কবিতা কি? চমৎকার একটা উদাহরণ দেই।
.        "আজ বড় আনন্দ হইয়াছে।
        দেখিয়াছি, রান্নাঘরে কই আছে।"*
কবি এখানে বলতে চেয়েছিলেন, মা ঘরে কই মাছ রান্না করছে তাই তার আজ আনন্দের দিন। লাইন দুটোর শেষে অন্তমিলও (হইয়াছে, আছে) রয়েছে। কিন্তু কবিতা কি হয়েছে? কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মতে, কবিতা হতে হলে তাতে অন্ততঃ তিনটি বিষয় থাকা উচিত। কাব্যগুন, অন্তমিল ও ছন্দ।
উপরের লাইন দুটোয় অন্তমিল হয়তো আছে কিন্তু কাব্যগুন ও ছন্দ মোটেই নেই। নবীন অনেক কবিই কবিতা লেখার পর বিষয়টি খেয়াল করেন না। ফলে, তাঁদের কবিতাটি তাঁদের অজান্তেই হয়ে উঠে কখনো প্রবন্ধ, কখনো গদ্য।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের দুটো লাইন দেখি,
.        "সকাল বেলা কাটিয়া গেলো
                     বিকাল নাহি যায়।"
এখানে পাঠকগণ বুঝতে পারছেন, কবির সারাটা দিন কোনো না কোনো ভাবে কেটে গেলেও বিকেল টা যেনো কিছুতেই যাচ্ছে না। এখানে এই লাইন দুটো পাঠককে ভাবিয়ে তুলে, উদ্গ্রীব করে তোলে কেনো তা জানার জন্য। এটাই কাব্যগুন। লক্ষ্য করুন, এখানে কিন্তু অন্তমিল নেই। তবে যে জিনিস টা আছে সেটা হলো ছন্দ! অন্তমিল ছাড়াও কবিতা হয়। তবে ছন্দ ছাড়া কখনোই নয়।
ছন্দ কি? লাইন দুটো কে যদি এমন ভাবে বলি,
.           "সকাল কেটে গেছে
               বিকেল যাচ্ছে না।"
এখানে অর্থের পার্থক্য না থাকলেও আগের মতো কি আনন্দ, রস আস্বাদন করা যাচ্ছে? নিশ্চয়ই না। এ লাইন দুটো গদ্য, পদ্য নয়। আর কবিতার এই গুনটাকেই বলে ছন্দ।
ছান্দসিক প্রবোদচন্দ্র সেন এর মতে, "শিল্পীত বাক্যরীতির নামই ছন্দ।"
প্রবন্ধিক তাঁরাপদ ভট্টাচার্যের মতে, "ভাষার অন্তর্গত প্রবাহমান ধ্বনি সৌন্দর্যই ছন্দ।"
আবার, কবি আব্দুল কাদির এর মতে, "শব্দের সুমতি ও সুনিয়ন্ত্রিত বাণীবিন্যাসকেই ছন্দ বলে।"
উপরের সংজ্ঞা গুলো থেকে দেখা যাচ্ছে, বাক্যের যে গুন পাঠকের কানে শ্রুতিমধুরতা, ধ্বনি মাধুর্যতা আনে বা অন্যরকম ভালো লাগার দোলা দেয় তাই ছন্দ।
পুকুরের ঢেউ, শুকনো পাতা ঝরার মর্মর শব্দ, টিনের চালে বৃষ্টির একটানা শব্দ, কিংবা সদ্যজাত শিশুর কান্না কোনটাতে নেই ছন্দ! আপনার একটানা হাঁটা, কথা বলা, বাঁশির সুর, বিড়ালের ম্যাঁউ ম্যাঁউ, ছন্দ এসবের সবকটিতেই।
অন্যভাবে বললে, কবিতায় বাক্যের গায়ে পদ্যের রং লাগানোর ব্যাপারটাই ছন্দ। বিষয়টা আরো খোলাসা করছি। বাক্যকে এমন ভাবে উপস্থাপন করতে হবে যেনো পাঠক ভিতরে ভিতরে একটা দোলা অনুভব করতে পারে।
"সে চলেছিলো ট্রামে/তার ভাইকে নিয়ে/কলেজের রাস্তায়
আমি ছিলেম/পিছনের বেঞ্চিতে।"
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
"সে ট্রামে চলেছিলো" কিংবা "আমি পিছনের বেঞ্চিতে ছিলেম" লাইন গুলোতে কবি শব্দের স্থানের পরিবর্তন ঘটিয়ে পদ্যের রং ধরিয়েছেন তাঁর এই গদ্য কবিতায়।

অনেকেই ভাবেন কবিতায় মাত্রা গুনে ছন্দ থাকতেই হবে, বিষয়টা ঠিক এমন নয়। কেউ যদি সেটা করেন, তাহলে সেটা কবির উন্নত চিন্তাশক্তি, জ্ঞান ও দক্ষতার পরিচয়। তবে ছন্দ থাকতেই হয়। নয়তো কবিতা হবে না, গদ্য হয়ে লেখক হয়ে উঠবেন অজান্তেই।

.          আজব দেশের ধন্য রাজা
              দেশজোড়া তার নাম,
          বসলে বলে, "হাঁটরে তোরা"
              চললে বলেন, "থাম।"
-কবিতাঃ "রূপকথা"-শামসুর রহমান।
এই কবিতায় কিন্তু সবই আছে। কাব্যগুন, অন্তমিল ও ছন্দ। সুতরাং, এটিকে কবিতা বলে স্বীকার করতে কারোরই দ্বিমত পোষণ করার কথা নয়।

* গ্রন্থঃ কবিতার ক্লাস,পৃষ্ঠা ১২, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।