আমি অন্নপূর্ণা, দেবিমার আরেক নাম দিয়ে
আদর করে জন্মের সময় নাম রেখেছিল আমার মা-
কিন্তু পাশের ঘরে শাঁখের আওয়াজ বার বার মনে করিয়েছিল
"ওদের বাড়িতে 'ছেলে' হয়েছে গো, 'ছেলে'!"
মাথায় হাত রেখে কেউ সেদিন মন থেকে আদর দেয়নি,
আশিস দিয়ে সেদিন কেউ বলেনি,
"অনেক বড় হও মা, অনেক নাম হোক তোমার"
সেদিনই আমার বাবা পড়েছিল কন্যাঋনের দায়ে,
তারপর আস্তে আস্তে বড় হলাম-
দেখতে দেখতে জানলাম অনেক কিছু,
হঠাৎ সমাজ শেখাল,
আমি নাকি প্রতিমাসে রোজ কিছুদিনের জন্য অশুচি হই,
সে সময় দেবিমাও নাকি আমার নৈবেদ্য গ্রহনে অপারগ।
আমি পিছিয়ে, আমার পরিচয় পিতার নামে,
আমার পরিচয় স্বামীর নামে,
কিন্তু আমার একার কোন পরিচয় নেই,
আমার নেই কোন অস্তিত্বও।
যাই হোক, সেবার কালো মেঘের রাতে নেমে এল এক বড় দুর্যোগ,
বাড়ি ফিরতে দেরী হয়েছিল সেদিন,
মা-র বারবার ফোনে বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম,
"আহ, বার বার এত ফোনের কি দরকার,
ঠিক আছি আমি, রাখো তো।"
আমি জানতাম না, কিন্তু মায়ের মনের ওই এক টুকরো চিন্তা
আমার পিছু নিয়েছিল হিংস্র শ্বাপদের মতো,
এক অন্ধকার গলির মুখে ঢুকতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল একসাথে,
চার পাঁচ জন হবে, অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছিলাম না একদম,
শুধু বুঝেছিলাম, ওদের হিংস্রতা, বুঝেছিলাম ওদের ব্যভিচার,
মেঘের গর্জনে আমার চিৎকার চাপা পড়েছিল,
মুখ চেপে ধরে আমার-
সেদিন নারীত্ব হারিয়ে পতিতা হয়েছিলাম আমি।

ওই যে দূরে দাঁড়িয়ে আছে ওই মেয়েটা,
অন্য মেয়েদের সাথে ওর কিন্তু কোন তফাৎ পাবেন না
কিন্তু ওর জীবনে যেটা হয়েছে সেটায় সমাজের কিন্তু বড্ড যায় আসে,
কি হয়েছে-?
ওর ধর্ষণ হয়েছে।
কানে লাগলো না,খুব কথাটা?
নিশ্চয়ই আপনাদের খুব দয়া আসছে,
নিশ্চয়ই আপনাদের মনে হচ্ছে ও খুব অসহায়,
আপনাদের মধ্যে অনেকই এখন ওকে "পতিতা"-ও ভেবে নিতে পারেন,
ভাব্বেন না, ও ঠিক আছে, ও বেড়ে উঠছে রোজ,
ও এগিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন,
খুব জলদিই ও ডক্টরেট করবে, নিয়মিত নিজেকে ব্যস্ত রাখে নিজের কাজে,
ও ভাল আছে,
ও সুস্থ আছে,
শুধু সমাজের কাছে একটাই অনুরোধ,
ওর দিকে তাকিয়ে বলবেন না,
ও একটা "নষ্টা"
ও একটা "বেশ্যা"
মনে রাখবেন সেদিন রাতে আপনাদেরই কোন বাড়ির ছেলেই তার কামক্ষুধা মেটাতেই ওকে বেছে নিয়েছিল-
সেদিন ও না থাকলে, হয়তো নিজের বাড়ির কারও ওপর-
থাক সে কথা, অনুরোধটা খুব খাঁটি, খুব সহজ,
"ওকে ওর মতো বাঁচতে দিন; ভালো থাকতে দিন"।


অন্নপূর্ণাকে আমি চিনি খুব ছোট থেকে, বলতে গেলে জন্ম থেকেই
আসলে আমাদের জন্মটা একই দিনে ,পড়সির মেয়ে ও।
ছোট বেলা থেকে বড় হয়া, খেলাধুলো সব একসাথেই ছিল।
ও আসলে ছিল একটু মুক্তিবাদী,
আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলত,
"তুই যখন হলি, তখন তো শাঁখ বেজেছিল,
তাও দেখিস আমি তোর থেকেও অনেক বড় হব একদিন,
তোকে করা হাজারও আশিস নিয়েও তুই আমাকে ছাপিয়ে যেতে পারবি না,"
আমি শুনে হাসতাম, মনে মনে ভাবতাম, এগোতে নয়, তোকে পাশে নিয়ে চলতে চাই আমি,
ওকে দেখতাম আমি রোজ, ওর হাঁটা, ওর চলা, ওর কথা বলা
ওর নারীসঙ্ঘে রোজ তীব্র ভাষণ দেয়া, সব সব দেখতাম আমি,
আর মনে মনে একটাই কথা বলতাম,
"এগোতে নয়, তোকে পাশে নিয়ে চলতে চাই আমি,"
তোকে ভালবাসতে চাই-
যদিও সাহস করে বলা হয়নি কখনও,
যদি তুই আর কথা না বলিস,
যদি তুই হারিয়ে যাস অচেনার ভিড়ে,
তাই আগলে রাখতাম মনকে আর পাশে থাকতাম তোর।
সেদিন হঠাৎ রাত নটার সময় তোর ফোন বেজে উঠতেই
একটা বিদ্যুৎ নেমেছিল আকাশে,
"অনি, একটু আসবি রে? বাড়ি ঢুকতে পারছিনা, নিয়ে যা না এসে"
এটা তোর নতুন কোন আব্দার ছিল না,
রোজ রাত্রে দেরী হলেই আমাকে ডেকে নিস, যাতে
জেঠিমার কাছে বকুনির হাত থেকে বাঁচিয়ে দি আমি।
কিন্তু সেদিন ঝড়ের রাতটায় তোকে দেখে থমকে গেছলাম আমি,
আমার খুব চেনা মুখে শত আঁচড়ের দাগ,
সারা শরীর জুড়ে শুধু ক্ষত আর ঠোঁটের কোনে মলিন হাসি,
ওই হাসিটার মানে আজও বুঝিনি আমি,
ওই দিনটা মনে করলে আজও শিউরে উঠি আমি,
সেদিন নিজের ছেলে হবার ওপর প্রথমবার লজ্জা হয়েছিল আমার
সেদিনের পর তুই দেখা করিসনি অনেকদিন
মাঝে মাঝেই তোর বাড়িতে যেতাম আমি, যদি কোনোদিন বলিস কিছু
যদি একবার ডাকিস আমায়, যদি তুই আগের মতো আমার থেকে এগিয়ে যেতে চাস-
সবের জন্যেই যেতাম আমি।
হপ্তাখানেক বাদ অনেকের দেয়া কালিমা মেখে ডেকে পাঠিয়েছিলি তুই,
বলেছিলি, "আমি জানি অনি, তুই খুব ভালবাসিস আমায়, কিন্তু আমি সেই পুরনো অন্নপূর্ণা নেই রে,আমি নষ্ট হয়ে গেছি, তুই আসিস না আর।"
কথাটা মুহূর্তে ভেঙে দিয়েছিল আমায়, মাথা নামিয়ে শুধু বলেছিলাম,
" কারা তোকে নষ্ট বলেছে জানিনা আমি, আমার কাছে তুই আগের মতোই পূর্ণ, যে রোজ আমার থেকে অনেক আগে এগিয়ে যেতে চাইতো, আর আজ সে নিজেকে সমাজের ভয়ে ঘরে বন্ধ করে রাখে"।
রাগ করে চলে গেছিলাম আমি সেদিন,
কিন্তু তুই ঘুরে দাঁড়িয়েছিলি,
তুই ফিরে গেছিলি পুরানো ছন্দে,
সমাজের পাপ নিজের শিরায় বইতে বইতেও তুই এগিয়েছিলি অনেক,
কিন্তু কখনও পাশ ছাড়িসনি আমার-
আজ রোজ ঘরে ফিরলে দরজায় দেখি তোকে,
সিঁথির লাল সিন্দুরে আমার অন্নপূর্ণা রূপে।

ধর্ষণ মানেই শেষ নয়,
ধর্ষণ মানেই নির্ভয়াদের থেমে যাওয়াও নয়,
ধর্ষণ মেয়েদের ভুল নয়,
ধর্ষণ মানে কিছু কামুক পশুর সহসা আক্রমন-
যৌবনের নগ্ম কঠিন অভিশাপের হিংস্রতায় যদি সে শেষ হতে চায় তার হাত ধরে তাকে বোলো,
তুমি চিরশুচি,তুমি মা ।