড়িতে আর আসবি না ।
বদরী প্রসাদ চেয়ে ছিল ওর মায়ের অপমানিত
মুখ খানার দিকে ।কতো শত অপমান ঐ বুকের
মাঝে জমাট বেঁধে আছে ।স্বামীর কোঠী বাড়ি যাওয়া
অপমান নয়?কিন্তু ছেলেকে তিনি সেখানে যেতে
দিতে নারাজ ।তাই রূখে দাঁড়ালেন ।

সেদিন বদরী মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল আর
কোঠী বাড়ি যাবে না ।কিন্তু তা হলো না।ললিতা ওকে
টানছে ।যেতে ই হবে বদরীকে।অমন একটা ভদ্রবাড়ির মেয়ে ফাঁদে পড়েছে  কোঠী বাড়ি তে ।
**************
আজ আর বেল ফুলের গোরের মালার দরকার নেই ।
ললিতার  সাথে বদরীর দেখা হয়েছে দুবার ।এরই
মধ্যে বদরী বুঝে নিয়েছে ললিতা কি ধরনের মেয়ে ।
যৌনতার ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি নিজেদের ।
শুধু ই গল্প ।কখনো ট্যাগোর, কখনো সেক্সপিয়র ।
মিলনান্ত না বিয়োগান্ত?কার কোনটা ভালো লেগেছে। "মার্চেন্ট অফ্ ভেনিস"ট্রায়াল সিন এর
কার  কত লাইন মনে আছে ।ললিতার ইংরেজিতে
এতো জ্ঞান দেখে বদরী আশ্চর্য হয়েছে ।জিজ্ঞাসা
করেছে ললিতাকে, কোথায় পড়তে তুমি?
ললিতা উত্তরে বললো, ----শান্তিনিকেতন ।সেখান
থেকে দিল্লি ফেরার পথে এক মহিলার সাথে আলাপ
হয়।তিনি আমাকে এখানে নিয়ে আসে ।
বদরী বলে----তুমি চলে এলে?
ললিতা বললো------ঘুমিয়ে ছিলাম ট্রেন এ।জানতে ও পারিনি।কিভাবে এখানে এসেছি।ঘুম থেকে উঠে
দেখি এখানে শুয়ে আছি।আমি হস্টেল এ নেই ।
আমার কাছে বসে আছে মুন্নি বাঈ।
বদরী বললো---কে সে?

ললিতা বললো---এখানকার জমিন দার উমেশ প্রসাদের রক্ষিতা।সবাই বলে বড়ে হুজরাইন।তুমি
বসো।আমি আসছি ।
ললিতা ভেতরে ঢুকে গেছে ।বদরী ভাবে, বড়ে হুজরাইন।মানে বাবার রক্ষিতা ।এই অপমান মা
সহ্য করতে পারেনি ।তাই তিনি চাননি বদরী এখানে
আসুক ।বাবার  মুখের  বলা কথা টা  মনে পড়ে যায় ,
"মজে মে রহো ।"
এই মুন্নি বাঈকে তার একবার দেখার সাধ ও নেই ।
যার জন্য মায়ের অপমানের জ্বালা সইতে হয়েছে ।
তাকে বদরী ও সহ্য করবে না ।

ললিতা ঘরে ঢুকতেই বদরী চমকে তাকালো।এ কাকে
দেখছে বদরী!এ কে!ললিতা!একটু আগের সাজ
বদল হয়েছে ।তখন ছিল স্কার্ট ব্লাউজ ।এখন পড়নে
শাড়ি ।এক ভাবে চেয়ে আছে বদরী ।মুগ্ধ সে।টকটকে গায়ের রং, তায় লাবণ্য বতী শাড়ি পড়ায়
বালিকাসুলভ ভাব টা নেই ।লজ্জাবতী নারী
এসে দাঁড়িয়েছে।
যুবক বদরীর কি সংযমের  বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে?তবে
সংযমের   কি  কোন দরকার আছে?না।একজন
সদ্য নারীত্ব প্রাপ্তা ।আরেক জন পূর্ণ বয়স্ক হওয়া
সত্তেও যৌবনাধর্মের তাগিদ অনুভব করেনি
ললিতাকে দেখে ।ভালো লেগেছে ললিতাকে ।
ওকে ভালো না লেগে পারে?তবে বাবার মতো হতে
পারবে না বদরী ।

কি ভাবছো?----বললো ললিতা ।
বদরী -----তোমার কথা ।ভাবছি তোমায় অন্য
জগতে নিয়ে যাবো।
ললিতা----পারবে না ।বড়ে হজুরই আমাকে এখানে
রেখেছেন ।আমায় নিয়ে যাবে জানলে তোমাকে খুন
করে ফেলবেন ।আমার বাবা সেই চেষ্টা করেছিল  ।
তাঁকেে মেরে ফেলা হয়েছে ।
বদরী-----তোমার বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে?
ললিতা------তোমাকে ও মেরে ফেলবে ।
বদরী-----না,আমায়  মারবেনা ।
ললিতা------বড়ে হজুরের ক্ষমতা কতো তা তুমি
জানো না।
বদরী-----জানি, তবে নিজের ছেলে কে খুন
করবে না ।
ললিতা------তুমি তার ছেলে,?
বদরী-----,--------- হ্যাঁ ।একমাত্র সন্তান ।এখন
বুঝতে পারছি মা কেন আমায় বিদেশে পাঠিয়ে ছিল  ।ললিতা আমি তোমায় এখান থেকে উদ্ধার করবো ।

ললিতা কোন কথা বলেনি।ভয়ের ছায়া ওর চোখে
মুখে।এতো ভয়ের কি আছে বদরী জানেনা ।বাবা
তো অন্যায় করেছে ।একটা মেয়ে কে এখানে তুলে
এনেছে।
ললিতা----ছোটে হজুর তুমি এবার যাও।এখন
ওস্তাদ জী আসবেন।তালিম নিতে  হবে।
বদরী বললো-------না।তুমি তালিম নেবে না ।তুমি
ঘুংগুরূ  বাধবে না  ।

ললিতার অনুরোধে উঠে আসতে হয়েছে তখনকার
মতো ।তবে মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে ললিতাকে
উদ্ধার করতেই হবে ।তবে ললিতা চায় না বদরী এতে
জড়িয়ে পড়ুক ।
ভাবতে ভাবতেই টাংগায় উঠেছে বদরী ।আর ঠিক
তখনই নজরে পড়েছে আখতার কে।দূর থেকে বদরীকে লক্ষ্য করছিলো আখতার ।বদরীর সে
দিকে নজর পড়ায় আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছে
আখতার ।কারণ টা কি হতে পারে ভাবতে ভাবতে
ঘরে ফিরেছে বদরী প্রসাদ ।
ঘরে ফিরে ও বার বার মনে হয়েছে কথাটা ।আখতার
কেন লুকালো নিজেকে?কিসের ভয় আখতারের ।
তবে কি আখতার বদরী কে অনুসরণ করছিল ?
কিন্তু  কেন?
********************

রাত প্রায় বারো টা।চোখ বুজে ও ঘুমাতে পারে না
বদরী ।বৈঠক খানায় মজলিস বসেছে ।সাত সুরের সাথে তানপুরা,সিতার,বাঁশি, মৃদংগ তান ধরেছে ।বাঁশি কথা বলছে ।একথা আনন্দের হলে ও বদরী
আর ওর মা কে আনন্দ দিতে পারে না ।মাঝে মাঝে
'কেয়া বাৎ কেয়া বাৎ' তারিফের শব্দ ভেসে আসছে ।

বিছানা যেন কন্টক শয্যা।লাফিয়ে উঠে বসেছে
বদরী ।কচি মিঠে নারী কন্ঠের সুর ছড়িয়ে পড়েছে
বদরী প্রসাদের ঘরে ।"ছতিয়া  মোর থরথর করে,
যো  যো বুন্দ পড়ে জিয়া লরজে।"

সত্যি' ছাতিয়া 'থরথর  করছে বদরীর ।এ গলা
ললিতার না হয়ে যায় না ।জলসা ঘরের দিকে এগিয়ে
গেল বদরী ।ভেলভেটের ফরাশ পাতা ।তাতে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে আছেন বড়ে হজুর ।
আর খিদমতকারিরা মদিরা এগিয়ে দিচ্ছে ।
ফরাশের অপর প্রান্তে বসে আছেন বর্ষীয়সী এক
সুন্দরী মএই বুঝি  সেই  মুন্নি বাঈ ।তারই পাশে কমল কলির মতো ললিতা ।আজ তার জমকালো সাজ।সারা অংগে গহনার ঝিলিক ।

দরজার পর্দায় আঁকা লাল গোলাপের তোড়া ।তারই
পাশেরএক চিলতে ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে জলশা
ঘরের এক ধোঁয়াশা চিত্র ।বড়ে হজুর মুন্নি বাঈএর
কাঁধে হেলান দিয়ে বসে আছেন ।তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ লাবণ্য বতী ললিতার দিকে ।বদরীর সে নজর ভালো
লাগে না ।তাই কথা না বলে ভেতরে ঢুকে গেছে বদরী ।চমকে ওঠে ললিতা ।তার নজর অনুসরণ করে ই
বড়ে হজুর বদরীর দিকে ।
ভেতরের রাগ দমন করে উমেশ প্রসাদ বললেন-----
-----এ কী!তুমি এখানে?
বদরী-----গান শুনতে পেলাম ।ভালো লাগল ।তাই
চলে এলাম ।গুস্তাকি মাফ্ হজুর ।আমি ভি
সংগীতের সৌকিন ।
উমেশ প্রসাদ বসতে বললেন ।তারপর বললেন---
মুন্নি বাঈ,শুরু করো।
আখতার কে ঈষাড়ায় সূরা দিতে বললেন ।বদরীর
কাছে সুরাপাত্র চলে এলো।কোন দিন বদরী যা
করেনি আজ তাই করলো ।একের পর এক মদিরা
পাত্র খালি করে ফেললো ।বড়ে হজুর স্তম্ভিত ।
এমন টা তো হবার নয়।তাঁর পুত্র কিনা মদে মাতাল। ।
ছিঃছিঃ ।সুর ভাজছে বদরী ।তাও আবার বাঈএর
সাথে ।"ক্যায়সে কহুঁ মোরি ,আলীকে বঁতিয়া
পিয়া বিনা জিয়া মোরা কছু না সুঝাবে ।"

উমেশ প্রসাদের ধৈর্য্য চ্যুতি ঘটলো, ----এবার তুমি
ভেতরে যাও।অন্য সময় বদরীর গানের দখল দেখে
খুশি হতেন হয়তো বা।এখন তা হলো না।
বদরী লাল চোখে উমেশ প্রসাদের দিকে তাকালো।
তারপর ললিতার দিকে ফিরে বলে, বাঈ সাহেবা!
ছোটে হজুর কি গুস্তাকি মাফ্ কিজিয়েগা।খুব
রুপাইয়া কামাও।মজে মে রহো ।খুশ---
পরের কথা শেষ হওয়ার আগেই বড়ে হজুর হুংকার
দিলেন-----আখতার ।ইসে ইহাঁসে লে যাও।

জলসাঘরের সমস্ত বাজনা স্তব্ধ হয়ে গেল ।বদরী
উঠে গেল ললিতার  কাছে ।ললিতার হাত ধরে
টানতে লাগল ।-----চলো, এখান থেকে ।তুমি
কোঠীতে থাকবে না ।আমার সাথে থাকবে তুমি ।
*************************
বদরী চোখ মেলে দেখলো, মা পাশে বসে আছে ।
নজর গেল মায়ের দিকে ।মায়ের চোখে জল।
-------কতো দিন আমি শুয়ে আছি মা হজুর?মৎ রো
মা হজুর।
-------মা হজুর না,মা বোল বেটা ।
-----আমার কি হয়েছে মা?
--------উমেশ প্রসাদ তোকে বাঈ মহলে মারলো ।
আমি ওকে ছেড়ে দিলাম ।আমার বাপের জমিদারি
লেঠেল দিয়ে ওকে মারবো ।ওকে আমি ছাড়ব না।
-----না মা তুমি ফিরে যাও।
-----না,ওর সাথে আর থাকবো না ।

হিংসায় হিংসা আনে।ননীবালার ভাইদের শত্রুতার
শাণ বাড়তে লাগল ।বদরী মাকে বলল, বড়ে হজুরের
কাছে ফিরে যাও মা।
-----তা হবে না বেটা।মুন্নি বাইকে ঘরে এনেছে তোর
বাপ।সংগে আছে আরো একটি মেয়ে ।
------কে ,ললিতা?
-----তুই ওকে চিনিস?
ললিতার সব কথাই বলতে হয়েছে মাকে ।ঘৃণায় মুখ
ঘুরিয়ে নিয়েছেন ননীবালা ।এমন স্বামীর সংসর্গ করে
এসেছেন এতোদিন ।ভাবতে পারেন না তিনি ।
বদরীর মনের ভাবটা বুঝতে তাঁর বাকি থাকেনা ।
তাই বলেন----তুই ওকে নিয়ে আয়।আমি ওর সাথে
তোর বিয়ে দেব।
****************
মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী বদরী প্রসাদ রওনা দিলো বদরী প্রসাদ সাথে লেঠেল সর্দার শিউনন্দন ।অমন
মাসল্ ধারি শিউনন্দন থাকা সত্তেও ভয় পাচ্ছিলো
বদরী প্রসাদ ।ভয়টা নিজেকে নিয়ে যতো টা না তার চেয়ে বেশি ললিতা আর মাকে নিয়ে ।কারণ টা হলো
উমেশ প্রসাদ।
জমিদার উমেশ প্রসাদকে যেমন অনেকে ভয় পেতো ।তেমন তাঁর শত্রু ও ছিল অনেক ।সেই শত্রুদের
পাঠিয়েছেন  মা হজুরাইন।মুন্নি বাই,ললিতা ওরা
কোথায় আছে তাও জানিয়েছে।সে সবের আঁটঘাট
জানা আছে শিউনন্দনের ।
***************
দূর থেকে দেখা খাস মহলের আলো দেখা যাচ্ছে ।
ঝাড়বাতি নিভে গেছে ।কথা অনুযায়ী নীরেন্দ্র গোয়ালার বাড়ি যেতে হবে ।ওখানে ই খবর আসবে
ললিতার ।সে খাসমহলে না জলসা ঘরে।সেই খবরের
ওপরে নির্ভর করছে সব কিছু।কোমরের খাঁজে গোঁজা আছে  ছোট্ট ধারালো অস্ত্র ।ছোটে হজুর
একাই আসতে চেয়েছিল ।তাই অন্যান্য লেঠেলরা
লুকিয়ে আছে ।যাতে দরকারে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।
বদরী প্রসাদ কান খাড়া হয়ে আছে ।কোথা থেকে কি
হয় তা শোনার জন্য ।

নীরেন্দ্র গোয়ালার ঘরে ঠাঁই হয়েছে ।ঘরটাকে যথাসম্ভব ঘষামাজা করা হয়েছে ।কারণ ছোটে
হজুর থাকবেন সে ঘরে ।
হঠাৎ দেখা গেল একটা লোক ছুটতে ছুটতে আসছে ।শিউনন্দন বলল-----ছোটে হজুর,আপ ইহাঁ রূকিয়ে।ম্যায়ঁ আ রহা হু।
সে কথা বলে ই বাইরের দিকে ছুটলো শিউনন্দন ।
চার দিকে বিষম চিৎকার ।মশাল হাতে অগনিত
লোক ছোটা ছুটি করছে ।বদরী ঘরে অপেক্ষমান ।
এরা কারা?শিউনন্দনের কি এতো লোক আছে?
দুটো আলাদা দল হৈ হৈ  রৈরৈ করে ছুটোছুটি করছে।
এই ঘরে ও থাকতে পারবে না বদরী ।কারণ ঘরে
আগুন লাগিয়ে দিয়েছে ।ছুটে বের হতে যাবে বদরী ।কিন্তু তার আগেই দেখলো মাসল ধারি কয়েক  জন   ওঁকে বেঁধে ফেললো ।তারপর জ্ঞান হারালো বদরী প্রসাদ ।
*************
সুসজ্জিত কক্ষে শায়িত বদরী প্রসাদ ।এ ঘর তাঁর
সম্পূর্ণ অচেনা ।পরিচারিকা পর্দা সড়িয়ে ঘরের ভেতরে এলো ।তার হাতে একখানা বারকোষ ।তাতে
রকমারি ফল।বিছানার পাশে রেখে বললো-----
হজুর  ,ফলগুলো খান ।আপনার  শরীর দুর্বল ।তায়
আপনার আজ বিবাহ ।
---------আমি এখানে কতো দিন আছি ? কোথায়
আছি আমি?
-----এটা বারানসী ।বেশ কিছুদিন এখানে আছেন।

বদরী অনেক কথাই বললো ।তার সার কথা হলো
এই যে,বদরীর আজ এখানকার এক জমিদার কন্যার সাথে বিয়ে ।
আজ বিয়ে!ললিতার কি হলো!ওরা কি ললিতা কে
মেরে ফেলেছে?না না তা করবে না ।মা হজুরাইন  ঠিক আছে তো?কি ভাবে পালানো যায় এখান থেকে? ভাবতে ভাবতে মেয়েটিকে বললো-----
----তুমি জানো বড়ে হজুর কোথায় আছে?
------না।তবে আজ সন্ধ্যা বেলায় তিনি আসবেন ।
-----তুমি  আমাকে সাহায্য করতে পারো?আমি
এখান থেকে পালাতে চাই।একটি মেয়ে খুব বিপদে
আছে ।তাকে বাঁচাতে হবে ।
-----কেন?কে সে?
-----'আমি তাকে ভালোবাসি ।তাঁকে বড়ে হজুর
বিয়ে করতে চায় ।আমার বাবা তাকে কোঠী বাড়ি তে
আটকে রেখেছে ।
------কিন্তু কি করে?
------তুমি চাও না আমি তাকে উদ্ধার করি?
******************

বদরী বারাণসী থেকে পালিয়ে গেল সে রাতেই।সেই
মেয়ের সাহায্যেই।দুজনে ই সেখান থেকে পালিয়ে গেল ।কারণ মেয়েটি না পালালে তাঁর ও মরণ ছিল
বড়ো হজুরের হাতে ।
বদরী বলেছিল মেয়ে টিকে তার সাথে আসতে ।কিন্তু
সেই মেয়ে ওর কথায় রাজি হয় নি ।
বদরী  কোঠী বাড়ি তে পৌঁছে দেখলো আখতার সেখানে পাহারা দিচ্ছে ।
বদরী প্রসাদ আখতারের হাত চেপে ধরে বললো-----আখতার ললিতা কো মেরা পাস দে দো।আখতার বললো-----ম্যাঁয় তো উসি কব্ কা ছোড় দিয়া ।চল্।অব হম্ আভি ভাগে  ।নহি তো হজুর হমে
মার ডালে গা।
------লেকিন ললিতা কাঁহা গয়ি?
---------মিল যায়গা ।অব চল।

বাইরের  থেকে গাড়ি এসে দাঁড়ায় ।উমেশ প্রসাদ
নেমে দাঁড়ায় ।হতচকিত আখতার ।বদরী র  হাত
ধরে টানতে থাকে ।উমেশ প্রসাদ পকেট থেকে
রিভলভার বার করেন।নিশানায় আখতার ।বদরী
এক মূহুর্তের জন্যও অপেক্ষা করে না ।কোমরের খাঁজের থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বার করে গুলি করে উমেশ প্রসাদকে ।

আখতার একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে বদরীর হাত
ধরে ছুটতে শুরু   করলো ।বদরী পিছু ফিরতে পারে না আখতারের টানে।
আখতার আর বদরী প্রসাদ যখন মা হজুরাইনের
কাছে পৌঁছালো তখন চারদিকে পুলিশ খুনি কে
খুঁজে বেড়াচ্ছে ।বড়ে হজুরাইন আখতার কে বললেন
---------উসে সামাল কে রখ্না।ভাগ ইহাঁ সে ।ম্যায়
সামহাল লুংগী ।

খুনের দায় নিয়ে নিয়েছেন বড়ে হজুরাইন ।আখতার
কোলকাতার আহিরীটোলায় নিয়ে রেখেছে বদরীকে।
বড়ে হজুরাইন সমস্ত জমি জমা বিক্রি করার বন্দোবস্ত করে দেন।
আখতার আর বদরী ভালো উকিল লাগালো বড়ে
হজুরাইন কে বাঁচাতে ।শেষ অবধি দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে বড়ে হজুরাইনকে।চার বছরের জেল হয়ে
গেল ।বদরীর ভালো  লাগে না ।কুঁড়ে কুঁড়ে খায় বদরীর মনটা ।বাবা কে খুন করলো সে।অথচ তার
দায় নিলো মা ।যে মা তাঁর স্বামীর কাছে কোনো
সম্মান পায়নি ।আরও বড়ো উকিল ধরবে ।মাকে
কষ্টে  দেখতে পারবে না ।বছর ও ঘুরলো না।বদরীর
মা হজুরাইন কে জামিন এ ছাড়িয়ে আনা হলো ।

বদরীর মন ভালো নেই ।কোথায় গেল ললিতা?বদরী
খুঁজে বেড়ায় ললিতাকে ।তার  আজকাল বাঈ মহলে
যাতায়াত বেড়েছে।উদ্দেশ্য একটাই ।ললিতা কে খুঁজে বার করা ।মা হজুরাইন অনেক বলেছে বিয়ে
করতে ।কিন্তু সে রাজি হয়নি ।
আখতার বিয়ে করে সংসার পেতেছে ।ফুটফুটে
একটা মেয়ে হয়েছে ।স্কুলে ভর্তি র সময় বদরী প্রসাদের নাম রয়েছে অভিভাবকের জায়গায় ।
ছোট্ট গুড়িয়া মাতিয়ে রাখে বদরী আর বদরীর  মাকে।

গুড়িয়া র স্কুলে গার্ডিয়ান আর টিচার্স মিটিং।
সেদিন সকালে বদরী প্রসাদ গুড়িয়া কে নিয়ে
যথা সময়ে পৌঁছালো ।ক্লাস টিচার ডেকে পাঠালেন
বদরী প্রসাদ কে।রুম এ ঢুকে বদরী প্রসাদ থমকে গেল ।এ কাকে দেখছে!একেই তো এতোদিন ধরে
খুঁজে বেড়াচ্ছে ।
--------বসুন।
এতক্ষণে ধাতস্থ  হলো বদরী ।চেয়ারে বসে পড়লো।
মুখে কোন ও কথা নেই ।সমাজের কোন স্তরে ললিতা কে  খুঁজে বেড়িয়েছেন ।আর আজ ললিতা  কোথায়
পৌঁছাতে পেরেছে ।কোন পংকিল আবর্তে পৌঁছেছিল ।সেখান থেকে নিজেকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছে ।বুকটা
হালকা হলেও নিজেকে খুব ছোট মনে  হয়েছে ।আজ
আর সেক্সপিয়র এর ট্রায়াল সীন্
এর গল্প করা যায় না। সব কথা শেষ  হয়ে গেছে বদরীপ্রসাদের ।
ফিরে আসার  সময়  ললিতা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ।
হাত মেলানোর জন্য ।নমস্কার জানিয়ে ফিরে এসেছে
বদরী প্রসাদ ।আজও ভোলেনি সেদিনের কথা ।
মনটা হু হু করে উঠছে ।কিসের কষ্ট বদরীর?
বদরী তো ওকে ভালো জায়গায় নিয়ে আসতে
চেয়েছিল ।বাবার কাছ থেকে সরাতে চেয়েছিল ।নাকি ওকে ভালোবেসে ফেলেছিল!সে সব কথা
ভুলতে ই চায় বদরী ।
**********
ঘরে ঢুকে কলকল শব্দে বুকে রক্ত ছল ছলাৎ করে
উঠলো ।এ কাকে  দেখছে সে?ললিতা  বড়ে হজুরাইনের  সংগে গল্পে উচ্ছসিত ।বড়ে হজুরাইন
বললেন-------দেখ,আখতার কাকে এনেছে ।আমার
বেটার মন পসন্দ ।ললিতা আমার  বেটা কে সাদী
করবি তো?
ললিতা বললো--------তোমার বেটাকে জিজ্ঞাসা করো।
বলে চোখে আঁচল দিয়ে  হাসতে লাগল ।

------------------------***************--------------------.

।#গল্পঃ_সপ্তসুর
#লেখকঃ_মেহেদী_হাসান_রনি

আহেরি টোলার আনন্দ খাঁ লেন এ বদরী প্রসাদ
শুয়ে আছেন।সুরের  'সৌকিন ' বলেই ডুবে আছেন
সাত সুরে ।আজও মজলিশ বসেছে ।তবে বদরীর
ঘরে নয়।দুরে,অন্য কোথাও ।পাগল করা সুর বদরীপ্রসাদের রক্তে মাতন লাগাচ্ছে ।সুরের
মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়ছে।
।এ রাগ বাগেশ্রী না হয়ে পারে
না।পন্চম স্বর  কে আরোহে বর্জন ।কুশলতার সাথে
নিখাদ এর ব্যবহার ।

নারী কন্ঠ যেন কাঁদছে ।কন্ঠ ভেংগে ভেংগে যাচ্ছে
সম্ এ পড়তে-----
"ক্যায়সে কহুঁ মোরিআলী কে রতিয়া
পিয়া বিনা জিয়া মোরা কছু না সুঝাবে।"
শুরু হলো বোলতান-------
গা মা ধানি সা গা রে সা
নিধ মগ  মগ রেসা ।
সুরের লহরী গড়িয়ে চলেছে ।এমন হৃদয় বিদারি
গান যে গাইছে তাকে কি চিনতে ভুল হবে বদরীর?

না।তা হবে না ।এমন পরিস্কার স্বর বিন্যাস আর
কারও নয়।শ্রাবণের মেঘের মতো কেঁদে চলেছে
সেই নারী ।
রাতের মজলিসে র অপেক্ষায় দিন কাটে বদরী
প্রসাদের ।এই নারী বদরীর প্রাণের ও প্রিয় ।
সংগীতের আলাপ করতে করতে মাঝে মাঝে
পকড় এ আশ্রয় নিচ্ছে ।স্থায়ী  শেষ হতে শুরু হলো
বোলতান,অন্তরা ।
নিদ্রা যদি বা একটু ছিল ।ছুটে গেল অলংকারের
প্রয়োগে ।-------যব সে গ্যয়ে,সপন  না আয়ে,
------সামা  গামা ধামা  ধানি সানি সাসা
নিনি ধধ মম গগ রে সা।
যতবার তান শুরু হচ্ছে গমকে গমকে দুঃখের
তরংগ সৃষ্টি হচ্ছে ।বদরীর শরীরে রক্তের প্লাবন
হচ্ছে ।সে প্লাবন থামানোর ক্ষমতা নেই বদরী
প্রসাদের ।বুকটা মোচড় দিচ্ছে ।গান নয় যেন
আকুলিবিকুলি  করছে-----"।
চোখে ভেসে উঠলো পুরানো ছবি ।---------
"ক্যায়সে কহু "-কচি গলার কান্না ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরে ।তানপুরা,সিতার,তবলা,বাঁশি,মৃদংগ বাজছে
দ্রুত লয়ে ।এমন তবলিয়া বাজনদার ছিল জমিনদার উমেশ  প্রসাদের বাগান বাড়ির মজলিসে ।তবলার অমন তেহাই  খুব কম শোনা যায় ।
গানের রেশএ ডুবে যান বদরী প্রসাদ ।চোখের
সামনে সুদৃশ্য ভেলভেটের ফরাশ ।তার উপরে
বসে আছেন বড়ে হজুর ।পাশে মুন্নি বাই।মজলিস
আলো করে বসে আছে মুন্নি বাই।তার পাশে
অবগুণ্ঠিতা এক  নারী ।
-----কে তুমি? --প্রশ্ন করলেন বদরী ।ভাবলেন,এই
আঁধার ঘরে কে?এটা তো আনন্দ খাঁ লেন এর ঘর।
চোখ বুঝলেন ।সুরে ডুবে গেলেন ।
দৃশ্য বদলে গেল ।লখ্নৌ এর বাইজি মহল।

সদরে পৌঁছলেন এক সুন্দর যুবক ।পড়নে তার ফিনফিনে আর্দির পাঞ্জাবী আর গিলে করা ধুতি ।
হাতে বেল ফুলের গোরের  মালা।তাম্বুল রাগে
রাংগানো ঠোঁট জোড়া ।যুবকের নাম বদরী প্রসাদ ।
জমিদার পুত্র ।
বাইরে দালানে বদরীর পা পড়তেই খিদমতকারিরা
ছুটে এসেছে ।
------আইয়ে হজুর ।আরাম সে আইয়ে।আর একজন বলেছে ।--------কোঠী মে  আপকা
স্বোয়াগত  হ্যয় ।কিস কা ঘর মে আপ্ জায়েংগে?

প্রথম জন বলল-----আরে রূকনা।ছোটে হজুর
যে সে ঘরে যাবে না ।নয়ী চিড়িয়া এসেছে হজুর ।
একেবারে কচি মাংস ।
বাইশের জমিদার পুত্র থমকে গেছেন ঐ কচি
কথাটা শুনে ।একি পাঁঠা?একটা মেয়ের এমন
দুর্দশা?
সদ্য বিদেশ থেকে পড়াশুনা করে এসেছেন ছোটে
হজুর ।বড়ে হজুরের নারী লোলুপতার কথা কে না
জানে এ তল্লাটে ।তবে আর যেই জানুন ছোট হজুর
জানতো না সে কথা ।না জানলে ও মায়ের চোখের
জলের কারণ যে নারী ঘটিত তা আঁচ করেছিল
বিদেশ যাওয়ার আগে ।
বড়ে হজুরের  প্রচুরা টাকা  । সে টাকার বেশির ভাগ তিনি সুরা আর নারীতে ব্যয় করতেন।ছেলে যাতে বাবার মতো না হয় তাই মা হজুরাইনের অর্থাৎ বড়ে হজুরের স্ত্রীর ইচ্ছায় পুত্রকে বিদেশে পাঠানো হয় ।সুদীর্ঘ পাঁচ বছর পর জমিনদার উমেশ প্রসাদের ও ননীবালা চিনতে পারলেই না তাদের ছোট্ট  বদরী প্রসাদ কে।
এ কোন বদরী!সুঠাম দেহের অধিকারী এক যুবক ।
পেয়াদার সাথে উপস্থিত ।যুবক বদরী আশ্চর্য হলেন
যখন দেখলেন বড়ে হজুর তাঁকে বুকে টেনে নিলেন ।
বললেন-----খুশ রহো ।
পাঁচ টা বছর মায়ের কাছে না থেকে এখন
মায়ের আদরটা সহ্য করতে পারছে না বদরী ।
বদরীর বাবার আদর টা অন্য রকম ।হাতে এক
গুচ্ছের টাকা দিয়ে বলবেন----যাও
-মজে মে রহো ।
-মজাটা যে কি তা  অনুমান করা গেল এই 'কোঠী '
-বাড়ি তে আসার পর ।বড়ে হজুর আখতার কে
-বুঝিয়ে দিলেন ঈষাড়ায় ।তা তখন না বুঝলেও
-এখন বুঝতে পারছে বদরী প্রসাদ ।ভাবনা টা
-ছুটে গেল আখতার এর কথায় ।"চলিয়ে ছোটে হজুর নয়ী চিড়িয়াকা ঘর মে।"
-চিড়িয়া কথা টা শুনে রাগ হলেও কিছু বললো না
-বদরী ।বদরীর ধারে কাছের বয়স হবে আখতারের।
-নারী লোলুপ বলেই দাঁত বার করে হাসছে ।মুখে
-কিছু না বললে নয়,তাই বদরী জেদ করে ই বললো
------তু মেরা সাথ নহি আনা।নয়া লড়কির ঘরে
হামি যাবে ।
-------জী হজুর ।হমে কুছ-----।
আখতার ইচ্ছে করে ই কথা টা শেষ করলো না ।বদরী এক মুঠো টাকা আখতারের হাতে তুলে দিলো।

ছিমছাম ঘর।দেওয়ালে ছবি ঝুলছে মালা গলায়
রবিঠাকুরের ।মনে হচ্ছে না এটা প্রস্ কোয়ার্টার ।
ঘরের দেয়ালের তাকে অনেক বই।বদরীর প্রথম
এই জায়গায় আগমন ।বাঈজীর ঘর মানেই জলসার
জন্য একেবারে  তৈরী ঘর বলে ভেবেছিল ।
সংগের লোকটি একটা হাঁক দিলো ----বাঈজী সাহেবা!তোমার ঘরে ছোট হজুর এসেছেন ।

সংগে সংগে পাশের ঘরের দরজা খুলে গেল ।একটি
মেয়ে উঁকি দিলো।বছর পনেরো হবে বয়স ।পড়নে
স্কার্ট ব্লাউজ ।দুটো বিনুনি পিঠের উপরে ।ভাবতে
পারে না বদরী ।এমন মেয়ে কোঠী বাড়িতে থাকে!
এ তো ভদ্র বাড়ির মেয়ে মনে হচ্ছে ।
লোকটি বলল---হজুর আপ্ ঘর মে যাইয়ে।

মেয়েটি বলল----বসুন।একেবারে খাঁটি বাংলা ভাষায় ।বদরী প্রসাদ মেয়েটির নির্দেশিত সোফায় বসে পড়লো।একেবারে কাঁচা বয়স মেয়েটির ।
বদরী প্রসাদ বললো------তোমার নাম?
সেই মেয়ে উত্তরে বললো----ললিতা ।
সেই নামেই ডুবে গেছে বদরী ।নজর কাড়া সেই
মেয়ে ।বদরীর প্রথম এমন মেয়ে দর্শন ।বারেবারে
চোখ চলে যাচ্ছে সেই মেয়ের দিকে আবার নজর
ফিরছে ।কানে এলো মিষ্টি গলা।
-------এখানে কি আপনি প্রথম  এসেছেন?
বদরী ফিরে তাকালো তার দিকে ।
বললো----হ্যাঁ ।এই প্রথম ।
ললিতা বললো----আবার আসবেন ।এখানে আমার
ভালো লাগে না ।
চমকে উঠলো বদরী ।তবে কি এই মেয়ে স্বইচ্ছায়
এখানে আসেনি?সেই মেয়ের চোখে জলের আভাস।
চমকে উঠলো বদরী প্রসাদ ।না একে এখান থেকে
বার করতে হবে ।আবার আসার কথা দিয়ে উঠে
এসেছে বদরী প্রসাদ ।
****************
বেশ কয়েক দিন যেতে আখতারের ওপর রাগটা
কমেছে বদরীর ।কারণ মন টেনেছে ললিতা ।আর
ললিতার কাছে যেতে আখতার কে চাই ।
সকাল থেকে ই ঠিক করে নিয়েছে বদরী বিকেলে
আজ যাবেই যাবে ললিতার ঘরে ।সেদিন ললিতার
ঘর থেকে ফেরার পর মায়ের জেরার মুখে পড়তে
হয়েছে বদরী প্রসাদকে।মায়ের চোখে সন্দেহের বিষ
ঢুকে গিয়েছিল বদরীর হাতে বেল ফুলের গোরের মালা আর রাংগানো ঠোঁট জোড়া দেখে ।বাণ ছুটেছে
আখতারের দিকে ।
-------আখতার তু মেরি ঘরমে মৎ আয়া কর।আমার
ছেলেটাকে তুই কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস তা আমি জানি ।লেকিন এটাই শেষ ।আমার বাড়িতে আর আসবি না ।
বদরী প্রসাদ চেয়ে ছিল ওর মায়ের অপমানিত
মুখ খানার দিকে ।কতো শত অপমান ঐ বুকের
মাঝে জমাট বেঁধে আছে ।স্বামীর কোঠী বাড়ি যাওয়া
অপমান নয়?কিন্তু ছেলেকে তিনি সেখানে যেতে
দিতে নারাজ ।তাই রূখে দাঁড়ালেন ।

সেদিন বদরী মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল আর
কোঠী বাড়ি যাবে না ।কিন্তু তা হলো না।ললিতা ওকে
টানছে ।যেতে ই হবে বদরীকে।অমন একটা ভদ্রবাড়ির মেয়ে ফাঁদে পড়েছে  কোঠী বাড়ি তে ।
**************
আজ আর বেল ফুলের গোরের মালার দরকার নেই ।
ললিতার  সাথে বদরীর দেখা হয়েছে দুবার ।এরই
মধ্যে বদরী বুঝে নিয়েছে ললিতা কি ধরনের মেয়ে ।
যৌনতার ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি নিজেদের ।
শুধু ই গল্প ।কখনো ট্যাগোর, কখনো সেক্সপিয়র ।
মিলনান্ত না বিয়োগান্ত?কার কোনটা ভালো লেগেছে। "মার্চেন্ট অফ্ ভেনিস"ট্রায়াল সিন এর
কার  কত লাইন মনে আছে ।ললিতার ইংরেজিতে
এতো জ্ঞান দেখে বদরী আশ্চর্য হয়েছে ।জিজ্ঞাসা
করেছে ললিতাকে, কোথায় পড়তে তুমি?
ললিতা উত্তরে বললো, ----শান্তিনিকেতন ।সেখান
থেকে দিল্লি ফেরার পথে এক মহিলার সাথে আলাপ
হয়।তিনি আমাকে এখানে নিয়ে আসে ।
বদরী বলে----তুমি চলে এলে?
ললিতা বললো------ঘুমিয়ে ছিলাম ট্রেন এ।জানতে ও পারিনি।কিভাবে এখানে এসেছি।ঘুম থেকে উঠে
দেখি এখানে শুয়ে আছি।আমি হস্টেল এ নেই ।
আমার কাছে বসে আছে মুন্নি বাঈ।
বদরী বললো---কে সে?

ললিতা বললো---এখানকার জমিন দার উমেশ প্রসাদের রক্ষিতা।সবাই বলে বড়ে হুজরাইন।তুমি
বসো।আমি আসছি ।
ললিতা ভেতরে ঢুকে গেছে ।বদরী ভাবে, বড়ে হুজরাইন।মানে বাবার রক্ষিতা ।এই অপমান মা
সহ্য করতে পারেনি ।তাই তিনি চাননি বদরী এখানে
আসুক ।বাবার  মুখের  বলা কথা টা  মনে পড়ে যায় ,
"মজে মে রহো ।"
এই মুন্নি বাঈকে তার একবার দেখার সাধ ও নেই ।
যার জন্য মায়ের অপমানের জ্বালা সইতে হয়েছে ।
তাকে বদরী ও সহ্য করবে না ।

ললিতা ঘরে ঢুকতেই বদরী চমকে তাকালো।এ কাকে
দেখছে বদরী!এ কে!ললিতা!একটু আগের সাজ
বদল হয়েছে ।তখন ছিল স্কার্ট ব্লাউজ ।এখন পড়নে
শাড়ি ।এক ভাবে চেয়ে আছে বদরী ।মুগ্ধ সে।টকটকে গায়ের রং, তায় লাবণ্য বতী শাড়ি পড়ায়
বালিকাসুলভ ভাব টা নেই ।লজ্জাবতী নারী
এসে দাঁড়িয়েছে।
যুবক বদরীর কি সংযমের  বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে?তবে
সংযমের   কি  কোন দরকার আছে?না।একজন
সদ্য নারীত্ব প্রাপ্তা ।আরেক জন পূর্ণ বয়স্ক হওয়া
সত্তেও যৌবনাধর্মের তাগিদ অনুভব করেনি
ললিতাকে দেখে ।ভালো লেগেছে ললিতাকে ।
ওকে ভালো না লেগে পারে?তবে বাবার মতো হতে
পারবে না বদরী ।

কি ভাবছো?----বললো ললিতা ।
বদরী -----তোমার কথা ।ভাবছি তোমায় অন্য
জগতে নিয়ে যাবো।
ললিতা----পারবে না ।বড়ে হজুরই আমাকে এখানে
রেখেছেন ।আমায় নিয়ে যাবে জানলে তোমাকে খুন
করে ফেলবেন ।আমার বাবা সেই চেষ্টা করেছিল  ।
তাঁকেে মেরে ফেলা হয়েছে ।
বদরী-----তোমার বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে?
ললিতা------তোমাকে ও মেরে ফেলবে ।
বদরী-----না,আমায়  মারবেনা ।
ললিতা------বড়ে হজুরের ক্ষমতা কতো তা তুমি
জানো না।
বদরী-----জানি, তবে নিজের ছেলে কে খুন
করবে না ।
ললিতা------তুমি তার ছেলে,?
বদরী-----,--------- হ্যাঁ ।একমাত্র সন্তান ।এখন
বুঝতে পারছি মা কেন আমায় বিদেশে পাঠিয়ে ছিল  ।ললিতা আমি তোমায় এখান থেকে উদ্ধার করবো ।

ললিতা কোন কথা বলেনি।ভয়ের ছায়া ওর চোখে
মুখে।এতো ভয়ের কি আছে বদরী জানেনা ।বাবা
তো অন্যায় করেছে ।একটা মেয়ে কে এখানে তুলে
এনেছে।
ললিতা----ছোটে হজুর তুমি এবার যাও।এখন
ওস্তাদ জী আসবেন।তালিম নিতে  হবে।
বদরী বললো-------না।তুমি তালিম নেবে না ।তুমি
ঘুংগুরূ  বাধবে না  ।

ললিতার অনুরোধে উঠে আসতে হয়েছে তখনকার
মতো ।তবে মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে ললিতাকে
উদ্ধার করতেই হবে ।তবে ললিতা চায় না বদরী এতে
জড়িয়ে পড়ুক ।
ভাবতে ভাবতেই টাংগায় উঠেছে বদরী ।আর ঠিক
তখনই নজরে পড়েছে আখতার কে।দূর থেকে বদরীকে লক্ষ্য করছিলো আখতার ।বদরীর সে
দিকে নজর পড়ায় আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছে
আখতার ।কারণ টা কি হতে পারে ভাবতে ভাবতে
ঘরে ফিরেছে বদরী প্রসাদ ।
ঘরে ফিরে ও বার বার মনে হয়েছে কথাটা ।আখতার
কেন লুকালো নিজেকে?কিসের ভয় আখতারের ।
তবে কি আখতার বদরী কে অনুসরণ করছিল ?
কিন্তু  কেন?
********************

রাত প্রায় বারো টা।চোখ বুজে ও ঘুমাতে পারে না
বদরী ।বৈঠক খানায় মজলিস বসেছে ।সাত সুরের সাথে তানপুরা,সিতার,বাঁশি, মৃদংগ তান ধরেছে ।বাঁশি কথা বলছে ।একথা আনন্দের হলে ও বদরী
আর ওর মা কে আনন্দ দিতে পারে না ।মাঝে মাঝে
'কেয়া বাৎ কেয়া বাৎ' তারিফের শব্দ ভেসে আসছে ।

বিছানা যেন কন্টক শয্যা।লাফিয়ে উঠে বসেছে
বদরী ।কচি মিঠে নারী কন্ঠের সুর ছড়িয়ে পড়েছে
বদরী প্রসাদের ঘরে ।"ছতিয়া  মোর থরথর করে,
যো  যো বুন্দ পড়ে জিয়া লরজে।"

সত্যি' ছাতিয়া 'থরথর  করছে বদরীর ।এ গলা
ললিতার না হয়ে যায় না ।জলসা ঘরের দিকে এগিয়ে
গেল বদরী ।ভেলভেটের ফরাশ পাতা ।তাতে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে আছেন বড়ে হজুর ।
আর খিদমতকারিরা মদিরা এগিয়ে দিচ্ছে ।
ফরাশের অপর প্রান্তে বসে আছেন বর্ষীয়সী এক
সুন্দরী মএই বুঝি  সেই  মুন্নি বাঈ ।তারই পাশে কমল কলির মতো ললিতা ।আজ তার জমকালো সাজ।সারা অংগে গহনার ঝিলিক ।

দরজার পর্দায় আঁকা লাল গোলাপের তোড়া ।তারই
পাশেরএক চিলতে ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে জলশা
ঘরের এক ধোঁয়াশা চিত্র ।বড়ে হজুর মুন্নি বাঈএর
কাঁধে হেলান দিয়ে বসে আছেন ।তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ লাবণ্য বতী ললিতার দিকে ।বদরীর সে নজর ভালো
লাগে না ।তাই কথা না বলে ভেতরে ঢুকে গেছে বদরী ।চমকে ওঠে ললিতা ।তার নজর অনুসরণ করে ই
বড়ে হজুর বদরীর দিকে ।
ভেতরের রাগ দমন করে উমেশ প্রসাদ বললেন-----
-----এ কী!তুমি এখানে?
বদরী-----গান শুনতে পেলাম ।ভালো লাগল ।তাই
চলে এলাম ।গুস্তাকি মাফ্ হজুর ।আমি ভি
সংগীতের সৌকিন ।
উমেশ প্রসাদ বসতে বললেন ।তারপর বললেন---
মুন্নি বাঈ,শুরু করো।
আখতার কে ঈষাড়ায় সূরা দিতে বললেন ।বদরীর
কাছে সুরাপাত্র চলে এলো।কোন দিন বদরী যা
করেনি আজ তাই করলো ।একের পর এক মদিরা
পাত্র খালি করে ফেললো ।বড়ে হজুর স্তম্ভিত ।
এমন টা তো হবার নয়।তাঁর পুত্র কিনা মদে মাতাল। ।
ছিঃছিঃ ।সুর ভাজছে বদরী ।তাও আবার বাঈএর
সাথে ।"ক্যায়সে কহুঁ মোরি ,আলীকে বঁতিয়া
পিয়া বিনা জিয়া মোরা কছু না সুঝাবে ।"

উমেশ প্রসাদের ধৈর্য্য চ্যুতি ঘটলো, ----এবার তুমি
ভেতরে যাও।অন্য সময় বদরীর গানের দখল দেখে
খুশি হতেন হয়তো বা।এখন তা হলো না।
বদরী লাল চোখে উমেশ প্রসাদের দিকে তাকালো।
তারপর ললিতার দিকে ফিরে বলে, বাঈ সাহেবা!
ছোটে হজুর কি গুস্তাকি মাফ্ কিজিয়েগা।খুব
রুপাইয়া কামাও।মজে মে রহো ।খুশ---
পরের কথা শেষ হওয়ার আগেই বড়ে হজুর হুংকার
দিলেন-----আখতার ।ইসে ইহাঁসে লে যাও।

জলসাঘরের সমস্ত বাজনা স্তব্ধ হয়ে গেল ।বদরী
উঠে গেল ললিতার  কাছে ।ললিতার হাত ধরে
টানতে লাগল ।-----চলো, এখান থেকে ।তুমি
কোঠীতে থাকবে না ।আমার সাথে থাকবে তুমি ।
*************************
বদরী চোখ মেলে দেখলো, মা পাশে বসে আছে ।
নজর গেল মায়ের দিকে ।মায়ের চোখে জল।
-------কতো দিন আমি শুয়ে আছি মা হজুর?মৎ রো
মা হজুর।
-------মা হজুর না,মা বোল বেটা ।
-----আমার কি হয়েছে মা?
--------উমেশ প্রসাদ তোকে বাঈ মহলে মারলো ।
আমি ওকে ছেড়ে দিলাম ।আমার বাপের জমিদারি
লেঠেল দিয়ে ওকে মারবো ।ওকে আমি ছাড়ব না।
-----না মা তুমি ফিরে যাও।
-----না,ওর সাথে আর থাকবো না ।

হিংসায় হিংসা আনে।ননীবালার ভাইদের শত্রুতার
শাণ বাড়তে লাগল ।বদরী মাকে বলল, বড়ে হজুরের
কাছে ফিরে যাও মা।
-----তা হবে না বেটা।মুন্নি বাইকে ঘরে এনেছে তোর
বাপ।সংগে আছে আরো একটি মেয়ে ।
------কে ,ললিতা?
-----তুই ওকে চিনিস?
ললিতার সব কথাই বলতে হয়েছে মাকে ।ঘৃণায় মুখ
ঘুরিয়ে নিয়েছেন ননীবালা ।এমন স্বামীর সংসর্গ করে
এসেছেন এতোদিন ।ভাবতে পারেন না তিনি ।
বদরীর মনের ভাবটা বুঝতে তাঁর বাকি থাকেনা ।
তাই বলেন----তুই ওকে নিয়ে আয়।আমি ওর সাথে
তোর বিয়ে দেব।
****************
মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী বদরী প্রসাদ রওনা দিলো বদরী প্রসাদ সাথে লেঠেল সর্দার শিউনন্দন ।অমন
মাসল্ ধারি শিউনন্দন থাকা সত্তেও ভয় পাচ্ছিলো
বদরী প্রসাদ ।ভয়টা নিজেকে নিয়ে যতো টা না তার চেয়ে বেশি ললিতা আর মাকে নিয়ে ।কারণ টা হলো
উমেশ প্রসাদ।
জমিদার উমেশ প্রসাদকে যেমন অনেকে ভয় পেতো ।তেমন তাঁর শত্রু ও ছিল অনেক ।সেই শত্রুদের
পাঠিয়েছেন  মা হজুরাইন।মুন্নি বাই,ললিতা ওরা
কোথায় আছে তাও জানিয়েছে।সে সবের আঁটঘাট
জানা আছে শিউনন্দনের ।
***************
দূর থেকে দেখা খাস মহলের আলো দেখা যাচ্ছে ।
ঝাড়বাতি নিভে গেছে ।কথা অনুযায়ী নীরেন্দ্র গোয়ালার বাড়ি যেতে হবে ।ওখানে ই খবর আসবে
ললিতার ।সে খাসমহলে না জলসা ঘরে।সেই খবরের
ওপরে নির্ভর করছে সব কিছু।কোমরের খাঁজে গোঁজা আছে  ছোট্ট ধারালো অস্ত্র ।ছোটে হজুর
একাই আসতে চেয়েছিল ।তাই অন্যান্য লেঠেলরা
লুকিয়ে আছে ।যাতে দরকারে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।
বদরী প্রসাদ কান খাড়া হয়ে আছে ।কোথা থেকে কি
হয় তা শোনার জন্য ।

নীরেন্দ্র গোয়ালার ঘরে ঠাঁই হয়েছে ।ঘরটাকে যথাসম্ভব ঘষামাজা করা হয়েছে ।কারণ ছোটে
হজুর থাকবেন সে ঘরে ।
হঠাৎ দেখা গেল একটা লোক ছুটতে ছুটতে আসছে ।শিউনন্দন বলল-----ছোটে হজুর,আপ ইহাঁ রূকিয়ে।ম্যায়ঁ আ রহা হু।
সে কথা বলে ই বাইরের দিকে ছুটলো শিউনন্দন ।
চার দিকে বিষম চিৎকার ।মশাল হাতে অগনিত
লোক ছোটা ছুটি করছে ।বদরী ঘরে অপেক্ষমান ।
এরা কারা?শিউনন্দনের কি এতো লোক আছে?
দুটো আলাদা দল হৈ হৈ  রৈরৈ করে ছুটোছুটি করছে।
এই ঘরে ও থাকতে পারবে না বদরী ।কারণ ঘরে
আগুন লাগিয়ে দিয়েছে ।ছুটে বের হতে যাবে বদরী ।কিন্তু তার আগেই দেখলো মাসল ধারি কয়েক  জন   ওঁকে বেঁধে ফেললো ।তারপর জ্ঞান হারালো বদরী প্রসাদ ।
*************
সুসজ্জিত কক্ষে শায়িত বদরী প্রসাদ ।এ ঘর তাঁর
সম্পূর্ণ অচেনা ।পরিচারিকা পর্দা সড়িয়ে ঘরের ভেতরে এলো ।তার হাতে একখানা বারকোষ ।তাতে
রকমারি ফল।বিছানার পাশে রেখে বললো-----
হজুর  ,ফলগুলো খান ।আপনার  শরীর দুর্বল ।তায়
আপনার আজ বিবাহ ।
---------আমি এখানে কতো দিন আছি ? কোথায়
আছি আমি?
-----এটা বারানসী ।বেশ কিছুদিন এখানে আছেন।

বদরী অনেক কথাই বললো ।তার সার কথা হলো
এই যে,বদরীর আজ এখানকার এক জমিদার কন্যার সাথে বিয়ে ।
আজ বিয়ে!ললিতার কি হলো!ওরা কি ললিতা কে
মেরে ফেলেছে?না না তা করবে না ।মা হজুরাইন  ঠিক আছে তো?কি ভাবে পালানো যায় এখান থেকে? ভাবতে ভাবতে মেয়েটিকে বললো-----
----তুমি জানো বড়ে হজুর কোথায় আছে?
------না।তবে আজ সন্ধ্যা বেলায় তিনি আসবেন ।
-----তুমি  আমাকে সাহায্য করতে পারো?আমি
এখান থেকে পালাতে চাই।একটি মেয়ে খুব বিপদে
আছে ।তাকে বাঁচাতে হবে ।
-----কেন?কে সে?
-----'আমি তাকে ভালোবাসি ।তাঁকে বড়ে হজুর
বিয়ে করতে চায় ।আমার বাবা তাকে কোঠী বাড়ি তে
আটকে রেখেছে ।
------কিন্তু কি করে?
------তুমি চাও না আমি তাকে উদ্ধার করি?
******************

বদরী বারাণসী থেকে পালিয়ে গেল সে রাতেই।সেই
মেয়ের সাহায্যেই।দুজনে ই সেখান থেকে পালিয়ে গেল ।কারণ মেয়েটি না পালালে তাঁর ও মরণ ছিল
বড়ো হজুরের হাতে ।
বদরী বলেছিল মেয়ে টিকে তার সাথে আসতে ।কিন্তু
সেই মেয়ে ওর কথায় রাজি হয় নি ।
বদরী  কোঠী বাড়ি তে পৌঁছে দেখলো আখতার সেখানে পাহারা দিচ্ছে ।
বদরী প্রসাদ আখতারের হাত চেপে ধরে বললো-----আখতার ললিতা কো মেরা পাস দে দো।আখতার বললো-----ম্যাঁয় তো উসি কব্ কা ছোড় দিয়া ।চল্।অব হম্ আভি ভাগে  ।নহি তো হজুর হমে
মার ডালে গা।
------লেকিন ললিতা কাঁহা গয়ি?
---------মিল যায়গা ।অব চল।

বাইরের  থেকে গাড়ি এসে দাঁড়ায় ।উমেশ প্রসাদ
নেমে দাঁড়ায় ।হতচকিত আখতার ।বদরী র  হাত
ধরে টানতে থাকে ।উমেশ প্রসাদ পকেট থেকে
রিভলভার বার করেন।নিশানায় আখতার ।বদরী
এক মূহুর্তের জন্যও অপেক্ষা করে না ।কোমরের খাঁজের থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বার করে গুলি করে উমেশ প্রসাদকে ।

আখতার একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে বদরীর হাত
ধরে ছুটতে শুরু   করলো ।বদরী পিছু ফিরতে পারে না আখতারের টানে।
আখতার আর বদরী প্রসাদ যখন মা হজুরাইনের
কাছে পৌঁছালো তখন চারদিকে পুলিশ খুনি কে
খুঁজে বেড়াচ্ছে ।বড়ে হজুরাইন আখতার কে বললেন
---------উসে সামাল কে রখ্না।ভাগ ইহাঁ সে ।ম্যায়
সামহাল লুংগী ।

খুনের দায় নিয়ে নিয়েছেন বড়ে হজুরাইন ।আখতার
কোলকাতার আহিরীটোলায় নিয়ে রেখেছে বদরীকে।
বড়ে হজুরাইন সমস্ত জমি জমা বিক্রি করার বন্দোবস্ত করে দেন।
আখতার আর বদরী ভালো উকিল লাগালো বড়ে
হজুরাইন কে বাঁচাতে ।শেষ অবধি দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে বড়ে হজুরাইনকে।চার বছরের জেল হয়ে
গেল ।বদরীর ভালো  লাগে না ।কুঁড়ে কুঁড়ে খায় বদরীর মনটা ।বাবা কে খুন করলো সে।অথচ তার
দায় নিলো মা ।যে মা তাঁর স্বামীর কাছে কোনো
সম্মান পায়নি ।আরও বড়ো উকিল ধরবে ।মাকে
কষ্টে  দেখতে পারবে না ।বছর ও ঘুরলো না।বদরীর
মা হজুরাইন কে জামিন এ ছাড়িয়ে আনা হলো ।

বদরীর মন ভালো নেই ।কোথায় গেল ললিতা?বদরী
খুঁজে বেড়ায় ললিতাকে ।তার  আজকাল বাঈ মহলে
যাতায়াত বেড়েছে।উদ্দেশ্য একটাই ।ললিতা কে খুঁজে বার করা ।মা হজুরাইন অনেক বলেছে বিয়ে
করতে ।কিন্তু সে রাজি হয়নি ।
আখতার বিয়ে করে সংসার পেতেছে ।ফুটফুটে
একটা মেয়ে হয়েছে ।স্কুলে ভর্তি র সময় বদরী প্রসাদের নাম রয়েছে অভিভাবকের জায়গায় ।
ছোট্ট গুড়িয়া মাতিয়ে রাখে বদরী আর বদরীর  মাকে।

গুড়িয়া র স্কুলে গার্ডিয়ান আর টিচার্স মিটিং।
সেদিন সকালে বদরী প্রসাদ গুড়িয়া কে নিয়ে
যথা সময়ে পৌঁছালো ।ক্লাস টিচার ডেকে পাঠালেন
বদরী প্রসাদ কে।রুম এ ঢুকে বদরী প্রসাদ থমকে গেল ।এ কাকে দেখছে!একেই তো এতোদিন ধরে
খুঁজে বেড়াচ্ছে ।
--------বসুন।
এতক্ষণে ধাতস্থ  হলো বদরী ।চেয়ারে বসে পড়লো।
মুখে কোন ও কথা নেই ।সমাজের কোন স্তরে ললিতা কে  খুঁজে বেড়িয়েছেন ।আর আজ ললিতা  কোথায়
পৌঁছাতে পেরেছে ।কোন পংকিল আবর্তে পৌঁছেছিল ।সেখান থেকে নিজেকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছে ।বুকটা
হালকা হলেও নিজেকে খুব ছোট মনে  হয়েছে ।আজ
আর সেক্সপিয়র এর ট্রায়াল সীন্
এর গল্প করা যায় না। সব কথা শেষ  হয়ে গেছে বদরীপ্রসাদের ।
ফিরে আসার  সময়  ললিতা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ।
হাত মেলানোর জন্য ।নমস্কার জানিয়ে ফিরে এসেছে
বদরী প্রসাদ ।আজও ভোলেনি সেদিনের কথা ।
মনটা হু হু করে উঠছে ।কিসের কষ্ট বদরীর?
বদরী তো ওকে ভালো জায়গায় নিয়ে আসতে
চেয়েছিল ।বাবার কাছ থেকে সরাতে চেয়েছিল ।নাকি ওকে ভালোবেসে ফেলেছিল!সে সব কথা
ভুলতে ই চায় বদরী ।
**********
ঘরে ঢুকে কলকল শব্দে বুকে রক্ত ছল ছলাৎ করে
উঠলো ।এ কাকে  দেখছে সে?ললিতা  বড়ে হজুরাইনের  সংগে গল্পে উচ্ছসিত ।বড়ে হজুরাইন
বললেন-------দেখ,আখতার কাকে এনেছে ।আমার
বেটার মন পসন্দ ।ললিতা আমার  বেটা কে সাদী
করবি তো?
ললিতা বললো--------তোমার বেটাকে জিজ্ঞাসা করো।
বলে চোখে আঁচল দিয়ে  হাসতে লাগল ।

------------------------***************--------------------