প্রভাতের উদীয়মান সূর্যের চাইতে গোধূলির অস্ত মান সূর্যই আমার অধিক প্রিয়।
কারন গত জুলাইয়ে সে আমায় বলে,
“বাঁচতে বাঁচতে যেদিন ক্লান্ত হয়ে যাবে সমস্ত সভ্য জাতি
সেদিন তুমি ভালোবেসে আমার ডাক নাম দিও মৃত্যু।“
তাই এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ।
এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল, রক্তে ভেজা সবুজ প্রান্তরই আমার পতাকা।
আমি এখানেই থাকব।
আমি বসে থাকব সন্তানহারা মায়েদের কান্নার পাশে।
অজ্ঞাতনামাদের এপিটাফহীন কবরের পাশে।
গুম হয়ে যাওয়া মানুষের অনস্তিত্ত্বের পাশে, আমি বসে থাকব একটা সাদা–কালো ছবি নিয়ে।
আর যাদের কোনো ছবি নেই , থাকে না, থাকতে নেই, যারা কেবলই নাম কিংবা অজ্ঞাতনামা, যাদের আল্লাহ ছাড়া কেউ নাই—তাদের কথা তো ভুলেই যেতে হবে!
তবু এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ।
এক দিকে সমুদ্র, তিন দিকে কাঁটাতার—আমি কোথায় যাব?
আমি মুর্দা হয়ে ভেসে থাকব বঙ্গোপসাগরের লবণজলে।
আমি লাশ হয়ে ঝুলে থাকব রক্তাক্ত কাঁটাতারে।
আমি ভূত হয়ে পাহাড়া দেব এই জমিনের তাবত শ্মশান ও গোরস্তান।
আমি কার্ফ্যুভাঙা চাঁদের মতো জেগে থাকব মিলিটারি কনভয়ের মাথার ওপর।
খুনিদের তাবত বুলেটের নিশানা হয়ে আমি দাঁড়িয়ে থাকব মুক্তির মিছিলের যেকোনো প্রান্তে।
তবু এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ।
যার যা কিছু হারায়েছে, খোয়া গেছে, চিরতরে—আমি তার তা কিছু হয়েই রয়ে যাব এইখানে।
ভাইয়ের লাশ কান্ধে নিয়েও জালেমের বিরুদ্ধে সটান থাকে যে মুষ্টিবদ্ধ হাত—সেই হাতই কাটছে এ ভূমির সোনালি ফসল,
সেই হাতই ঘোরাচ্ছে কলকারখানার তাবত মেশিন।
এই হাতেই লেখা হোক অনাগত আগামীর ইতিহাস।
আমি সে ইতিহাসের সকল দায় হাসিমুখে কাঁধে তুলে নেব।
তাও এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ।
জীবন আর মরণের ভেদাভেদ লুপ্ত এখানে।
এই আয়নাঘরের ঠান্ডা মেঝেই আমার বিছানা।
সেখান থেকে মাঝরাতে উঠে এক বেআব্রু জীবন হয়ে দৌড় দেব আমি;
সামান্য একটা বুলেটের জন্য কানব জারেজার।
সন্তান আমার বলবে, ‘আব্বু, তুমি কাদছ যে?’
আমি সেই সন্তানের মাসুম বয়স হয়ে থেকে যাব।
আঁচলে মুখ চেপে বেদখল বসতভিটার পাশে বসে যে একাকিনী ঈশ্বরের আদালতে প্রার্থনারত,
তিনি আমার মা—আমি তাঁর প্রার্থনার সরল সমর্পণ হয়ে থেকে যাব।
অনাগত অমরত্বের লোভে পীড়িত মানুষের কথা ভুলে যান নাই যে কবি,
আমি তার স্লোগানসর্বস্ব একটা দুর্বল গদ্যকবিতা হয়ে থেকে যাব।
ক্ষমতার সাথে আঁতাত না করে রাজপথে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন যে বুদ্ধিজীবী,
আমি তার গুরুত্ব না পাওয়া একটা পাবলিক লেকচার হয়ে থেকে যাব।
যে কৃষক কাস্তে হাতে লড়তে জানে, যে শ্রমিক হকের জন্য মরতে জানে,
যে মানুষ বধ্যভূমি খুঁড়ে শনাক্ত করতে পারে ছিন্নভিন্ন লাশের পরিচয়—
আমি তাদের ইনকিলাবি রুহ হয়ে থেকে যাব।
থাকব না কেন?
মেঘে মেঘে গর্জে উঠছে আকাশ;
বিরহ বা বিচ্ছেদ নয়, এ বরষা বয়ে নিয়ে এসেছে বিপ্লবী হাওয়া।
দেয়ালে দেয়ালে রক্তের হরফে অনূদিত হচ্ছে অনাগত সময়ের ইশতেহার।
আজাদির মিছিলের সামনে হাঁটু গেড়ে কান্নারত আজরাইল।
থাকব না কেন? মওতের গর্ভে জন্ম নেওয়া মানুষের সামনে থমকে দাঁড়িয়েছে সময়।
ক্যালেন্ডারের আজ আর কোনো অর্থ নেই।
থাকব না কেন? পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় বইছে নতুন মউজের পানি।
সৃষ্টির প্রথম প্রহরের মতো লাল হয়ে উঠেছে এই জুলাইয়ের বাংলাদেশ।
মারণাস্ত্রের ধাতব স্পর্শে রুহ ফিরে পাচ্ছে কাদামাটির নতুন মানুষ।
এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ৷
এই থমকে যাওয়া ক্যালেন্ডারই আমার সময়।
এই বিস্তীর্ণ মারণভূমিই আমার আজন্ম চাষবাস।
বাপ–দাদার ঘাম ও রক্তের নুনে ভেজা এই পলিমাটিই আমার রোজ হাশরের ময়দান।
আমি এখানেই থাকব।
এই বদ্বীপেই আমি পুনরুত্থিত হব বারবার।
কিন্তু এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ।
এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল, রক্তে ভেজা সবুজ প্রান্তরই আমার আমৃত্যু সাকিন।
আমি এখানেই বাঁচব চিরকাল।
মরবও—যেকোনো মরণ। মৃত্যুশয্যায় আমারে পড়ায়ো—ইনকিলাব জিন্দাবাদ।
আমার এপিটাফে রক্তের হরফে লেইখা দিয়ো—মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু।
প্রত্যেক বিপ্লবী বসন্তে আমার কবরের সবুজ ঘাসে যেন গজায় একটা লাল–টকটকা বুনো ফুল।