বাংলা কবিতার 'ডিজিটাল ছন্দ- পাঠ/১
মোহাম্মাদ রোকনুজ্জামান, মে ১২, ২০২০
যে কোনো ভাষার কবিতার ছন্দ-সম্পদে মূলত ডিজিটাল পদ্ধতি প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত।--- মাত্রা গণনার হিসেব বা তার গাণিতিক প্রয়োগ প্রেক্ষণের মধ্য দিয়েই ছন্দের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট । ছন্দ বড় বড় নখের সখের মত অতিরিক্ত কিছু নয়;-- ছন্দ কবিতার অন্তরগত এবং প্রধান প্রয়োজনীয়।একটি ভাষার কবিতার ছন্দ বিশ্লেষণ সে ভাষার উৎকৃষ্ট কাব্য আলোচনার নিরীখে নির্ণীত ও উপলব্ধি উচ্চকিত হয়। যা কবিতা নয়; তার বিচার বিশ্লেষণ যেমন চলে না--তেমনি, যা ছন্দবদ্ধ নয়; তা কবিতা হিসেবে বিবেচিত হয় না।--- বাংলা কবিতার ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। আলোচ্য বিষয় বাংলা কবিতার ছন্দ এবং বাংলা কবিতার ছন্দও মূলত ডিজিটালিক হিসেব নিকেশের মধ্য দিয়েই নির্ণীতব্য ও প্রতিভাত হবার সম্ভাবনা ।
চর্যাপদ থেকে শুরু করে সামপ্রতিক কালাব্ধি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য না-নামাত্রিক পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত ও প্রসারিত ;---কবিতা সাহিত্যের প্রধান শাখার একটি;-- সুতরাং এর পালাবদলের ধারা ও চেতনাপ্রবাহ অনায়াস চিণহিত এবং বাংলা কবিতার ছন্দের ক্ষেত্রেও সেই ক্রমবিবর্তন পরিস্ফুট কিন্তু এটা ঠিক যে, ছন্দের মাত্রা গণনার আংকিকগত হিসাব বা ডিজিটালিক প্রবাহ পদ্ধতির কোনো প্রকার পরিবর্তন লক্ষিত হয় না ।--অতএব বাংলা কবিতার ছন্দ মূলত ডিজিটাল নিয়ন্ত্রণে নিয়ন্ত্রিত ।
ডিজিট ( Digit ) বিন্যাস থেকেই ডিজিটালের উৎপত্তি;-- Digital is a derived tern of digit ) যা কিছু অংক বা ডিজিট বা সংখ্যা দিয়ে হিসেবের প্রয়োজন হয় তাই ডিজিটাল নয় কি ? ডিজিট থেকে ডিজিটাল;---ডিজিটাল থেকে ডিজিট নয়।
দ্বিতিয়ত আমরা জানি, ডিজিট দুরকম;-- অড ও ইভেন। এখনে বাংলা সংখ্যা উচ্চারণের কথা বলছি না-- ইংরেজি ডিজিটের প্রসঙ্গ উপস্থাপন করা হচ্ছে-- মূলত বিশ্লেষণ পর্যালোচনা শেষে ইংরেজি অড আর ইভেন নম্বরের পৃথকি করণ ও তার সারিবদ্ধ উচ্চারণ ঝোকের সাথে বাংলা কবিতার ছন্দ-ধ্বনির,পর্ব ধ্বনির উচ্চারণ ঝোকের সমিল পরিচয় স্পষ্ট হবে এবং অনায়াসে উপল্বদ্ধি হবার সম্ভাবনা ।
আমি জানি,বাংলা কবিতার ছন্দ সম্পর্কে যারা পরিচিত আছেন, কবিতা রচনায় ব্যবহার করছেন,বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন, আপনাদের নিকট প্রস্তাবিত
প্রসঙ্গ আপাতদৃষ্টে বিস্ময়কর ও বিপ্রতিম মনে হচ্ছে । প্রসঙ্গত এটাও সত্য যে, ছন্দ বিষয়ে কোনো প্রকার ধারণা বা পরিচয় ছাড়াও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স -মাস্টার্স- পি,এইস ডি ক্লাস পাস করা যায়,---সেখানে সিলেবাস অন্তর্ভুক্ত পাঠিতব্য বিভাগ পছন্দ বা না পছব্দের বিষয় নিহিত। আমি এটাও দেখেছি যে,কলেজ বিশ্বিবিদ্যা লয়ের সিংহ ভাগ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষকগণও বাংলা কবিতার ছন্দ বিষয়ে অবিদিত অথবা অর্ধ-বিদিত,--কারণ সব শিক্ষকগ্ণকেই তো আর ছন্দ বিষয়ে পাঠদানে অংশ নিতে হয় না;--প্রসঙ্গত বলবার কথা এই যে---
মূলত একটি ভাষার সচেতন কবিগোষ্ঠীই সে ভাষার কবিতার ছন্দের যথার্থ ধারক বাহক । বিশ্ববিদ্যালয় বা ভাষা-একাডেমী নয়---
কারণ কবিগ্ণ প্রতিনিয়ত ছন্দ ব্যবহার করে চলেছেন এবং তাঁরই আপন আপন ভঙ্গি বা ঢং-ঢৌল বা স্টাইল সৃষ্টি করে চলেছেন । বাংলা কবিতার ছন্দ ও কবিগোষ্ঠির ক্ষেত্রেও এ কথা স্বীকার্য ।
প্রসঙ্গত বলে রাখি ,
,'কানই ছন্দের হাকিম'--
কথাটি কার বা কবে কোন গ্রন্থে মূদ্রিত হয়েছে আমার সঠিক স্মরণে নেই;-- হাতের কাছে বাংলা ছন্দের ্কোনো বইও নেই যে সেখান থেকে তা উদ্ধার করব।--খুব সম্ভব বিশ্বভারতী্র ভূতপূর্ব অধ্যাপ , ছন্দ বিশারদ শ্রী প্রবোধচন্দ্র সেন রচিত ছন্দ গ্রন্থে পড়েছিলাম;- বহুদিন,বহু বছর ধরে কো্নো ছান্দসিকই উল্লিখিত উক্তিটির কোনো প্রকার বিরুদ্ধচারণ করেন-নি বা তলিয়ে দেখেন-নি;---কিন্তু আমি স্বীকার করি না-- বা মেনে নিতে পারি না;--কারণ কবিতার ছন্দ ভুল বা-না ভুলের বিচারক কান নয়; মাত্রাই তার প্রধান হাকিম। এবং্মাত্রা-ধ্বনির যথাযথ প্রয়োগ ব্যবহারের পদ্ধতি-প্রক্রিয়া পূর্ণমাত্রাই ডিজিটালিক বা অংকগত হিসাব-নিকাশ।-- যার নির্ভুল প্রয়োগের মধ্যদিয়েই কবিতা বা ছড়ার ছন্দ পতন রক্ষিত হয়,--মাত্রা গণনা বিষয়টি সম্পর্কে অভিহিত না থাকার কারণে;,-- তার প্রয়োগ- প্রেক্ষণ সঠিক ভাবে না হবার জন্যেই পংক্তি-- কবিতার পংক্তি হয়ে ওঠে না--,ছন্দ পতন অনিবার্য হয় ।
আমার বিশ্বাস বহুল প্রচারিত ও মেনে নেয়া প্রস্তাবিত উক্তিটি র লেখক হয়-তো কবির প্রাতিস্বিক বা স্বকীয় ছন্দ ভঙ্গি বা স্টাইলের ধ্বনিব্যাঞ্জনা বুঝাতে গিয়ে বিষয়টি গুলিয়ে ফেলেছেন;--- ছন্দ আলোচনার ফাকে ফাঁকে, ধাপে ধাপে যা আরও অনায়াস চিহ্নিত হবে ;-- ইংগিত স্বরূপ বলা যায় যে ,কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী 'শিরোনামা কবিতাটি এবং জসীম উদ্দীনের কবর ,নিমন্ত্রণ প্রভৃতি কবিতা মোটামুটি একই কাল প্রবাহে--একই মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা হলেও স্ব স্ব কবির ছন্দ ভঙ্গির কারণে পূর্ণ মাত্রায় পৃথক শুনাচ্ছে।--- যে-ভাবেই শুনাক না কেন ছন্দ বিশ্লেষণ পদ্ধতি কিন্তু সেই একটি -মাত্র ছন্দের অধিনে;-- সুতরাং কান কবিতার ছন্দ নির্বাচনের হাকিম নয় ।
বস্তুত আমার প্রধান লক্ষ্য উদ্দেশ্য উল্লিখিত বিষয়াদির অনুপুঙ্খ প্রমাণ বিশ্লেষণ নয় --;অতি সাম্প্রতিক বাংলাদেশের বাংলা কবিতার ছন্দ বিশ্লেষণ আলোকপাতসহ--যারা ছন্দ না জেনে কবিতা লেখার চেস্টা করছেন--অথচ কবিতা হয়ে উঠছে না;--তদের জন্যেই এই গ্রন্থ-রচনার মৌল অভীপ্সা ।
প্রথমেই বাংলা কবিতার প্রধান ছন্দ গুলির নাম জেনে নেয়া যাক ;--
১। স্বরবৃত্ত
২। মাত্রাবৃত্ত
৩। অক্ষরবৃত্ত
( এখনে জনান্তিকে বলে রাখি, বাংলা কবিতায় গদ্য ছন্দ বলে কোনো ছন্দ নেই;--তবু কেন আমরা গদ্য ছন্দ বলি, এ কোন ছন্দের অন্তরগত ,কি তার প্রকৃতিগত রূপ-বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি প্রধান ছন্দগুলি আলোচনার পর তা উল্লেখ করার প্রয়াস রইল । )
উল্লিখিত তিন শ্রেণীবদ্ধ বাংলা কবিতার ছন্দের প্রকৃগত পার্থক্য বিশেষভাবে নির্ভর করে মাত্রা-গ্ণনার রীতির উপর বা মাত্রার ডিজিটালিক বিন্যাসের উপর ;-- তাই বাংলা কবিতার ছন্দ, ডিজিটালিক ।
আলোচনার প্রারম্ভে বর্ণ-মালাঃ- অক্ষর (Syllable ) ,স্বর ধ্বনি (Vowel ) ব্যাঞ্জন ধ্বনি ( Consonant ) অক্ষর মাত্রা,যতি ,পঙক্তি , পর্ব , অপূর্ণ পর্ব প্রভৃতির পরিচয় প্রয়োজন । ( চলবে )