পীড়িত অববাহিকা

পীড়িত অববাহিকা
কবি
প্রকাশনী কাগজের ঠোঙা
প্রচ্ছদ শিল্পী রাজীব দত্ত
স্বত্ব কাগজের ঠোঙা
প্রথম প্রকাশ সেপ্টেম্বর ২০২৩
বিক্রয় মূল্য ১০০

ভূমিকা

কবি রহিত ঘোষাল : দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে
— পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়

কবি রহিত ঘোষাল শূন্য দশকের তরুণ কবিদের মধ্যে নিজস্ব স্বকীয়তার পরিচয়ে বিশেষ প্রাঞ্জল হয়ে উঠেছেন। স্কুল-জীবনের মধ্যবর্তী পর্যায় থেকেই তাঁর কবিতাচর্চা শুরু। বর্তমানে ভারত এবং বাংলাদেশ উভয় বাংলাতেই লিটল এবং ই-ম্যাগাজিনে তাঁর জনপ্রিয়তা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রথাগত ভাবধারাকে কেন্দ্র ক'রে আবহমান স্রোতের চলন রহিতের শৈল্পিক প্রকাশে সেইভাবে উঠে না এলেও এক ভিন্নতর স্বাতন্ত্র তাঁর কাব্যাদর্শের দিগবলয়টিকে উল্লেখ্য করে তুলেছে। বর্তমানে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'পীড়িত অববাহিকা' কলকাতা বইমেলায় বিশেষ সমাদৃত হয়েছে।

কবি রহিত ঘোষালের প্রথম কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত কবিতাগুলি বহুমাত্রিক অভিযাত্রায় স্ফুর্ত হয়ে উঠেছে। কবিতাগুলির মধ্যে অনেকগুলি স্তর পাঠককে সহজে উৎসুক করে তোলে। লেখাগুচ্ছের স্থানে স্থানে শব্দের দৃশ্যান্তর ও দৃশ্যের উল্লম্ফন বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। তাঁর কবিতায় কোনো পূর্বাপর প্রভাব বিশেষভাবে নেই, রয়েছে এক ভিন্নতর স্বকীয় আত্মপরিচয়। কবিতার অন্তঃস্থলে মৃদু নিরীক্ষা, অনাবিল স্রোত ভেঙে যাওয়া ... এইসব পরিচিত সুর ও সঙ্গতি পূর্বসূরী কবিদের সঙ্গে মিলে গেলেও, সহজেই পৃথক করা যায় তাঁর উদ্দিষ্ট অভিজ্ঞানটিকে।

আলোচনার শুরুতেই নির্দিষ্ট করেছি — আবহমান বাংলা কবিতার প্রথাগত রেওয়াজ এড়িয়ে এক ভিন্নতর নিরীক্ষা রহিতের স্বকীয় পরিচয়, যা এই কাব্যগ্রন্থে বিশেষভাবে সহায়ক । অধিকন্তু বিভিন্ন পাশ্চাত্য আবহ এবং বিদেশি অনুষঙ্গ থেকে প্রবাহিত নির্যাস তাঁর কবিতায় পাঠকের স্থিতি ও দৃষ্টিকে নতুন পথে আকর্ষিত করে। শব্দের আক্ষরিক বুনন আরও মেদুর ও মসৃণ হয়ে ওঠে। কোথাও যেন এক দূরবর্তী আবহাওয়া বড় নিশ্চিন্ত হয়ে পড়ে আমাদের মফস্বল-জানালার কাছে।

এক একটি কবিতা আমাদের ছায়াচ্ছন্ন বিক্ষিপ্ত জীবনযাপনের অস্থির অনুভব থেকে এক সাংগীতিক আলোর মতো জাগিয়ে অনালোকিত মানসভুবন। জীবন ও প্রকৃতির সরল ভাষ্যে কী এক বাঙ্ময় প্রবহমানতা, উদ্দীপ্ত সরল গতিপথ — সৃষ্টিকে অন্তর্মুখী করে তোলে। আমাদের বেদনা-বিষাদ, ব্যথা-বিপর্যয় সমূহ কষ্টকে দূরীভূত ক'রে যেন এক শুশ্রূষার স্পর্শ নিয়ে আসে। শিশুর সারল্যে, প্রেমিকের রক্তিম উষ্ণতায়, বন্ধুর পরম আশ্রয়ে প্রত্যেকটি কবিতাকে স্নিগ্ধ ও স্বতস্ফূর্ত করে তোলার প্রচ্ছন্ন গুণাবলী তার বাকচর্যায় নিহিত থাকে। আমার বিশ্বাস তরুণ কবি রহিত ঘোষালের কবিতায় পাঠক সেই তরঙ্গ খুঁজে পাবেন।

কবি রহিত ঘোষালের কবিতায় — মারাংবুরুর থান, আড়া রাঢ়েশ্বর মন্দির, স্বরমঙ্গলা নদী প্রভৃতি প্রান্তিক ও গ্রামীণ সভ্যতার বাইরেও ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে উঠে এসেছে বিস্মৃতপ্রায় কোয়ানঝো নগর কিংবা উসমানীয় রাজবংশের নাম। এবং বড় স্বাভাবিকভাবেই এসেছে শ্রীমঙ্গল, গুলিয়াখালি, ফুলবাড়ি, ছিটমহল, কালাচাঁদপুর, কল্যাণপুর, মানভূম প্রভৃতি স্থানের নামগুলি। এছাড়া শহরের কিছু পরিচিত জায়গা — ফিরিঙ্গি বাজার, গল্ফগ্রীন, বেইলি রোড, মতিঝিল ইত্যাদি পার ক'রে একেবারে একাডেমি থেকে আরাকান পর্যন্ত আমাদের ছুটিয়ে নিয়ে গেছেন কবি। মাঝেমধ্যেই আমাদের মনে পড়েছে তাঁর কবিতায় পাওয়া সেইসব চেনা মুখগুলো ... স্বাতী, ওয়াসিফা, সঞ্চিতা, সিদ্ধেশ্বরী, আফসানা, নবনীতা এবং লোপাদির কথা।

এই কাব্যগ্রন্থে কবি রহিতের বহু কবিতাতেই আমরা পেয়েছি সেই হারিয়ে যাওয়া গ্রামবাংলার — শাপলা, লাউমাচা, কামরাঙা, খাজা কাঁঠাল, কলাবাগান, পালং শাকের তরকারি, মরিচ গাছ প্রভৃতিকে। সেইসঙ্গে বাঁধানো পুকুরঘাট, দেশি মুরগী, খয়েরি বেড়াল, কবুতর, টিন ও কাঠের বাড়ি, কার্পাস, ঝিঁঝিঁ পোকা, বালিহাঁস, শরৎকাল, ভাপা পিঠে, কবুতর, পুবের হাওয়া, ফেরিঘাট, বনমুরগী, ধুনুচি নাচ ... এছাড়াও রুনুঝুনু নূপুর, কাঁচুলি ও চেলি, লাল শালু কাপড়, শাঁখা-পলা-নোয়া, এয়োতি নারী ... সমস্তই সেখানে ছবির মতো ফুটে উঠেছে।
সেইসঙ্গে শহরকেন্দ্রিক সভ্যতার চিহ্নস্বরূপ — কিছু ককটেল বোমা, লোহার কাঁচিগেট, ঘড়ির চাবি, কলমদানি, হাশিশের পাইপ, পাউরুটি কারখানা এবং মশার ধূপ, সাট্টার ঠেক, চুয়াচন্দন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সমস্তটাই চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

রহিত ঘোষাল তাঁর কবিতায় — রুহু, আজরাইল, আফসানা, খোয়াব, ওয়াসিফা, মসীহ, দাফন প্রভৃতি আরবি, ফারসি শব্দকে নাম এবং অর্থবাচক দিক থেকে এক নতুন ভঙ্গিতে যেভাবে ব্যবহার করেছেন তার তাৎপর্য অবশ্যই গুরুত্বপুর্ণ। সেইসঙ্গে কিছু ইংরেজি শব্দের ব্যবহার (যেমন — ইনসুলিন, এমোক্রিশিলিন, বাথটাব, সোয়েটার, হ্যালোইন, ইমেইল, নিনজা টেকনিক, ফ্ল্যাশ ইত্যাদি) বেশ সাবলীলভাবেই তিনি কবিতায় এনেছেন। এর বাইরে — কাফকা আলো, বেতাল মসীহ প্রভৃতি নতুনভাবে নির্মিত কিছু শব্দ বিশেষ প্রাঞ্জল এবং অর্থবহ হয়েছে। এছাড়া কবিতায় কিছু প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব এবং উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি ছাড়াও (যেমন — তেনজিং নোরগে, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ইমানুয়েল কান্ট, লেডি ম্যাকবেথ, ম্যাডোনা, ড্যানিয়েল) উঠে এসেছে ম্যাকাও পাখি ও জারবেরা ফুলের নাম। তৎসহ ''তেঁতুলপাতায় ন'জন" এবং "বাসর রাতে বেড়াল মারা''র মতন প্রচলিত প্রবাদকেও তিনি তাঁর কবিতায় বিশেষভাবে ব্যবহার করেছেন।

কবির তৈরি করা কিছু জোড়শব্দ পোয়েটিক ডিকশনরূপে অনবদ্যভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া 'ফিনফিনে পুবের হাওয়া' হয়ে থাকা কিছু বিশেষণ, যেমন — পাঁড় মাতাল নদী, পরবাসী শরৎকাল, অস্পৃশ্য বেদনা, নিথর ঝিঁঝিঁ, আঁধার জাগানিয়া এবং অমর্ত্যগামিনী, স্বর্গঙ্গা ইত্যাদির মতো কিছু অশ্রুত শব্দও বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি যে সকল শব্দগুচ্ছ ঈষৎ ভারবহ এবং বর্তমান বাংলা কবিতায় অচলিত, যেমন — মরুভূ, অলাতচক্র, মনশ্চক্ষু, প্রোষিতভর্তৃকা, প্রাবরণ ... সেগুলিও কবি তাঁর নান্দনিক পংক্তিতে ব্যবহার করেছেন। এছাড়া তাঁর নৃমুণ্ডমালা, শঙ্খিনী, অষ্টসখী প্রভৃতি শব্দবন্ধের ব্যবহারও বেশ আকর্ষণীয়।

কবি রহিত ঘোষালের কবিতাগুচ্ছ থেকে কয়েকটি কবিতা, যেমন — প্রাণ চায় গোস্তাকি, ভ্যাপসা অঙ্গীকার, তেরমুখ ব্রিজ থেকে বলছি, চরাচর, শেষ সত্য, আট মিনিট আগে, একটি সাক্ষাৎকার, পীড়িত অববাহিকা, এই মনমুগ্ধকর যন্ত্রণা, জারবেরা প্রভৃতি বেশ উচ্চ পর্যায়ের কবিতা। এছাড়া তাঁর লেখা — বন্য চাঁদ পাখি, বূডোআ, না ছুঁই পানির কথা, চোখ এড়ানো যায় না, কাটা লাইনের লোক, অবস্থা, অফিস ফেরত নাকি শ্মশান, আয়না মানুষ প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বইটিতে দুটি এক পংক্তির কবিতা, কয়েকটি অণুকবিতা এবং দুটি দীর্ঘ কবিতা রয়েছে। তাঁর দীর্ঘ কবিতা দুটির (ত্রৈমাসিক, একটা পাহাড়কে নিয়ে এসেছি...) স্থানে স্থানে মনোমুগ্ধকর অজস্র পংক্তি ও আশ্চর্য কিছু শব্দের চমৎকারিত্ব রয়েছে, যা আমাকে বিশেষ ভাবিয়েছে। 'ত্রৈমাসিক' কবিতাটিতে তির্যক সমাজদর্শন ও শ্লেষপ্রধান ঠিসারা অনেকাংশেই বার্তাবহ। অন্যদিকে 'একটা পাহাড়কে নিয়ে এসেছি ...' কবিতায় জাদুবাস্তবতার রঙিন আবহে একটা উত্তরাধুনিক ছাপ স্পষ্টতই আমরা পেয়েছি। সুচারু ইঙ্গিতধর্মিতা, নাটকীয় উপস্থাপনসহ রৌদ্রোজ্জ্বল প্রতীকী ব্যবহার, চোখ টেনে নেওয়ার মতো 'ফ্লাইট' অবশ্যই এক আলাদা তাৎপর্য রক্ষা করে। আলোচনার শেষ পর্যায়ে কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ না তুলে দিলে পাঠক হিসেবে অবিচার করা হবে, তাই ব্যক্তিগত বিচারে কয়েকটি লাইন দিলাম।

১. ওখানে ঘুম কাটছাঁট হবে নিম্নবিত্তের। ২. ধোঁয়া নেভেনি,/ শুধু কান্না ঢাকা হয়েছে প্লাস্টিক সার্জারি করে। ৩. আমি এখন বাড়িতে নেই, বাড়ির বাইরেও নেই, / আমার ছেঁড়া জামাটা শ্বাস নিচ্ছে, ৪. সাট্টার ঠেক থেকে লাউমাচায় গৃহস্থ বৃষ্টি নামবে নিরুত্তাপ। ৫. কিছু আয়না মানুষ আমাদের ছায়ার মতো অনুসরণ করত, / ওরা কন্ট্যাক্ট লেন্স পড়ত আর পোষাক পাল্টাত ক্ষণে ক্ষণে । ৬. জন্মদিন তুমি কবরের মাটি/ মৃত্যুদিন তুমি প্রসূতি বিভাগে চিকিৎসা করাও। ৭. যাদের হাতে সময় নেই তাদের হাঁটুতে সময় থাকে,/ জবাবদিহি একপ্রকার জ্বালানি ... ৮. খাতার কিনারে সাঁতার জিজ্ঞাসা করে/ উঠানের খাজা কাঁঠালের কথা, মরিচ গাছে ফুল এসেছে কিনা। ৯. জল বানান করতে করতে ভিজে যাই। ১০. কৃষকের জমি-গরু বেচে/ আসামিকে সান্তনা দিয়ে/ মুহুরির ধুনুচি নাচ। ১১. আলো দুই প্রকার / কাফকা আলো ও মৃত্যুর আলো।/ যতদূর অবধি জলাভূমি ভরিয়ে মাটি ফেলা হয়েছে/ ততদূরই মানুষের এঁটোকাঁটা ছড়ানো আছে। ১২. পূজারিণী দেহের ভিতর জারুল ছায়া।

কবি বইটির উৎসর্গপত্রেই আমাদের জানিয়েছেন — 'বাংলা নদী ভাঙনকেন্দ্রিক দেশ'। আবহমান বাংলা ভাষাও ঠিক সেরকম। ভাষা-সংস্কৃতির অববাহিকাও তাই পীড়িত। এই অবস্থা এবং অবস্থান উভয়কেই মনে রেখে প্রচলিত যন্ত্রশক্তির বাইরে মানুষের যে স্ফূর্ত সক্রিয়তা, তা অতি আবশ্যক একটি বিষয়। এই ভাবনাকে সঙ্গত মনে করেই একটি কবিতার লাইনে কবি লিখেছেন — "পৃথিবীর আয়ুষ্কাল কেন ফুরাচ্ছে না, আমি একদিন হলেও বেশি সক্রিয় থাকতে চাই।" বাংলা সাহিত্যে এই সক্রিয় স্রোত সৃজনশিল্পের মধ্যে দিয়েই মানুষকে কালজয়ী করতে পারে। পরিশেষে বলি, বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন ওপার বাংলার প্রসিদ্ধ চিত্রশিল্পী শ্রী রাজীব দত্ত। প্রচ্ছদটি বেশ আধুনিক এবং অর্থবহ ভাবনার দাবি রাখে। প্রায় সাড়ে তিন ফর্মা এই হার্ড পেপার বাইন্ডিং বইটির ছাপা কাগজ বেশ উন্নত মানের। প্রকাশক কাগজের ঠোঙা যত্ন সহকারে লেখাগুলি প্রকাশ করেছেন এবং সব মিলিয়ে বইটি এক উপযুক্ত পরিবেশনার স্বাক্ষর বহন করছে। পরিশেষে কবিকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে তাঁর কাব্যকৃতির উজ্জ্বল সাফল্য কামনা করছি।

উৎসর্গ

বাংলা নদী ভাঙন কেন্দ্রিক দেশ

কবিতা

এখানে পীড়িত অববাহিকা বইয়ের ১টি কবিতা পাবেন।

   
শিরোনাম মন্তব্য
বন্য চাঁদ পাখি