বাংলা সাহিত্যে সনেট যেভাবে এসেছে তাহলো ইতালিতে চতুর্দশ শতাব্দীতে পেত্রার্ক, দান্তে, ষোড়শ শতকে ইংল্যান্ডে তারপর ঊনবিংশ শতকে মাইকেল মধুসূদনের হাত ধরে বাংলা ভাষায় সনেট প্রবেশ করে চতুর্দশ শতকে ইতালিতে সনেটের জন্মের পিছনে ঐ সময়ে ইতালিতে সংঘটিত রেনেসাঁ অর্থাৎ নবজাগরণের অবদান ছিলো তারপর বিভিন্ন পর্যায়ে আঙ্গিকগত, মাত্রাগত নানা পার্থক্য দেখা গেলেও সনেট নামেই কবিতাগুলি পরিচিত হয়ে এসেছে l বিজ্ঞান সনেট বলতে সনেটে বিজ্ঞানকে সমন্বয় করে রচিত সনেট। এটি সাধারণত: একটি নতুন আঙ্গিক সৃষ্টির প্রচেষ্টা। মাইকেলের সনেটের ধারা থেকে পৃথক করার জন্যই বিজ্ঞান সনেট রচনার চেষ্টা করা হয়েছে। বর্তমান সময়ে অনেকেই সনেটের আদল বিভিন্ন ভাবে ভাঙতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেখানে দেখা যাচ্ছে মাত্র স্তবকের উলট পালট ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না। তাই সনেটকে ভিন্ন আঙ্গিক দেয়ার লক্ষে রচনা করেছি বিজ্ঞান সনেট। বিজ্ঞান সনেট মাইকেল বা পের্ত্রাকীয় নিয়মে ১৪ লাইনে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। অন্য দিকে লাইনে মাত্রা অনেকেই ভেঙ্গে ৩২ পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছেন। কিন্তু সনেটের যে রীতিসিদ্ধ নিয়ম গীতি কবিতা। সেখানে গীতির একটা রেশ রয়েছে। যা ৩২ মাত্রার সনেটে থাকে না। সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২০-২২ মাত্রার হলে কিছুটা ভেঙ্গে হলেও গীতির সুর রাখা যায়। সবচেয়ে ভাল গীতির সুর সনেটে ১৮ শব্দের উর্ধ্বে হওয়া ঠিক নয়। মাইকেলের সনেট সুর হয়নি। কিন্তু তারপরে অনেকের লেখা সনেটে সুরাপিত হয়েছে। যেমন সুফী মোতাহার হোসেন এবং পরবর্তীতে মোঃ আবদুর রাজ্জাক এর সনেট। যদিও সনেট এখন বিভিন্ন ভাবে আদল পেয়েছে। অনেকেই রচনা বলে রচনা করছেন যা হয়ত ব্যাকরণ সিদ্ধ সনেট হয়ে উঠেনি। তবুও লেখার চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান সময়ে সনেট বিজ্ঞানের সমন্বয়ে বিজ্ঞান সনেট হিসাবে নাম ধারণ করেও চর্চা করা হচ্ছে। এর চেষ্টা আমিই প্রথম করেছি (রীনা তালুকদার)। অনুপ্রাস জাতীয় কবি সংগঠনের ১৯৮৮ সালে শুরু করা বিজ্ঞান কবিতার চর্চা অব্যাহত ভাবে করতে গিয়ে কাব্য সাহিত্যের সব শাখার মত সনেটকেও গুরুত্ব দিয়ে ভিন্ন আঙ্গিক দেয়ার চেষ্টা করেছি। সনেটকে অতি সাধারণের কাছে সহজ বাচ্যতায় তুলে ধরার চেষ্টায় বিভিন্ন রীতি আঙ্গিকে সনেট চর্চা করা হয়েছে বা হচ্ছে। বিজ্ঞান সনেটের আঙ্গিক সুরাশ্রিত না হলেও কাব্যিক সনেট হিসাবে একটা ভাল লাগার বিষয় আছে। এখন বিভিন্ন রীতিতে সনেট চর্চা করা হয়েছে। বিজ্ঞন সনেট বিষয়ে প্রথম আমি (রীনা তালুকদার) চর্চা শুরু করি। যা ৭ ও ১৪ নম্বর লাইনে অন্তমিল রেখে মোট ১৪ লাইন ঠিক রেখে। পরবর্তীতে আমার কবিতার শিক্ষক কবি ও সাংবাদিক শেখ সামসুল হকের সাথে আলোচনা করি। তিনিও কবি সামসুন্নাহার ফারুক আমার বিজ্ঞান সনেটকে ৭ ও ১৪ নম্বর লাইনে অন্তমিলকে সমর্থন করেন এবং তারাও চর্চা শুরু করেন। সনেটকে অতি সাধারণের কাছে সহজ বাচ্যতায় তুলে ধরার চেষ্টায় বিভিন্ন রীতির চর্চা করা হয়েছে। সনেট নামকরণ পরিবর্তন করা ঠিক হবে না। যেহেতু বিশ্বব্যপী সনেট পরিচিত। সেই কারণে একে কেবল ‘বিজ্ঞান সনেট’ হিসাবে নতুন নাম সংযোজন করে বিজ্ঞানকে সমন্বয় করে রচনা করা হচ্ছে। অন্য নামকরণ হলে কবিতা হিসাবে অন্য কোনো নতুন আঙ্গিকের কবিতা হবে। কিন্তু সনেটকে আধুনিয়কায়ন বা বাক বদলের চেষ্টা থেকেই বিজ্ঞান সনেট নামকরণ করা যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে।
ইতালীয়ান শব্দ সনেটো বা সনেটাস শব্দ হতে সনেট (Sonnet) শব্দটির উৎপত্তি। এর আক্ষরিক অর্থ মৃদুধ্বনি। সনেট এক ধরনের মন্ময় কবিতা। ইতালীয়ান কবি পেত্রাক সনেটের জন্মদাতা। বাংলা ভাষায় সনেট শব্দের অর্থ হচ্ছে চর্তুদশ পদী কবিতা। ইংরেজী ভাষায় সনেট শব্দের অর্থ হচ্ছে এক প্রকার মৃদু সংগীত বা হালকা গান। এ গান অষ্টক বা আট লাইন এক রকম সুরে এবং ষষ্ঠক বা ছয় লাইন অন্য রকম সুরে গাওয়া হয়। সনেট শব্দটি উচ্চারিত হলেই মনে পড়ে বাংলার সনেট গুরু কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কথা। সনেট মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যে প্রথম প্রবর্তন করেন। প্রথম বাংলা ভাষায় সনেট রচনা করতে গিয়ে মধুসূদন দত্তই এর নাম দিয়েছেন চর্তুদশপদী কবিতা। যা কিছুটা অঙ্কের মতো হিসাব কষে লেখার বিষয়। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত পের্ত্রাকের আঙ্গিকগত আর্দশ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে প্রথম ১৮৬০ সালে বঙ্গভাষা কবিতাটি রচনা করে সনেটের প্রবর্তন করেন। বাংলা সাহিত্যে সনেট শব্দটি উচ্চারিত হলেই বাংলার সনেট গুরু কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তকে তার নৈপুন্য-পূর্ণ সনেটের জন্য আলোচনায় না এনে থাকা যায় না। কেননা বর্তমান সময়েও এই কবিকে বাংলা সাহিত্যে সনেটের জনক হিসাবে এই অংশের জায়গাটি কোনো প্রকার যুক্তিতর্ক ছাড়াই ছেড়ে দিতে হয়। তিনিই বাংলা ভাষায় এত শ্রুতি মধুর বিশুদ্ধতায় সনেট কবিতা দিয়ে গেছেন।তাঁর বিখ্যাত সনেট কবিতা ‘‘কপোতাক্ষ নদ” যারা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে আসেন, তারা সকলেই অন্তত: জানেন। তিনি তাঁর এই কবিতায় একই সাথে অনেক বিষয়ের দিক্ নির্দেশনা দিয়েছেন। কবিতা সনেট হোক, ছড়া কবিতা হোক আর বর্তমান সময়ের গদ্য রীতিই হোক, এটা একটা বার্তা বাহক এবং অবশ্যই সেখানে ছন্দের রিনিঝিনি থাকতে হবে। সনেট বাংলায় পয়ার বা মহাপয়ারের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে। মাইকেলই তার রীতি ঠিক করে দিয়েছেন। বাংলায় মাইকেলের পরে প্রমথ চৌধুরী ও মোহিত লাল মজুমদার কিছুটা ভাল অবস্থানে রচনা করলেও গীতিরস থাকলেও শেক্সপীয়রের রীতিতে রচিত রবীন্দ্রনাথের সনেটকেও উৎকৃষ্ট হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। শেক্সপীয়ার লিখেছেন রোমান্টিক বা মুক্তবদ্ধ সনেট। পের্ত্রাকের সনেটের অষ্টক-কখ-খক, কখ-খক আর ষটক-গঘঙ-গঘঙ। তবে ষটকের ভাগ গঘ-গঘ-গঘ চালেও হতে পারে। শেক্সপীয়ারের অষ্টক-কখ-কখ, গঘ-গঘ আর ষটক-ঙচ-ঙচ, ছছ। সনেটের বিষয়বস্তু, স্তবক ও পর্ব বিন্যাসের ক্ষেত্রেও কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। কেবল ১৪ চরণ সীমাবদ্ধ নিয়মটি আদি আঙ্গিক ধরে রাখছে। একই সনেটে প্রকরণে বিবিধ বিষয়ের অবতারণা করে বাংলা ট্র্যাডিশনাল কবিতার আঙ্গিকের মতো সনেট চর্চা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে প্রকরণ সমৃদ্ধ হয়েছে, শব্দ ও অলংকার ব্যবহারে দুর্বোধ্যতা নেই বরং চতুরতা লক্ষণীয়। সনেটে প্রকরণকে বহুমাত্রিকতায় সমৃদ্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। অন্তমিলেও পরিবর্তন করে মিলবিন্যাসকে মুক্ত করা হয়েছে।
সনেট অঙ্কের মতো হিসাব কষে লেখার বিষয়। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছাড়া সনেট লিখেছেন প্রমথ বিশী, অজিত দত্ত, অক্ষয় কুমার বড়াল, মোহিত লাল মজুমদার, কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, জীবনানন্দ দাশ, ডাঃ সুশীল কুমার দে, আল মাহমুদ, সুফি মোতাহার হোসেন সহ অনেকেই। ইংরেজী ভাষায় প্রথম সনেট রচিত হয় ষোড়শ শতকে। আর ইংরেজি ভাষায় প্রথম সনেট রচনা করেছিলেন Wyatt এবং Surrey ইংরেজী সাহিত্যে সনেট লিখেছেন কবি ট্যাসো, সিডনি, শেকসপীয়র, মিল্টন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, জন কীটস, এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিং, ডি.জি রসেটি, আর্নল্ড রূপাট ব্রুক প্রমুখ। ইতালীয় (লাতিন ভাষায়) ভাষায় সনেট লিখেছিলেন পেত্রার্ক, দান্তে l প্রতিটি কবি সনেট রচনা করেছেন তাঁদের এক বা একাধিক প্রেমিকা বা প্রেমের উৎস ছিল, যাঁদের উদ্দেশ্য করে সনেটগুলি লেখা হয়েছিল l জুটি করে বললে বিষয়টি এরকম - Petrarch - Laura, Dante - Beatrice, Surrey - Geraldine, Sidney - Penelope Devereux, Spenser - Elizabeth Boyle, Shakespeare - a Dark Lady এবং an aristocratic friend আবির্ভাব লগ্ন থেকে ইংল্যান্ড যাত্রা পর্যন্ত সনেট এর মূল বিষয় ছিলো প্রেম l একটি মহিলাকে উদ্দেশ্য করে সনেট রচনা করা হত এবং প্রেম বিষয়টিকে আধ্যাত্মিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হত সনেট লেখা একটি সাধনা ও সাহসের ব্যাপার। এখনও তা কবিরা রচনা করছেন। পরবর্তীতে শুদ্ধ সনেট রচনা করে কবি সূফী মোতাহার হোসেন সনেট রচনা করে আদমজী পুরস্কার, বাংলা একাডেমী পুরস্কার ও প্রেসিডেন্ট পুরস্কার (১৪ আগস্ট, ১৯৭১ পাকিস্তান সরকার) লাভ করেছেন। তবে ১৪ লাইন হলেই সনেট হয় না। এটি এক প্রকার সংযমী কবিতা যার একটি মাত্র অখন্ড ভাবকল্প। এর নির্মাণ কৌশল একটি ভিন্নতর আঙ্গিকে গীতি নৈপুন্যে রচিত। বর্তমানে সনেটের লাইন ১৪টি ঠিক রাখলেও মাত্রার দিক থেকে ১৪-৩০ মাত্রা পর্যন্ত সনেট রচিত হচ্ছে। সনেটের কল্পনাকে নির্মাণ শৈলীর রীতি মেনেই রচনা করা সিদ্ধ সত্য। ছন্দ তরঙ্গের ঢেউ না হলে পাঠক হৃদয় জয় করা অসম্ভব। এজন্য সনেট ছন্দসিদ্ধ হওয়া একান্ত দরকার। সনেট লেখা একটি সাধনা ও সাহসের ব্যাপার। বর্তমান সময়ে কবিরা সনেট আগ্রহ নিয়েই রচনা করে যাচ্ছে।
কবিতা অনেক রকম হতে পারে। কিন্তু সনেটের ধারাটি একেবারেই ভিন্নতর। কবিতা বা ছড়া লিখতে হলে ব্যাকরণ মনে রাখার বিষয় নয় তবে মেনে চলার বা চর্চায় রাখার বিষয়। মাইকেল মধুসূদন এতো ভালো লিখেও বলেছেন তিনি সনেট নয় চতুর্দ্দশপদী কবিতা লিখেছেন। তিনি তাঁর সাহিত্য কর্মে ছন্দের ব্যবহার করেছেন একশভাগ। সেক্ষেত্রে ছন্দের সার্থক রূপকার হিসাবেও মাইকেল মধুসূদনের সুখ্যাতি আছে বাংলা সাহিত্যে। মাইকেলের সনেট সাধারণত ছন্দ এবং রসকে জোর দিয়ে গঠিত। সনেট যেহেতু মাপামাপি করবার বিষয় তাতে ধ্বনি, ভাব, পদ, যতি, ছন্দ, মাত্রা, রীতি, আঙ্গিক, বক্রোক্তি, রস, অনুপ্রাস, উপমা এ বিষয়গুলোও থাকা জরুরী। ছড়া এবং সনেট দুটোই সাবধানতা অবলম্বন করে উপস্থাপন করতে হয়। ধ্বনির সুষ্ঠু প্রয়োগ না হলে উচ্চারণ গত দিকে সুরব্যঞ্জক হয় না। আর লজ্জা, জড়তা হতে মুক্তি পেতে হলে ছন্দের প্রয়োজন আছে। যতির বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোথায় থামবো সে পথ নির্দিষ্ট করতে হবে। শ্রুতি রক্ষার জন্যই থামতে হবে। তবে নিয়ে আমার পৃথক প্রবন্ধ থাকায় এখানে খুব একটা বলবো না। যতির ক্ষেত্রেও কিছুটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। অতিযতি মুক্তকরণ এবং কেবল মাত্র পাঠ বা আবৃত্তির সময় একবারে স্বাভাবিক শ্বাসের গতির যে ব্যারোমিটার ততখানি পরিমাণ লিখে পরে লাইনে গেলে অটোমেটিক উচ্চারণ সমস্যা হয় না। এখানে দাড়ি, কমা থাকলে যা না থাকলেও তা কোনো সমস্যা দেখা দেয় না। আর লেখার একেবারে শেষে মাত্র একটি দাড়ি (।), আর আশ্চর্যবোধক (!), প্রশ্নবোধক চিহ্ন (?), কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিসর্গ(ঃ), ও সেমিকমা (;) ব্যবহার করা হলে অসুবিধা হচ্ছে না। আর এভাবেই অতিযতিমুক্তকরণ বিষয়টি ব্যবহারিক ভাবে চেষ্টা করছি। রস, একই কবিতায় বিভিন্ন রসের উপস্থিতি থাকবে। কিন্তু সামঞ্জস্যপূর্ণ মিলন সে জন্য বড় প্রয়োজন। উপমাও সঠিক ভাবে ব্যবহৃত হতে হবে। রীতি হচ্ছে নতুনত্ব। নতুন ভাব সঞ্চার করে নতুন কিছু সৃষ্টি করা। বক্রোক্তি স্বাভাবিকের চাইতে অস্বাভাবিক কিছু সৃষ্টি করা। চালের ক্ষেত্রেও কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছে। কোনো সনেটে মাত্রা পূর্বে মত ৮/১০ বা ৮/৬ বা এই রূপ মাত্রার ভাগের ক্ষেত্রে ভাগ না করেই সরাসরি র্যানডম মাত্রায় ১৬/১৮/২০/ ২২ মাত্রায় চর্চা করা হয়েছে।
বর্তমানে সনেট রচনা করছেন বিজ্ঞান কবি শেখ সামসুল হক, বিজ্ঞান কবি সামসুন্নাহার ফারুক, বিজ্ঞান কবি ফরিদ্জ্জুামান, কবি লিন্ডা আমিন, কবি জামসেদ ওয়াজেদ, কবি মোঃ আবদুর রাজ্জাক, বিজ্ঞান কবি রীনা তালুকদার (এই প্রবন্ধকার) সহ অনেকেই। বর্তমানের সনেট রচয়িতাদের মধ্যে মোঃ আবদুর রাজ্জাকের কয়েকটি সনেট গান হিসাবে সুরাপিত হয়েছে। এছাড়া অন্যদের সনেট গান নয় বরং কাব্যিক আঙ্গিকে রচিত। ধীরে ধীরে সনেট গীত থেকে সরে গিয়ে নিরেট কাব্যের আদলে রূপান্তরিত হচ্ছে। আর মিলবিন্যাসেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। অর্থাৎ যতোটা সহজ করে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করা যায় সে চেষ্টাই করা হয়েছে। সাধারণত সনেটে শিরোনাম দেখা যায় না। মাইকেলের সনেটে পর্ব ভাগ করে রচিত বিভিন্ন উপসর্গে। কিন্তু বর্তমান সনেটে শিরোনাম দিয়ে আবার শিরোনাম ছাড়াও রচিত হচ্ছে।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের সনেট চৌদ্দ অক্ষরের প্রথমভাগ ভাব কল্পনা প্রধান অষ্টক আর দ্বিতীয় ভাগ ভাবের বিস্তৃতি সাধন বা ব্যাখ্যা করে ষষ্টক ষটক হিসাবেই রচিত। কিন্তু অনেকেই চৌদ্দ (১৪) মাত্রার স্থলে আঠার (১৮), বাইশ (২২) মাত্রা পর্যন্ত লিখেছেন। দুই স্তবকেই পৃথক পৃথক অন্ত্যমিল রয়েছে। বর্তমানে অন্ত্যমিলের বিষয়টি কবির ইচ্ছেমত যেকোন পংক্তিতে দিয়েও রচিত হচ্ছে। অনেকেই আবার একবারেই মিলবিহীনই অষ্টক বা ষটক ভাগ রেখেই রচনা করছেন। সনেট মূলত কিছুটা পয়ার বা মহাপয়ারের নিয়মে রচিত। মাত্রা যেখানেই শেষ হোক লাইনে চৌদ্দর বেশী যাবার রীতি নেই। সনেট ভাবের দ্যোতনা সৃষ্টি করে। অনেকেই পংক্তির মিল বিন্যাস কখখক, কখখক, গঘঙ, গঘঙ অথবা কখখক, কখকক, গঘ, গঘ, গঘ, গঘ, গঘ, অথবা গঘঙ, গঘঙ, আবার অনেকে কখ, কখ, গঘ, গঘ, ঙচ, ঙচ, চছ ইত্যাদি রীতিতে রচনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যে মাইকেলই ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভাষা কবিতাটি প্রথম সনেট হিসাবে লেখেন। তিনি ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে বসবাসকালীন সময়ে পেত্রার্কের সনেটে অনুপ্রাণিত হয়ে সনেট রচনা করেন। নিচের সনেটটি উইলিয়াম শেকসপিয়ার রচিত ১৮ নম্বর সনেট, শিরোনাম ‘শ্যাল আই কমপেয়ার...’। যদিও এখানে চৌদ্দ লাইন রয়েছে। অনুবাদে দেখা যায় মাত্রায় সমতা নেই।
‘‘আমি কি তুলনা করব তোমার সাথে গ্রীষ্মকালীন দিনের ?
তোমার রূপের মাধুরী ও কোমলতা তাকেও ছাড়ায় ;
মে দিনের ঝড়ো হাওয়া নাচায় প্রিয়তমা কুঁড়িদের
স্বল্প সময়ে ফুরিয়ে যায় গ্রীষ্মের মাধুরিমা
কখনো উষ্ণ আকাশ রক্তিম চোখে তাকায়
প্রায়ই চোখে পড়ে সোনারঙ তার মিশেছে পান্ডুরতায়
সব সুন্দরই রূপ মায়া তার একদা হারায়
দৈবের বশে প্রকৃতিলীলায় ক্রমে ম্লান হয়ে যায়
তবু অনাদি গ্রীষ্ম ধারণ করে কখনো বিবর্ণ হবে না তুমি
তোমার এ রূপ তোমাকে জড়িয়ে থাকবে চিরকাল
মৃত্যুও দাম্ভিকতায় বলবে না তার ছায়াবেষ্টিত তুমি
যত দিন যাবে তত তুমি কবিতায় ভাস্বর
যতদিন মানব নেবে শ্বাস দেখবে দু’চোখ ভরে
তোমার আয়ুর আশ্বাসে এ কবিতা পাবে দীর্ঘ জীবন।”
মাইকেলের ১৮৬০ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে প্রথম রচিত সনেট ঃ
নিজাগারে ছিল মোর অমূল্য রতন
অগণ্য; তা সবে আমি অবহেলা করি
অর্থলোভে দেশে দেশে করিণু ভ্রমণ
বন্দরে বন্দরে যথা বাণিজ্যের তরী
কাটাইনু কতকাল সুখ পরিহরি
এই ব্রতে, যথা তপোবনে তপোধন
অশন, শয়ন ত্যাজে, ইষ্টদেবে স্মরি
তাহার সেবায় সদা সঁপি কায় মন।
বঙ্গকুল লক্ষী মোরে নিশার স্বপনে
কহিলা-‘‘হে বৎস, দেখি তোমার ভকতি
সুপ্রসন্ন তবপ্রতি দেবী সরস্বতী
নিজ গৃহে ধন তব, তবে কি কারণে
ভিখারী তুমি হে আজি, কহ ধন-পতি?
কেন নিরানন্দ তুমি আনন্দ সদনে ?
অমিত্রাক্ষর ছন্দ বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের অভিনব সৃষ্টি। মধুসূদন দত্ত অকল্পনীয় সাফল্যের অমিত্রাক্ষর ছন্দের মূল কাঠামোটি পয়ার অর্থাৎ প্রতি চরণে ১৪ মাত্রা। অভ্যন্তরে হলন্ত অক্ষর ১ মাত্রা বলে যুক্তাক্ষর বহুল যা অমিত্রাক্ষর ছন্দের মূল লক্ষণ। পার্থক্য হচ্ছে পয়ারের প্রতি পঙতিতে ভাবসম্পূরণ, অষ্টম অক্ষরের পরে সুনির্দিষ্ট যতি ও উপচ্ছেদ আর পদান্ত মিল অর্থাৎ অন্তানুপ্রাস থাকে। কিন্তু অমিত্রাক্ষর ছন্দ এই বন্ধনের নির্দেশ অস্বীকার করে স্বাধীনভাবে ভাবের আনুগত্য করে। এতে ভাবের প্রবাহ পংক্তি সীমায় এসে না থেমে আবার পঙতির মধ্যে প্রয়োজনে ছেদ বিন্যাস করে বর্ণনাকে জীবন্ত ও সৌন্দর্যময় করে তোলে। পয়ার ভাঙা মেঘনাবধের অলংকারিক ভাষায় নদী-গিরি, সন্ধ্যা-প্রভাত, উদ্যান-অট্টলিকার বর্ণনায় মধুসূদন ভাষার ঐশ্বর্যকে উদার মনে ব্যবহার করেছেন। অলংকারের সৌন্দর্যে ভাষার মাধুর্যে, অসংখ্য শব্দ ব্যবহার ও ছন্দের অভিনবত্ব প্রয়োগের মাধ্যমে মেঘনাদবধ কাব্য খন্ড কাব্যের খন্ডিত পর্যায় অতিক্রম করে মহাকাব্যের বিশালতায় পৌঁছে যায়। প্রতিভার মৌলিকতা ছাড়া, শুধুমাত্র অনুকরণ, অনুসরণ করে কোনো কবিই চিরজীবী হতে পারে না। মধুসূদনের অপার প্রতিভার স্পর্শেই প্রাচ্য থেকে কাহিনী আর প্রতীচ্য থেকে আঙ্গিক গঠন ও অলংকরণ নিয়ে করুণ রসে সিক্ত মেঘনাদবধ কাব্য বাংলা সাহিত্যের এক কালজয়ী কাব্যগাঁথা।
মাইকেলের চতুর্দ্দশপদী কবিতার মিল বিন্যাস
কবিতা মিল বিন্যাস
বঙ্গভাষা কখকখ - খকখক-চছছচজজ
মেঘদূত কখকখ- খককখ- চছচছচচ
পরিচয় কখকখ - কখকখ- চছচছচছ
সায়ংকালের তারা কখখক -কখখক- চছচছচছ
শনি কখকখ-কখখক-চছচছচছ
রাশি চক্র কখকখ- খকখক-চছচছচছ
বসন্তে একটি পাখীর প্রতি কখখক- খকখক- চছচছচছ
সৃষ্টিকর্তা কখখক- খকখক- চছচছচছ
কপোতাক্ষ নদ কখকখ- কখখক -চছচছচছ
কাশীরাম দাস কখকখ- কখকখ- চছচছজজ
কৃত্তিবাস কখকখ -কখকখ- চছজচছজ
জয়দেব কখখক- খকখক-চছছচজজ
ইশ্বরী পাটনী কখখক- কখখক- চছচছচছ
ইশ্বরচন্দ্রগুপ্ত কখকখ-কখকখ-চছচছচছ
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর কখকখ- কখকখ-চছচছচছ
ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর কখকখ-কখকখ-চছচছচছ
মহাভারত কখখক-কখখক-চছচছচছ
সরস্বতী কখকখ-কখকখ-চছচছচছ
রামায়ন কখখক-কখখক-চছচছচছ
বাল্মিকী কখখক-চছচছচছ
সংস্কেত কখখক-ককখক-চছচছচছ
কোজাগরী লক্ষীপুজা কখকখ- কখকখ-চছচছচছ
বিজয়া দশমী কখকখ-কখকখ-চছচছচছ
কুরুক্ষেত্রে কখকখ- খককখ-চছচছচছ
গদাযুদ্ধ কখখক-খকখক-চছচছচছ
উবর্বশী কখকখ-খককখ-চছচছচছ
সীতা বনবাসে কখকখ-কখখক-চছচছচছ
সুভদ্রা কখকখ- খকখক- চছচছচছ
শকুন্তলা কখকখ-কখকখ-চছচছচছ
হরিপর্ব্বতে দ্রৌপদীর মৃত্যু কখকখ-কখকখ-চছচছচছ
করুণ রস কখখক- খককখ-চছচছচছ
বীর রস কখকখ- কখকখ-চছচছচছ
শৃঙ্গার রস কখকখ- খককখ-চছচছচছ
রৌদ্ররস কখখক- খকখক- চছচছচছ
মিত্রাক্ষর কখখক-খকখক-চছচছচছ
কবিগুরু দান্তে কখকখ- খকখক- চছচছচছ
কবিবর আলফ্রেড টেনিসন কখখক-কখকখ-চছচছচছ
কবিবর ভিকটর হ্যুগো কখখক- কখকখ-চছচছচছ
পন্ডিতবর থিওডর গোল্ডস্টুকর কখকখ-কখখক-চছচছচছ
কতিপয় বিজ্ঞান সনেট দেখা যাক ঃ
বিজ্ঞান সনেট-২
শেখ সামসুল হক
আর হবে না বসত বাড়ি এখানে সেখানে
আড়ি খোলার মাজরা পোকা খাইছে তামাম
যীশু যখন লাগছে পিছু রেহাই পাবার
পথ দেখি না নিকট দূরে চিৎকার শুনি
ক্ষেপা বাউল দোতারা হাতে ছুটছে কেবল
সেও জানেনা কোথায় যাবে অচেনা সবই
অন লাইন ম্যাসেজ নেই অফ থাক ভালো
হট কবিতা মুখ থুবড়ে পড়বে এখনি
বায়না পত্র তাল পাবে না সময় খারাপ
দেশ পন্থির জয় গানের বাতাস বইছে
মর পাকিরা মরণ জ্বালা দেখ না কেমন
আর পাবে না ফণা তোলার স্বপ্ন সুযোগ
হাতে এটম ফেল চাপাতি সাধু শয়তান
কাল কার্তিক কপাল মান জীবনটা কালো।
বিজ্ঞান সনেট-ছোঁয়া
শেখ সামসুল হক
সময়টা সবেগে আবেগে উৎকীর্ণময়
বেহুশের বরফ সাদায় কাটা কল জল
হঠাৎ উজান চরে তীব্র ধূলি ঝড় ছোটে
কান্নায় সাজে না বাউ কুড়ানীর বউ
বুঝবে না মেছের পাগলা জেল খানার কী
অর্থ ; সেই নাতাশা বাতাসা পেলে খুশী হয়
নিদ্রা বিহীন হাইড্রোজেন বোমা শক্তিময়
তাপে জ্বলে রাগে অনুরাগে মশাল বিশাল
মন আমার যুদ্ধ জয়ের খবর শোনায়
এমনটা হলে ভালইতো কঠিন প্রত্যয়
এটা ভাবনার রূপকথা থাকুক তাহলে
এখানে নয়তো বাস চলো যাই ঐ মঙ্গলে
আকাশ খেয়া রেডি যা নেবার নাও না
গুমোট অন্ধকার ছোঁবে না মাধবী হৃদয়।
বিজ্ঞান সনেট- কেন্দ্রিণ আসরে
সামসুন্নাহার ফারুক
যে দিকে তাকাই ফিরে যেখানেই তুমি
অকৃত্রিম আমন্ত্রণে ঠোঁটের ডগায়
পল্লবিত বৃক্ষপত্রে মৌসুমী মায়ায়
বিবেকের রাজপথে বিশুদ্ধ বৈভবে
হৃদযন্ত্রের চত্ত্বরে বাসন্তী আবেগে
মহাকাশ অবকাশে সোনারঙা ভোরে
তোমাকেই দেখি ফিরে আরশী নগরে
বৃত্তের ব্যাসার্ধ থেকে যে কোনো এ্যাঙ্গেলে
আইবল মনিটরে তোমাকেই মেলে
এলোমেলো সময়ের কিংশুক রাতে
কল্পনার পেরিস্কোপে জীবনের গানে
উন্মাতাল স্নায়ুকোষে আগ্নেয় উত্থানে
মোবাইল রিংটোন চন্দ্রিমা বাসরে
সর্বত্র তোমাকে দেখি কেন্দ্রীণ আসরে।
বিজ্ঞান সনেট- স্কাইপি চ্যাটিং
সামসুন্নাহার ফারুক
ও চোখের কর্ণিয়ায় ঢেউ ঢেউ সুখ
শরীরের কারুকাজে বিজলী চমক
জোছনার দ্যুতি মায়া শিকস্তি পরান
দেহজ অর্গানে খোঁজে বিনম্র বয়ান
কবিতা বিলাসী মন বৈরী হাওয়ায়
প্রতিশব্দে মালা গাঁথে মৌণ অভিজ্ঞানে
ব্ল্যাকহোল অন্ধকারে সহর্ষ যৌবনে
পরিশুদ্ধ বিবেকের অনু পরমাণু
বিশুদ্ধ নির্যাসে ভরে জৈব রসায়ণ
সাতরঙা সুর ভাঁজে খরশ্রোতা নদী
মাতাল প্রহর গোণে জলজ কাহন
বিধির নাটাই হাতে থমকে দাঁড়ায়
হৃৎপিন্ড এপিগ্রাফে উলসি গোপনে
স্কাইপি চ্যাটিং সারে জোয়ারিত ক্ষণে।
বিজ্ঞান সনেট- বাঙালি জাতির ত্রাতা
ফরিদ্জ্জুামান
বাঙাল ঠোঁটে হাসি ফুটুক লড়াই তোমার কায়মনে
সুখ সমৃদ্ধি এনেছিলে মেহনতীর জীবনে
শয়ন স্বপন জাগরণে জনক তুমি নিবিষ্ট
স্বাধীনতা অর্জন এবং সুসংহত অভিষ্ট
পদানতের গ্লানি মুছে মর্যাদারই উচ্চ শির
তোমার দানে বাঙালি আজ বিশ্বসেরা স্বাধীন বীর
তোমার ডাকে মুক্তিসেনা রণাঙ্গনে মৃত্যুপণ
মুক্তি পাগল খুন ঢেলেছে পতাকাতে অগণন
মানচিত্র ও জয় নিশানে তোমার প্রতিচ্ছবি
পিতা মুজিব স্বাধীনতার জীয়ন ত্রাতা কবি
সপরিবার আত্মদানে অবিনাশী বরাভয়
রাখাল রাজা বোধ মননে চিরদিনই জেগে রয়
বাংলাদেশের শিরায় তোমার শোণিত প্রবহমান
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।
বিজ্ঞান সনেট- বিজ্ঞান কাব্যের জয় কেতন
ফরিদুজ্জামান
অথর্ব কূপ মন্ডুকে দূরে থাকে বিজ্ঞানের
তাই তো তারা চোখ বুজে সব শিষ্য হইছে নির্জ্ঞানের
বিজ্ঞানে আজ বেগ এনেই চিত্তে জাগায় সুখ চেতন
জীবন যাত্রায় নতুন মাত্রায় উড়িয়েছে জয় কেতন
বিজ্ঞান আলোর প্রেক্ষিতে পালিয়ে যায় ভূত প্রেতে
বঙ্গবন্ধুর বিজ্ঞান কবি কবিতায় ওঠে মেতে
বাস্তহারা আজ ঘরে মঙ্গাও জাদুঘরে
চিত্র কল্প উপমারা ছন্দ মিলে সুর ধরে
ওইতো রীনা বাজায় বীণা করছে ঘৃণা জড়তা
বিজ্ঞানেরই কাব্য গুণে পাবে সে অমরতা
বিজ্ঞান ছাড়া অচল সকল বিরুদ্ধদের চরম ধকল
তাইতো খর তাপে চালায় বিজ্ঞান কাব্যের বরফ কল
দলে দলে তাই জুটেছে বিজ্ঞান মার্তৃক কবিতায়
বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান কবি ওম পেতে চায় সবিতায়।
বিজ্ঞান সনেট-৪২
রীনা তালুকদার
হাজার রকম আদর সোহাগে বুকের দুপাশে
কল্লোলিত নদী জলের আঁচড়ে বলতে বলতে
যায় ভালোবাসি সেই পরিচিত শব্দের তাপের
তরঙ্গ নামছে উপত্যকা বেয়ে প্লাবিত জোয়ার
সমভূমি ভেসে সয়লাব হলো সীমান্ত প্রদেশ
হাঅন্ন শামুক নদীর মিলনে স্নায়ুর আবেগে
আঁধার ভাঙছে স্টেশন আঁকছে জঙ্গী জ্বালা জাগে
জনারণ্যে আলো অনেক অচেনা মুখের উদাসী
চাওয়া হাওয়া উড়ছে ঘুরছে পাশের ঘূর্ণিতে
অনুচ্ছারিতের ভাষায় আশায় ভাসায় হাসায়
চেয়ে চেয়ে দেখা অনু পরমাণু ইলেক্টো প্রোটন
বিক্রিয়া জারকে ফাগুনে আগুনে জ্বলে জ্বলে উঠা
দুই মেরু সম প্রকল্পে সংকল্পে উচ্চতা একতা
ফিরা ফেরে ধোঁয়া উঠা কাপে শেষ চুমুকের আগে।
বিজ্ঞান সনেট - ৩৫
রীনা তালুকদার
বর্ষা থাকে হরহামেশা লাল ডালিমে শূন্য শঙ্খ চূঁড়ে
ঝর্ণা পাহাড় কাঁপে মেঘের ডাকে নীল আকাশ জুড়ে
রকেট কবিতার রকেট গতি সনেট লেখা বিজ্ঞানে
বিজ্ঞান কাব্যে সব লেখা যায় সাধন করো ধ্যান জ্ঞানে
প্রেম মিশেল বর্ষাতে আর বিজ্ঞান মিশেল ছবিটায়
কেউ জানে না সুখ্যাতি কোথায় পাবেন কোন্ কবিতায়
নতুন দিকে নতুন ধারা ভালো ; নয়কো কিছু মন্দ তা
যা কিছুই হোক যেখানে সেখানে বাংলায় আনো শুদ্ধতা
প্রেম যমুনায় বর্ষা থাকুক কালিদাসের মেঘদূত
জয়গোস্বামীর মেঘবালিকা গুণের দ্রৌপদী অদ্ভূত
কবি গুণের ধ্রুপদী বরষা আমার আছে মেঘদেব
শরৎ চন্দ্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ঠাকুর গ্রীস্ম দেব
কবি শীতলদাস, নায়ক বসন্ত চৌধুরী ঋতু নামি
শ্রাবণ মাসে কদম ফুলে বর্ষা কবি বিষ্ণুদেই দামী।
অনেকেই এখনো মাইকেল রীতি নিয়ে পড়ে আছেন। মাইকেলের পরে দীর্ঘ সময় আমরা কী করছি সনেট কবিতা নিয়ে ? যেখানে বিভিন্ন আঙ্গিকের কবিতার মান্নোয়ন ঘটছে প্রতিনিয়ত। সেখানে সনেট সেই মাইকেলের যুগে পড়ে থাকতে পারে না। অনেকেই সেই মাইকেল বা রবীন্দ্র যুগের ভাষা, সুর, শব্দ ব্যবহার করেন। দাবী করেন অভিধানে আছে ব্যবহার তো নিষেধ নেই। অভিধানে সবই আছে ব্যবহার তো সঠিক ভাবে করা চাই। রবীন্দ্র ‘মোর’ লিখেছে মোর শব্দ লিখলে অসুবিধা কী ‘আমরা’ না লিখলে কী বাক্য ভুল হবে? ‘হস্তী’ শব্দটা অভিধানে আছে হাতি লিখবো কেন? অনেকেই সাধু ভাষায় এখনো লিখেন কিছুই বলা যায় না বললে বলেন সাধু ভাষাটা কি রবীন্দ্রনাথের নিজের সম্পত্তি সে ছাড়া কেউ ব্যবহার করতে পারবে না? আবার কেউ কেউ সাধু চলিত দুই ভাষাতেই গুরুচন্ডালী করেন ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার কথা হলো আমরা এসব ক্ষেত্রে কী কাজ করলাম? আমরা কী কেবল তারা যা দিয়েছে তার মধ্যে হাবুডুবু খাবো ? তাহলেতো চর্যাপদ থেকে আর পরিবর্তনের দরকার ছিলো না চর্যাপদের ভাষায় লেখা সবাই লিখলেই হতো। খামোকাই যুগে যুগে মনীষীদের এত পরিশ্রমের কী দরকার ছিল। যাক সেই চিন্তা থেকেই মান্নোয়নের জন্য বিজ্ঞানকে সমন্বয় কের ৭ লাইন থেকে ৭ লাইনে বিভিন্ন আঙ্গিকে ভেঙ্গে রচনা করেছি বিজ্ঞান সনেট। অনেকেই বিরোধিতা করছেন। কিছু বলার নেই। যাদের চিন্তা চেতনা শুধু অলসতার মধ্যে আবর্তিত হয় তাদের নিয়ে সাহিত্য মোটেও চিন্তিত নয়। সনেট রচনা কখনই সহজ নয়। সনেটের কল্পনাকে নির্মাণ শৈলীর রীতি মেনেই রচনা করা সিদ্ধ সত্য। ছন্দ তরঙ্গের ঢেউ না হলে পাঠক হৃদয় জয় করা অসম্ভব। এজন্য সনেট ছন্দ সিদ্ধ হওয়া একান্ত দরকার। অষ্টক এবং ষটকের ভাগ থাকলেই সব সনেট হয়ে যায় না। তবে ধারাবাহিক ভাব ঠিক থাকলে তা সনেট বা চতুর্দ্দশপদী কবিতা হতে পারে। বর্তমান সময়ে অনেকেই সনেটের অষ্টক ও ষষ্টক বা ষটকের ভাগ ভেঙ্গে চার /চার /চার/ দুই স্তবকে/মোট ১৪ লাইনে ঠিক রেখে সনেট লেখে। আবার অনেকে ষষ্টক বা ষটক আগে এবং অষ্টক নীচের অংশে রেখেও সনেট চর্চা করছেন। অনেকে কোন স্তবক ভাগ না করে একেবারে চৌদ্দ চরণ একসাথে রেখে সনেট চর্চা করছেন। আবার অন্তমিলে কখ, গঘ বা ধারাবাহিক প্রতি দুই লাইনে অন্তমিল রেখেও চর্চা করা হচ্ছে। এই গ্রন্থে সব আঙ্গিকেই চর্চা করা হয়েছে। আমাদের ভাষা, ঐতিহ্য, স্বদেশ, মানবতা, প্রেম, মমতা, সামাজিক ও রাজনৈতিক, পারিবারিক, আত্মীয়তা এবং কিছুটা দার্শনিক ভাব ধারায় আচছন্ন হয়ে অনেকেই প্রচ্ছায়া সনেট রচনায় ব্রতী। সমকালের স্রোতে একদিন নিশ্চয়ই শাণিত হয়ে চতুর্দ্দশপদী / সনেট আবারো নতুন কোনো স্বরূপে ফিরবে।
সংক্ষিপ্ত পরিচিত : কবি, গবেষক। সাবেক ছাত্রনেতা (ছাত্রলীগ)। সভাপতি- বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান কবিতা পরিষদ, নির্বাহী সচিব- অনুপ্রাস জাতীয় কবি সংগঠন। পড়াশুনা- এম.এ। জন্ম -২১ আগস্ট, ১৯৭৩, জেলা-লক্ষ্মীপুর, বাংলাদেশ। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ- ১৪টি, গবেষণা প্রবন্ধ-২টি (বিজ্ঞান কবিতার ভাবনা ও কাব্য কথায় ইলিশ), সহ মোট একক গ্রন্থ-১৬টি সম্পাদনা কাব্যগ্রন্থ-১টি, ‘জাগ্রত’ ছোট কাগজের সম্পাদক, সহযোগী সম্পাদনা (বিষয়ভিত্তিক)- ১১টি। লেখালেখির জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল স্মৃতি ফাউন্ডেশন-এর মহান বিজয় দিবস-২০১১ সম্মাননা ও সাপ্তাহিক শারদীয়া কাব্যলোক বিশেষ সম্মাননা-২০১৩ পেয়েছেন। ঠিকান : এ-১ ও এ-২, বাণিজ্যবিতান সুপারমার্কেট, ইস্টকর্ণার, ২য়তলা, নীলক্ষেত, ঢাকা-১২০৫, বাংলাদেশ। ফোন : ০১৬৭৪-৩৩৬০৯৯, ইমেইল- onupraskabita@gmail.com
বিজ্ঞান সনেট গ্রন্থটি প্রকাশ হয়েছে বইটি ২০১৭ বইমেলায় অভ্রপ্রকাশ এবং সারাবছর পাওয়া যাবে অনুপ্রাস জাতীয় কবি সংগঠনের কার্যালয়ে