প্রত্যুষে ঘুমের ঘোরটা কাটলেই চোখ তুলে চেয়ে দেখি, জানালার বাইরের বেলকনিতে কাপড় টাঙানোর আড়াআড়ি
রশিটার উপরে দুটো ধূসর রঙের চড়ুই পাখি; ভাবসাব দেখে মনে হয় গলা ছেড়ে দিয়ে, কোমরে কাপড় গুঁজে ঝগড়ায় নেমেছে। চি চি শব্দ করে একজন অন্য জনকে ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে দিচ্ছে; বসে বসে পেরে না উঠলে উড়ে উড়ে একে অপরকে আক্রমণ করছে - যেন সাপে-নেউলের কিংবদন্তিতুল্য লড়াই!

আপোষহীন সে লড়াইয়ে কোনো রাখঢাক নেই; নেই কোনো ভীরুতা, কাপুরুষতা আর দাসত্বের জড়তা।
আমাদের মতো দাসদেরও যেমন প্রভুর সাথে বচসা করার অনেক কারণ থাকে- ঐ খ্যাপাটে চড়ুই দুটোর মতোই।
কিন্তু আমরা তো তা পারি না। সর্বদা মাথাটা নীচু করে আনুগত্য দেখাই। সেটা শুয়োরের বাচ্চা বলে গালি দেবার সময়ও, কিংবা সালাম দিতে ভুলে গেছি বলে সজোরে বুকে লাথি চালান করে দেবার সময়ও!

গায়ে গতরে রিক্সা চালিয়ে ভাড়াটা চাইবার সময় যখন ৫০০ কেজি ওজনের একটা চটকনা সাই করে এসে ঢুকে যাওয়া গালের মধ্যে পড়ে, তখনও আমাদের মাথাটা নীচু করেই থাকতে হয়। মাথাটা উঁচু করে চোখে চোখ রেখে তাকালে যে এবার চোখ দুটোই শুটিয়ে লাল করে দেবে!

আমি অফিসের ছোট কর্তা। বড় কর্তার দিকে বুক চিতিয়ে চোখে চোখ রাখার জো নেই। সবসময়ই কর্তার সামনে হাত দুটো একজায়গায় গুছিয়ে শরীরের মাঝ বরাবর থেকে মাথা পর্যন্ত সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে মেরুদন্ডহীন নরম কেঁচোর মতো সটান দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। 'স্যার', 'স্যার' 'স্যার' বলা ছাড়া আর কোনো ভাষা থাকতে পারবে না। সরকারি টাকা তুলে নেওয়ার ভাওচারে অন্যায়ভাবে সাক্ষর করতে বললেও কিছু বলা যাবে না, বলা যাবে না নিরপরাধ মানুষের উপরে নির্বিচারে গুলি চালানোর আদেশ দিলেও!

এই দাসত্বের আদেশ যেমন চলে সমাজের সকল স্তরে,  তেমন চলে প্রশাসনেরও রন্ধ্রে রন্ধ্রে। থানার যে ওসি সাহেব তার নীচের সবাইকে ক্ষমতাহীন এক একটা শিশু বানিয়ে রাখে, সেই বাঘা ওসি সাহেবও এসপি সাহেবের সামনে হয়ে পড়ে একটি ভীতসন্ত্রস্ত হরিণ শাবক! আমরা যে মহা পরাক্রমশালী আইজির ক্ষমতার মহাকাব্যিক গল্প শুনে ঘুমতে যাই , তিনিও তার চাকরিদাতার রক্তরাঙা চোখের কাছে কম্পমান একটা বাড়ির মতো বেসামাল হয়ে পড়ে!

এভাবে গুনতে যদি থাকো, তবে দাসের খাতা থেকে কে আর বাদ পড়ে? তুমি,আমি, গফুর, নিতাই- এভাবে আমরা সবাই!
কিন্তু ঐ পাখি দুটোর পানে তাকাও- ওরা সাত সকালে আমার মতো এক তাবড় মন্ত্রীমহাশয়ের ঘুম ভাঙিয়ে ঝগড়া করছে- ওদের চোখে ছিটেফোঁটা দাসত্বের ভয় কি আছে?