আমার এই দু'মুঠোর জীবনে গগণচুম্বী প্রশান্তির নিনাদ নিয়ে আসে কোনো এক কাকতালীয় শ্রাবণ
যে শ্রাবণ আমাইয় শুনতে শেখায় বৃষ্টির গান,বুনতে শেখায় শরৎের মেঘের মখমলে তুলোর বালিশ,শীতের ভোরের সুঘ্রাণ আর বসন্তের আড়ঙের সুর
সর্বনাশ ভেবেও ঝাপ দিতে হয় যে চিরহরিৎ সুধায়- একেই কী বলে মেলবন্ধন?
জীবনের রঙ পালটে যায় যে স্পর্শে,উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় লাল না হয়ে নীল হলো ক্যান এই প্রশ্নের,খুঁজে পাওয়া যায় লুকিয়ে থাকা বিষাদ
যে স্পর্শে আমরা ভুলে যাই আনন্দের উল্লাস
;আপন করে নিই বিষাদের আঁষটে গন্ধ।
সমস্ত পৃথিবী যখন ক্রোধ আর ঊচ্ছ্বাসের যুদ্ধে বিভোর,
আমি তখন সমুদ্রের এক কোণে বসে খুঁজতে থাকি বিষাদ আঁকড়ে বাঁচার সুখ
শাপলাশালুকের খাঁজে লুকিয়ে রাখা কয়েক ফোঁটা প্যারাফিন সুঘ্রাণ,
আকাশের পানে নির্নিমেষ চেয়ে থেকে থরথর চোখে মুঠোফোনবিহীন টেলিপ্যাথিক রাত্রি,
যাত্রীহীন ট্রামে চেপে বসে দিগন্তের টিকেট কাটা -
এসবকিছুই শেখা হতোনা যদি না আমাদের কপাল ছুঁয়ে যেতো সে স্পর্শ
সন্ধ্যামালতীর পরাগায়নের উৎসব,বাবুই পাখির রাতারাতি দালানকোঠা নির্মাণের পরিকল্পনা,
জোছনাস্নানে ডুবে থাকা হিজল বিলের নীলপদ্ম-
এমন অগণিত সব অলীক বাকবন্ডিতা ভেসে বেড়ায় আমাদের চোখের সামনেই
আফিমের চেয়েও ভয়ংকর যে নেশা,
স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর যে ভাবনা,শিল্পের চাইতেও মর্যাদাবান যে কথোপকথন
সমস্ত নেমে আসে এই ছোট্ট জীবনে অনেক বছর আগে
অনেক বছর আগে আমি জন্ম নিয়েছিলাম
এক অসার প্রবাল দ্বীপের রাজ্যে, নামহীন
কিন্তু সেই রাজ্যে গ্রাম ছিল, শহর ছিল।
শহর, সে-তো কবেই হয়েছে যন্ত্ররাজ্য
যন্ত্র আর যন্ত্রনা ছাড়া সেখানে কিছুই নেই
মানুষ হয়েছে এখানে হতাশার পাহাড় আর
পাখিরা হয়েছে এখানে খাঁচার গোলাম।
গোলাম হয়েছে মানুষ ও, টাকার, সম্পদের
মানুষ সম্পদ কে খায় ,নাকি সম্পদ মানুষ কে খায়
বুঝি নাই!
বুঝতে চাওয়াও এই শহরের এক অনন্য দোষ
যতই বুঝতে চাইবেন, গুলিয়ে ফেলবেন
তাই প্রতিরাতে এই মেলানকোলিক শহরে
একটা একটা করে পাখি জ্যোৎস্নাহীন আকাশে উড়াল দেয়।
এই শহরের কিশোরেরা, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কাঁদা শিখে গেছে
কাঁচের গ্লাসে তারা মদ ঢেলে অশ্রুর জল মেশায়
কিন্তু তার স্বাদ নিতান্তই দুঃখো ভোলানো
অবলিভিয়নের দেবতার মত কাজ করতে পারে না,
ভোর হলেই সব চুরমার হয়ে যায়
এবং থেকে যায় শুধু হ্যাংওভার।
কিশোরীরা হিমবাহে পোড়া কাঠ, হিংসেয় প্রজ্জ্বলিত
আলো নেভানো ছলনার দ্বারপ্রান্তে মৃত্যু নিয়ে ঘুমোয়।
মিষ্টিভাষার বেদনার শিকলে বার বার জড়িয়ে
নিজেকে বানায় আর্টিস্টম্যানের নিব ভেঙে যাওয়া পেন্সিলের মত।
সময়ের চাকা ঘুরলেও এশহরে গল্পের শেষটা একই থাকে
আগুন নিভে গেলেও এশহরে কাঠকয়লা জ্বলতে থাকে,
অলিগলি ঘাটলে দেখা যায়, না খেয়ে থাকা মানুষেরা
থেকে থেকে চিৎকার দিয়ে ওঠে
বাঁচার জন্য নয়, মরার জন্য।
আমিও ছিলাম এই শহরে, জীবিত অথবা মৃত
সিগারেটের ধোঁয়া হিসেবে অথবা ছাই হিসেবে
কিন্তু দুটোই, পুড়ে যাওয়ার পরের আখ্যান।
শহরের প্রতিটি চৌকাঠ আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে
শহরের নদীগুলো আমাকে সমুদ্রে মিশতে দেয়নি
তাই আমিও আর এই শহর কে ছাড়তে পারিনি
কোন এক অদ্ভুত প্যারাডক্সে পরে বার বার ফিরে এসেছি।
চক্রটা নতুন করে শুরু হলেও বক্ররেখা হয়ে নতুন উপসংহার হয়নি
থেকে গেছে পুরোনো অধ্যায়ের শেষ পাতায়।
গ্রাম, সে-তো কবেই উজাড় হয়ে গেছে সাইক্লোনে
ধর্ষিতার লাশ পেরিয়ে কৃষকেরা গিয়েছে আত্মহত্যা করতে।
নদী সে তো কবেই ভরে গেছে নর্দমার জলে
সাদা স্বচ্ছ পানি কালো হয়ে একাকার, পচে গেছে।
মাছ খাওয়া মানবেরা কবে মানুষখেকো হয়ে গেছে
টের পাওয়া যায়নি।
হাতির পেটে বোমাবাজি করেছে
আর মায়ের পেট থেকে মা জন্মালে মেরে ফেলেছে
এখানকার মানুষেরা হয়ে গেছে সভ্য,
কিন্তু সভ্যতা, সে-তো কবেই বিলীন হয়ে গেছে!
এখন যা পরে আছে সে-তো শুধুই অরাজ আর অরাজ।
এই অরাজকালীন রাজ্যের সুদুরপ্রসারি চিন্তায়
আমার অদূরদর্শী মনোভাব প্রকাশে
নিজের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করতে অপরাগ হয়েছি,
এজন্যে আমাকে ক্ষমা করবেন।
আমি এখিলিস এর মত অসীম সাহস নিয়ে
ট্রয়নগরী জয় করার ক্ষমতা রাখি না বলে
আমাকে কাপুরুষ ভাববেন না।
নামহীন রাজ্যের পরিচয়হীন কুনাগরিক হিসেবে
আমি নিতান্তই আত্মকেন্দ্রিক হওয়ার চেষ্টা করি,
নিজেকে ভালোমানুষ বলে দাবি করার আগেই
জেনে যাই, যে মানুষ কখনো ভালো হতে পারে না।
সত্ত্বার উদ্ভাবনের ধাপে ধাপে জেনে যাই
সভ্যতার ক্রমবিকাশ দিনে দিনে আমাদের বানিয়েছে অসভ্য।
নিখোঁজ আত্মার খোঁজে বের হয়ে জানতে পারি যে
দীর্ঘদিন আগেই আমরা হয়ে গেছি মৃত।
কালো সাদার ফারাক করতে গিয়ে দেখতে পাই
সবাই আসলে লাল হয়ে গেছে।
দিন আর আর রাতের তফাত এখন শুধু সুইচ টিপে দেয়ার অপেক্ষায়
কিন্তু ভালো আর মন্দের তফাত এখন কেও যেন খুঁজে না পায়।
রঙ্গমঞ্চের নাট্যকার হিসেবে সবাই এখন
অভিনয় করে চলেছে এই নামহীন রাজ্যে।
শহর গ্রাম সবকিছুই এখন এক দরিয়ার জলে
ভেসে যাচ্ছে, থামছে না, ভেসেই যাচ্ছে।
আবার কোনদিন ফিরে আসলে এই রাজ্যে
যদি দেখতে পাই নিশ্চিন্তে গাছে ফুটে আছে কাঠগোলাপ,
কেও তাকে খসিয়ে দিচ্ছে না, সেদিন বুঝব
রাজ্যের পাখিরা প্রান ফিরে পেয়েছে, আমার আত্মা জীবিত হয়েছে।
ততদিন আমার নামে যেন কোন চিঠি না আসে,
আমাকে কর্মব্যস্ত রেখে যেন বিভ্রান্ত করা না হয়
এই নামহীন রাজ্যের সকল সভা থেকে আমি ইস্তফা দিলাম,
তাই এখন থেকে আমি মুক্ত,
এখন থেকে আমি মুক্ত.........।