একটা কবিতা দিয়ে আলোচনা শুরু করি-
    'ইয়া বায়াবাম ইয়া নায়াবাম
    জুসতুজু ই মি-কুনাম
    হাসেলায়াদ ইয়া নায়ায়াদ
    আরজু ই মি-কুনাম'।
    (প্রিয়,পাই বা না পাই
    আমি তোমাকে তালাশ করেই যাবো
    অর্জন হোক বা না হোক
    তোমার আশা ছাড়বোনা)
    -রুমি

‘মানুষ কী’ এই আলোচনার মধ্যে সুপ্ত রয়েছে কবিতা ও কবির সংজ্ঞা,উদ্দেশ্য। দুনিয়ার সমস্ত ভাষার মানুষ যেমন কবিতার সংজ্ঞা নিরুপন করার চেষ্টা করেছে,সেই সাথে ‘কবিতার সংজ্ঞা নিরুপন সম্ভবপর নয়’ মর্মে বয়ানও হয়েছে প্রচুর। অপরদিকে মানুষের পরিচয় অন্বেষণও কোন নতুন বিষয় নয়। এসবে ভরপুর দুনিয়ার জ্ঞানশালা।

তবে কবিতা হলো সর্বউচ্চ শিল্পকর্ম,কবিতার পরিচয় জানার জন্যে যে 'মানুষের' মৌলিক বিশ্লেষন জরুরী একথা কেউ ভাবেনি।তাইত যত বেশি প্রচেষ্টা হয়েছে ততই ধোয়ার বৃত্তে আটকে গেছে কবিতা।পুরনো শতাব্দীগুলো যোগ্যতা অনুযায়ী নিজ নিজ প্রাপ্য বুঝে পেয়েছে।আপন মহিমায় ভাষ্মর হয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়।আর একবিংশ শতাব্দীকে পৌছে দিয়েছে নিজেদের যাবতিয় অর্জন।আমাদের জ্ঞানশালার দেয়াল জুড়ে ঝুলে আছে সক্রেতিস,প্লেতো,আরিস্ততেলেসের ছবি।অনেক রক্ত আর ক্লেদএর তিক্ততা ছাপিয়ে আসমানী সংবাদ পৌছে গেছে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে।

মানুষ প্রধানত দুইটি উপাদানের সমন্বয়-রুহ এবং শরীর।শরীর হলো মৌলিক চার বস্তুর ঘনিষ্টতা।আগুন পানি মাটি বাতাস।দার্শনিকগন অক্লান্ত পরিশ্রম করে এসব তথ্য উদঘাটন করেছেন।রুহই মুলত মানুষ-শরীর তার বাহন।বস্তুজগত হতে উপকৃত হওয়ার জন্য রুহ বস্তুনির্মিত বাহন এক্তিয়ার করে।ন্যায় অন্যায়ের উৎসও এই রুহ এবং শরীর।কাম ক্রোধ লোভ মোহ, এসব বস্তুর স্বভাবগুন। যেমন আমরা বলি জৈবিক চাহিদা অথবা জৈবিক বৃত্তি। এদের পরাস্ত করে রুহ নিজের সৈনিক করে নেয়। এইসব অদৃশ্য ক্রিয়াকলাপ এক মহা সমুদ্রের মত।ইহা চিন্তার জগৎ।তাতে স্ফটিকস্বচ্ছ টলটলে পানি আর ঘোলা জলের বিভেদ।মনুষ্যত্ব বনাম পশুত্ব।

এখন আমরা কবিতা ও কবি’র পরিচয় উদঘাটন করবো।সেই সাথে এও জানবো কোনটা কবিতা কোনটা কবিতা নয়।যদিও লেখা’র মধ্যে শব্দের ঝংকার,মোহনিয় ছন্দ আর ঐন্দ্রজালিক আবেশ থাকে পুরো মাত্রায়।আসুন এবার আমরা সবচে দূরুহ কাজটি সমাধা করি।
কবি নিজের ভিতর ডুব দিয়ে আপাতগোপন বোধসমূহ তুলে আনেন।সমুদ্রে ডোবার মতই এই কাজ খুবই বিশিষ্ট-দুঃসাধ্যও বলা যায়।‘বাহিরকে ভিতরে নিয়ে ভিতরকে বাহির করা’।আহরিত জ্ঞানের সাথে কবির স্বভাব,রুচী,পরিমিতিবোধ এইসব যুক্ত হয়ে সৃষ্টি হয় সবচে মূল্যবান শিল্প ‘কবিতা’। কবি নিজের রুচী মাফিক বাহির থেকে জ্ঞান গ্রহন করে।নাবিকের রুপধরে পাড়ি জমায় নিজস্ব সাগরে।সেখানে গাঙচিল ওড়ে,আরো ওড়ে রংবেরঙের হাজারো পাখি। সেখানে স্বচ্ছ আর ঘোলা জলের পার্থক্যরেখা বড় আচানক,রহস্যপূর্ণ।রুচির কম্পাস কবিকে ঠিক ঠিক পৌছে দেয় আকাঙ্খিত গন্তব্যে।এ হলো কবিতার প্রথম অংশ।
মনের কথা প্রকাশ করার জন্য যথোচিত শব্দের সমন্বয়সাধন কবিতার দ্বিতীয় অংশ।মনোভাব এবং তার সফল পরিবেশন এই দুইয়ের মুন্সিয়ানা হলো কবিতা।

একজন হতে সমস্ত মানুষের উৎপত্তি বিধায় আমাদের হৃদয়ের আর্তী,আমাদের মানবতাবোধ,প্রেম,বিচ্ছেদ যাতনা শোসন শাসন প্রতিবাদ উন্নয়ন,সবকিছু একই ঘরানার। যে ভাষায়ই লেখা হোক না কেন পাঠক পড়েই তাকে আপন করে নেয়। বিচ্ছেদের কবিতা পড়ে কাঁদে,প্রতিবাদমূখর কবিতা আমাদের প্রতিবাদী করে তোলে।কবির সৌন্দর্যবন্দনা পাঠ করে আমরাও সুন্দরের সাথে মিলেমিশে আলৌকিক আনন্দ উপভোগ করি।

কবিতা হলো হিতপদেশ,নির্মল আনন্দ আর সুন্দরের জয়গান।যত গভিরতা তত অদৃশ্য মানবমানস।এসব সবার সাধ্যে কুলায় না। আত্মউন্নয়ন ছাড়া যদি কেউ জৈবিক চাহিদার মালমশলা নিয়ে কবিতা চর্চা করে,তাহলে কামআশ্রিত,চেতনাহরনকারী,অস্থীর সে শব্দের ঝংকার কবিতা নয়।মনোহর সে ছন্দ কবিতা নয়।সে ঐন্দ্রজালিক তুকতাক সৃষ্টির নামে বালখিল্যতা।
কবির দায় বোঝার জন্য আর কোন ভাষণের প্রয়োজন নেই। কবির দায় ‘আত্মউন্নয়ন’।
দূর্গম সড়কে পাঠককে পথনির্দেশ দিতে হলে কবির দায় এতটুকু যে কবি নির্ধারন করবেন কোনদিকে যাবো।

যারা কাল্পনিক বিষয়বস্তুর জন্য ময়দানে উদভ্রান্ত হয়ে ঘোরাফেরা করে। অতঃপর বাস্তবতাবর্জিত কিছু পেয়ে যায়-সে সব পরিশিলিত শব্দ কতখানি কবিতা তা বিচারের ভার দ্বাবিংশ শতাব্দীর জন্য তুলে রাখলাম।